বর্গী হানার সাক্ষী ওঁয়াড়ি গ্রামের বড়মা, ৫০০ বছরেও অটুট সম্প্রীতির প্রতীক

এখন মোষ বলিদান আর না হলেও পুরানো প্রথা মেনে কালী পুজোর দিনবড়মার সামনে হয় লাঠি খেলা। দেবী বড়মাকে আঁকড়ে ধরেই ওঁয়াড়ি গ্রামে বিরাজমান রয়েছে সম্প্রীতির অটুট বন্ধন ।

এখন মোষ বলিদান আর না হলেও পুরানো প্রথা মেনে কালী পুজোর দিনবড়মার সামনে হয় লাঠি খেলা। দেবী বড়মাকে আঁকড়ে ধরেই ওঁয়াড়ি গ্রামে বিরাজমান রয়েছে সম্প্রীতির অটুট বন্ধন ।

author-image
Pradip Kumar Chattopadhyay
New Update
cats

বর্গী হানার সাক্ষী ওঁয়াড়ি গ্রামের বড়মা

বর্গী হানায় একদা তছনছ  হয়ে গিয়েছিল সারা বাংলা । তার রেশ পূর্ব বর্ধমানের খণ্ডঘোষের ওঁয়াড়ি গ্রামেও আছড়ে পড়েছিল। প্রায় পাঁচ শতাধীক বছরকাল আগের সেই  বর্গী হামলায় নিজের আশ্রয় পর্যন্ত হারাতে হয়েছিল  ওঁয়াড়ি গ্রামের বাসিন্দাদের আরাধ্য দেবী বড়মাকে। তাঁর ঠাই হয়েছিল শ্মশান সংলগ্ন পরিত্যক্ত জায়গায়। সেখানেই দীর্ঘদিন তিনি পড়েছিলেন ।স্বপ্নে দেবী এই গ্রামের বাসিন্দা বুদ্ধদেব  সরকারকে  তার দুরাবস্থার কথা জানান। তার পরেই দেবীকে উদ্ধার করে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে বুদ্ধদেব বাবু প্রথম পুজোপাঠ শুরু করেন।পরে মন্দির গড়ে তিনি সেখানে  বড়মাকে প্রতিষ্ঠা করেন । 

Advertisment

বিশ্বাস-আবেগ যেখানে মিলেমিশে একাকার, খালি হাতে ফেরেন না ভক্তরা, নৈহাটির বড়মা'র মাহাত্ম্য জানলে গায়ে কাঁটা দেবে

সেই থেকে  প্রতি বছর কার্তিকেয় আমাবস্যা তিথিতে কালি পুজোর দিন ওঁয়াড়ি গ্রামে ঘটাকরে হয়ে আসছে বড় মায়ের পুজো। বর্গীদের মহিষাসুরের সঙ্গে তুলনা করে  বড়মায়ের পুজোয়  একদা মোষ বলি হত ।সেই সময়ে  মহিষাসুর বধের উল্লাশে  বড়মার প্রতিমার সামনে  লাঠি খেলায় মাতোয়ারা হতেন  ওঁয়াড়ি গ্রামের  হিন্দু ও মুসলিম যুবকরা। এখন মোষ বলিদান আর না হলেও  পুরানো  প্রথামেনে কালি পুজোর দিন  বড়মার সামনে হয় লাঠি খেলা । দেবী বড়মাকে আঁকড়ে ধরেই  ওঁয়াড়ি গ্রামে  বিরাজমান রয়েছে সম্প্রীতির অটুট বন্ধন ।ওঁয়াড়ি গ্রামে বড়মা দেবী কালি রুপে পূজিতা হলেও আদতে বড়মা হলেন দুর্গাকালি রুপি । বড়মার প্রতিমা প্রকৃত অর্থেই নজরকাড়া। গনেশ,কার্তিক,লক্ষ্মী ও সরস্বতীর সঙ্গে দুই পরী জয়া ও বিজয়াকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠিতা দুর্গা কালী রুপি বড়মা।নিজের মাহাত্ম গুনেই বড়মা ওঁয়াড়ি  গ্রামের বাসিন্দাদের কাছে অনন্য দেবী রুপে ভূষিতা হয়েছেন । এলাকাবাসীর বিশ্বাস বড়মায়ের কাছে কেউ কিছু চাইলে বড়মা তাকে নিরাশ করেন না । তাই শ্রদ্ধায় গ্রামের সকলেই তার কাছে মাথানত করেন ।

Advertisment

কাটোয়ার ক্ষেপি মায়ের পুজো: শান্তি, সমৃদ্ধি ও ঐতিহ্যের প্রতীক

পূর্বে গ্রামের সরকার বাড়িতে পূজিতা হতেন বড়মা ।এখন তিনি পূজিতা হন ওঁয়াড়ি গ্রামের সকলের   বড়মা রুপে ।দেবীর মন্দিরটিও তৈরি হয়েছে বিশাল আকারে । শোনাযায় একসময়ে বড়মায়ের সম্পত্তির পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে সাতশো বিঘা ।সেসব এখন  ইতিহাস । জানা গেছে,  সামান্য ৩০ - ৩৫ বিঘা  দেবত্তর সম্পত্তি এখন রয়েছে বড় মায়ের নামে ।সেই জমির আয় থেকেই সারা বছর বড়মায়ের  নিত্য সেবা ও  কার্তীকেয় আমাবস্যা তিথির   বিশেষ পুজোপাঠ হয়। পুজো সাতদিন ধরে চলে।পুজারী তুষার বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন , তন্ত্র মতেই হয় বড়মায়ের পুজো ।মায়ের পুজোর ভোগ অন্নে    চালকলাই ভাজা ও চিনি দিতে হয়। পুজারি আরো জানান ,“আগে   মহিষাসুর বধকে শ্মরনকরে হত মোষ বলি ।তবে মোষ বলিদান এখন আর হয় না ।  তবে উপাচার মেনে ছাগ , আখ ও ছাঁচি কুমড়ো বলিদান হয় ।কালি পুজোর দিন থেকে শুরু করে সাত দিন ধরে চলে বড় মার বিশেষ পুজোপাঠ । বছরের অন্য দিন  গুলিতে  গ্রামের বাসিন্দাদের  কেউ কর্মসূত্রে বাইরে থাকলেও  পুজোর সাতটি দিনের জন্য সবাই ফিরে আসেন গ্রামে ।পুজোর সাত দিন  উৎসব  মুখর থাকে  সমগ্র ওঁয়াড়ি  গ্রাম । এলাকায় বসে বিশাল মেলা ।  হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও যাত্রা পালা।

আলোয় 'স্নান' রামনগরীর, দীপোৎসবে জ্বলল ২৬ লক্ষ প্রদীপ, সৃষ্টি হল ইতিহাস

বড়মার প্রতিমার রুপ ও মাহাত্ম নিয়ে ওঁয়াড়ি গ্রামের বাসিন্দা মহলে অনেক কাহিনী  প্রচলিত রয়েছে ।এলাকার  বাসিন্দা মুসূদন চন্দ্র বলেন ,কথিত আছে চরম দারিদ্রতা মধ্যে দিনযাপন করতেন গ্রামের সরকার পরিবারের পূর্ব পুরুষ বুদ্ধদেব সরকার । উদাস মনের এই মানুষটি কালি মায়ের ভক্ত ছিলেন। মধুসূদন বাবু বলেন , গ্রামের  প্রবীনদের কাছে শুনেছি  ওঁয়াড়ি গ্রামের একপাশে ছিল শ্মশান ঘাট। সেখানে নিজের পোষা  গরু চরাতে যেতেন  বুদ্ধদেব বাবু । গরু চরাতে চরাতে একদিন সেখানেই বুদ্ধদেব ঘুমিয়ে যান।  স্বপ্নে  বড়মা তাকে দেখাদেয়  । বড়মা বুদ্ধদেবকে বলেন , বর্গী হামলায় তার সবকিছু তছনছ হয়েগেছে । বর্গীরা সব মন্দির ধ্বংস করেদিয়েছে । নিজের দুরাবস্থার কথা বুদ্ধদেবকে জানিয়ে বড়মা  বলেন , ’আমি খুব কষ্টে রয়েছি । বড়মার  নির্দেশ দিয়ে বুদ্ধদেবকে বলেন ,’আমাকে শ্মশান থেকে  উদ্ধার করে   নিয়েগিয়ে তোর বাড়িতে প্রতিষ্ঠা কর। এই সময় বুদ্ধদেব  মাকে বলেন , আমি নিজেই দু’বেলা খেতে পাইনা । তোমাকে প্রতিষ্ঠা করে কি খাওয়াবো ? তখন দেবী বুদ্ধদেবকে  জানিয়েদেন, সামান্য চাল কলাইভাজা আর একটু চিনি দিবি তা দিয়েই আমার খাওয়া হয়েযাবে । একই সঙ্গে বড়মা নির্দেশ দিয়ে বুদ্ধদেবকে বলেছিলেন,লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গনেশও দুরাবস্থায় রয়েছে। আমার সঙ্গে ওদেরও প্রতিষ্ঠাকরে  পুজো করবি’। বড়মার সেই নির্দেশ মেনেই বুদ্ধদেব সরকার বড়মার পুজোপাঠ শুরু করে । সেই থেকে গনেশ , কার্তিক , লক্ষ্মী ও সরস্বতীকে সঙ্গে নিয়েই  দুর্গাকালি রুপে ওঁয়াড়ি গ্রামে পূজিতা হয়ে আসছেন বড়মা ।’

Kali Puja