Fishermen Hilsa Journey: বঙ্গোপসাগরের জেলেদের জীবন জীবিকা! আপনি জানেন সাগরে ইলিশ মাছ ধরার নেপথ্যের গল্প?
Bengali Hilsa culture: ইলিশ শুধু একখানি মাছ নয়। ইলিশ মানে জীবিকার প্রতীক। ইলিশ মানে বাঁচার আর্তি। যে মাছ শহরে এসেছে প্লাস্টিকের ট্রেতে বরফে ঢাকা হয়ে, সেই ইলিশ পেরিয়ে এসেছে রাতের আঁধার, নদীর ঢেউ, ঝড়, তুফান, আর হাজারো মানুষের প্রার্থনা পরিশ্রমের ফসল হয়ে।
Bengali Hilsa culture: ইলিশ শুধু একখানি মাছ নয়। ইলিশ মানে জীবিকার প্রতীক। ইলিশ মানে বাঁচার আর্তি। যে মাছ শহরে এসেছে প্লাস্টিকের ট্রেতে বরফে ঢাকা হয়ে, সেই ইলিশ পেরিয়ে এসেছে রাতের আঁধার, নদীর ঢেউ, ঝড়, তুফান, আর হাজারো মানুষের প্রার্থনা পরিশ্রমের ফসল হয়ে।
ইলিশ মানে শুধু স্বাদ নয়, ইলিশ মানে জীবন। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ
Bengali Hilsa culture: সকালের আলো তখনো পুরোপুরি ফুটেনি। পুব দিকে আকাশ ভোরের লালচে আভা। জোয়ারে মুড়ি গঙ্গার নদীর জল বাড়ছে। পাড় ভাঙ্গা গাছেদের সারি দুলছে। নদীর জল এসে ধাক্কা খাচ্ছে। মাছ ধরার নৌকোগুলোতে ততক্ষণে শুরু হয়ে গিয়েছে প্রস্তুতি। কেউ জাল ঠিক করছে, কেউ দড়ি গুছিয়ে রাখছে, কেউ আবার কাঠের পাটাতনে বসে বিড়িতে টান দিচ্ছেন। পেছনে রোদ উঠছে ধীরে ধীরে। যেতে হবে বঙ্গোপসাগরের মোহনায়। সামনে বিস্তৃত জলরাশি, অনেকটা যেন অনিশ্চিত জীবনের প্রতিচ্ছবি। শান্ত নিবিড় জায়গায় জলের শব্দের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে জেলেদের হাকডাক।
Advertisment
এই প্রস্তুতির নাম ইলিশ মরসুম। সারা বছর যে গাঁয়ের লোকগুলো সংসারের খরচ টানতে হিমশিম খায়, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র বাংলার তিনটে মাসে তারাই আশা করেন ঘুরে দাঁড়ানোর। কেননা জোয়ারের জল যখন গাঙে উঠে আসে, সঙ্গে ভেসে আসে তাদের স্বপ্ন, ইলিশের ঝাঁক।
শুধু মাছ নয়, এক অনুভবের নাম ইলিশ। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ
‘জালে মাছ উঠলে সংসারে দু-চার পয়সা রাখতে পারি’। তারক প্রামাণিক পঞ্চান্ন বছরের একজন মাঝি। পেশায় জেলে, নদীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক জন্ম থেকেই। লোহাচূড়ায় ছিল তাঁর বাড়ি। যদিও সে জায়গা এখন জলের নিচে। বর্তমানে ঘোড়ামারা দ্বীপের বাসিন্দা। সকালে তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। গলায় গামছা জড়ানো, পরনে লুঙ্গি সাদা গেঞ্জি। জাল গুছোচ্ছিলেন। বলছিলেন, “বুঝলেন বাবু, এই একটা মাছের জন্যই বছরের বাকি দিনগুলো আমরা বেঁচে থাকি। যদি দুটো বড় ইলিশ জালে পড়ে, দু পয়সা রেখে আর দোকানের বাকি ধার দেনা মিটিয়ে ফেলতে পারব। আমাদের নদীর চরে যাঁদের বাস তারা সকলেই বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যায় প্রতিদিন। ইলিশ আমাদের কাছে লক্ষ্মী।”
শুধু তারক নয়। নদীপাড়ের বহু ঘরের সকাল, সন্ধ্যার হিসেব এখন নির্ভর করে এই রুপালি মাছটির উপর। কারও মেয়ের বিয়ের গয়না কেনা হবে কিনা, কারও ঘরে চাল ঢুকবে কিনা, সব কিছুই নির্ভর করে একেকটা জালে ইলিশ ধরা পড়বে কিনা তার উপর। বঙ্গোপসাগরকে আঁকড়ে জীবন জীবিকা। নদীর ভাঙ্গা গড়ার খেলায় অন্যতম সাক্ষী।
ইলিশ মাছ ধরার তিন মাসের যুদ্ধ, ন’মাসের খালি পেট। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ
ইলিশ মাছের ‘রাজা না রানি’, এই দ্বন্দ্বেই বাঁচে স্বপ্ন। ইলিশ নিয়ে নানা কথার চল আছে। কেউ বলেন, ইলিশ নাকি রানি মাছ। কেউ বলেন রাজা। কিন্তু সবার কথা মিলিয়ে যে বিষয়টা ঠিক, সেটা হল, ইলিশ হল গর্ব। বাঙালির গর্ব, আবেগ, ভালবাসা। যেমন সাগরের ঢেউয়ে গড়া তার শরীর, তেমনি তার গতির জোর। জল কেটে চলে যায় একটানে। বোকা মাছ নয় ইলিশ। তীক্ষ্ণ, দ্রুত, দুরন্ত। একে আয়ত্তে আনতে চলে যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। দিনের পর দিন কাটে সাগরে জলেই।
“জল যদি ঠিকঠাক না থাকে, হাওয়া যদি বেঁকে আসে, ইলিশ কিন্তু ধরা দেবে না,” বললেন রতন মাঝি। “এই মাছকে ধরতে হলে যেমন ভাগ্য লাগে, তেমন লাগে নদীর সঙ্গে বোঝাপড়া। নদীর মন বোঝার অভ্যাস করতে হয় বছর বছর ধরে। আগে মাছ ধরার খুঁটিনাটি শিখতে হত। এখন সেই লোক আর নেই। চরের বেশিরভাগ ইয়ং ছেলেরা এখন দেশান্তরী। কেউ কেরালায় কেউ হায়দরাবাদ, গুজরাট। টাকা নেই এখানে কোনো টাকা নেই। আমাদের মতন বয়স্কদের যাওয়ার কোথাও জায়গা নেই।”, আক্ষেপের সুরেই বলেন তারক।
জাল তুলে আনার সময় মাঝিদের চোখ থাকে জলের দিকে। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ
ইলিশ মাছ ধরার তিন মাসের যুদ্ধ, ন’মাসের খালি পেট। বাইরে যারা চলে গিয়েছেন তারা এই তিন মাসের জন্য বাড়ি আসেন। তারপর আবার পরিবার পরিজন ছেড়ে পেটের তাগিদে বাইরে চলে যান। বাংলার উপকূলজুড়ে যারা ইলিশ ধরেন, তাঁদের অধিকাংশই দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা। নিজেদের নৌকা নেই, জাল নেই। কিস্তিতে বা ধার করে জাল কেনেন। অনেক সময় বড় মাঝিদের কাছ থেকে নৌকা ভাড়া নিয়ে নামতে হয় জলে। এই মরসুমে না নামলে সারা বছরের হিসেব এলোমেলো হয়ে যাবে।
জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর, এই তিন মাসেই মূলত ইলিশ ওঠে বেশি। বৃষ্টির জল এলেই ইলিশ জড়িয়ে পড়ে জালে। তিন মাস পরে তারপর বন্ধ থাকে মাছ ধরা। কেউ কেউ সামান্য চিংড়ি বা বাগদা ধরেন, কিন্তু সেগুলো দিয়ে সংসার চলে না।
ইলিশ শুধু মাছ নয়, একেকটা জাল যেন একেকটা লটারি। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ
“বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করানো, ঘরের চাল সারানো, পুজোর শাড়ি কিনে দেওয়া, সবই আমরা এই সময়ে হিসেব নিকেষ করি,” জানালেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার নামখানার এক মাঝি। “জানেন, ইলিশে মাছ না উঠলে আমরা শুধু ক্ষতিতে পড়ি না, ধারও ডুবে যায়।” ইলিশ শুধু মাছ নয়, একেকটা জাল যেন একেকটা লটারি। ইলিশের বড় জাল পাততে হয় জলের গভীরে। মাঝিদের এক একটা যাত্রা যেন সমুদ্রযুদ্ধের মতো। কুয়াশা, জোয়ার, বজ্রপাত, ঝোড়ো হাওয়া, সব কিছুর মধ্য দিয়েই নামতে হয় সাগরের বুক চিরে।
জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর, এই তিন মাসেই মূলত ইলিশ ওঠে বেশি। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ
একেকটা জাল ফেলেই বসে থাকতে হয় সাগরের বুকেই। অপেক্ষা শুরু হয়। যদি ভাগ্য ভাল হয়, জালে একসঙ্গে উঠবে ২০ থেকে ৫০টা ইলিশ, কখনো তার চেয়েও বেশি। আর না হলে, ফিরে যেতে হবে খালি হাতে। বড় নৌকা হলে তারা মাঝ সমুদ্রেই ১৫ থেকে ২০ দিনের জন্যে থেকে যান। ছোট নৌকা জোয়ার ভাটা দিনক্ষণ দেখে ফেরেন। জাল তুলে আনার সময় মাঝিদের চোখ থাকে জলের দিকে। প্রথম ইলিশটা দেখা গেলেই নৌকায় হইচই পড়ে যায়। কেউ “আল্লা ভরসা” বলেন, কেউ “মা গঙ্গা বাঁচা” বলে হাত জোড় করেন।
ইলিশ মানেই তো পান্তা ভাতের পাশে রাখা একটা তেলে ভাজা টুকরো। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ
বাজারে যার দাম হাজার, জেলের ভাগ্যে জোটে সামান্য। আমরা যারা শহরের বাজারে ইলিশ কিনতে যাই, তারা প্রতি কিলোতে ১৫০০–৩০০০ টাকা দাম দিই। কিন্তু জানেন, এই ইলিশ ধরার মাঝির হাতে কত টাকা পড়ে? এক কিলোর ইলিশের জেলেদের ন্যায্য প্রাপ্য অনেক সময় মাত্র ২০০–৩০০ টাকা। বাকি টাকাটা চলে যায় দালাল, ট্রান্সপোর্ট, বাজার ফি, আড়তদারদের পকেটে। এই ব্যবস্থার কথা উঠলে মাঝিরা কেবল হাসেন। কেউ বলেন, “আমরা শুধু মাছ ধরি, বাজার ধরতে শিখিনি।” আবার কেউ বলেন, “যতবার চেষ্টা করেছি, ব্যর্থ হয়েছি। বড়লোকের মজার খেলা, আমাদের হাতে নেই।”
নদী নেই, ঘর নেই, ইলিশটাই শেষ ভরসা। নদীভাঙনে ঘর হারিয়েছেন এমন বহু মানুষ এখন দক্ষিণবঙ্গের নানা তীরে ঠাঁই নিয়েছেন। কাজ নেই, চাষ নেই, একমাত্র ভরসা মাছ ধরা। আর সেই মাছ ধরার বড় ভরসা ইলিশ।
ইলিশ শুধু একখানি মাছ নয়। ইলিশ মানে জীবিকার প্রতীক। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ
“আমার বাড়ি ছিল ঘোড়ামারা একদম পূর্ব দিকে। সব গেল নদীতে। এখন এই খালে থাকি একটা মাটির ঘরে, গেলো বছর বর্ষাতে ভরা কোটালে সেই বাড়ির দেওয়ালও ভেঙ্গে দিয়েছে।” বলছিলেন প্রদীপ সাগর মাঝি। “ইলিশ ছাড়া আর কিছু জানি না। ওটাই ধরি, ওটাই বিক্রি করি, ওটাতেই বাঁচি। ছেলেমেয়ে, বৌ, আর বয়স্ক মাকে নিয়ে সংসার। এরা ছাড়া আপন বলতে পুরো গ্রামের মানুষ।”
শুধু মাছ নয়, এক অনুভবের নাম ইলিশ। ইলিশ মানেই তো পান্তা ভাতের পাশে রাখা একটা তেলে ভাজা টুকরো। ইলিশ মানেই পুজোর দুপুরে পাতুরি আর মেঘলা আকাশ। ইলিশ মানেই ছোটবেলার ঘ্রাণ, মায়ের রান্না, আর বৃষ্টির শব্দ। এই ইলিশ নিয়ে চলে বারো মাস তর্ক। পদ্মা না গঙ্গা? ডিমভরা ভালো, না ডিম ছাড়া? ঝোল ভালো না পাতুরি? কিন্তু এসব তর্ক ভুলে গিয়েও একটা কথা সবাইকে মেনে নিয়ে হয়, ইলিশ আমাদের হৃদয়ে গেঁথে আছে। তাকে ছাড়া বাঙালির বর্ষা অসম্পূর্ণ। ইলিশ শুধু একখানি মাছ নয়। ইলিশ মানে জীবিকার প্রতীক। ইলিশ মানে বাঁচার আর্তি। যে মাছ শহরে এসেছে প্লাস্টিকের ট্রেতে বরফে ঢাকা হয়ে, সেই ইলিশ পেরিয়ে এসেছে রাতের আঁধার, নদীর ঢেউ, ঝড়, তুফান, আর হাজারো মানুষের প্রার্থনা পরিশ্রমের ফসল হয়ে।
এক একটা ইলিশে লুকিয়ে আছে হাজারটা মুখ, সাগরের ঢেউ, নদীর ভাঙ্গনে কোনও জেলের ভাঙা ঘর, সাগরের ঢেউয়ে ভেসে যাওয়া ঘরের অশ্রু। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ
বর্ষার দুপুরে প্লেটভর্তি ভাজা ইলিশ মাছের স্বাদ উপভোগ করার সময়। খোঁজ করিনা এই মাছ কোথা থেকে এল? কে তাকে ধরে এনেছে? তার ঘরে আজ খাবার আছে তো? নেপথ্যের গল্পটায় চাপা পড়ে যায়। এক একটা ইলিশে লুকিয়ে আছে হাজারটা মুখ, সাগরের ঢেউ, নদীর ভাঙ্গনে কোনও জেলের ভাঙা ঘর, সাগরের ঢেউয়ে ভেসে যাওয়া ঘরের অশ্রু।