Advertisment

Baruipur News: রোজ অগণিত মানুষের বৈতরণী পারের গুরুদায়িত্ব তাঁরই কাঁধে, কর্তব্যে অবিচল টুম্পা

Baruipur News: ২০১৪ সালে বাবার মৃত্যুর পর থেকে জীবনটাই যেন ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে শুরু করেছিল মেয়েটার। নানা 'ঝড়' সামলে গত ১০ বছর ধরে এই কাজ করে চলেছেন টুম্পা দাস।

author-image
Shashi Ghosh
আপডেট করা হয়েছে
New Update
COVER PHOTO 2

দৃঢ় সংকল্পে কাজ করে চলেছেন টুম্পা দাস। এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।

Life story of Tumpa Das: অগ্রায়ন মাসের শুরু। বাইরে হালকা শীতের আমেজ। রোদ্দুরের তাপ তেমন একটা গায়ে লাগে না। পুরন্দরপুর জোড়া মন্দিরের পাশ দিয়ে যে রাস্তা চলে যাচ্ছে তার ঠিক ডান পাশেই নীল রঙের মহাশ্মশান। সূর্যের আলো এসে পড়েছে শ্মশানের ঈশান কোণের ঘরটায়। পুরো শ্মশানে মানুষ বলতে একজন। তাও আবার মহিলা! ছোট ঘরটায় বসে ঘাড় গুঁজে লিখে যাচ্ছিল। সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এখানেই থাকেন। পেশায় ডোম। মহিলা ডোম! শ্মশানে যেতেই যেখানে ভয়ে অনেকে শিউরে ওঠেন । সেখানে মৃতদের নাম নথিভুক্ত করা থেকে শুরু করে দেহ সৎকার, চুল্লির কাজ সবই একা হাতেই সামলান এই তরুণী। তার পুরো নাম টুম্পা দাস। বয়স ২৯। শ্মশানের পাশেই তাঁর বাড়ি। গত দশ বছর ধরে বারুইপুরের পঞ্চায়েত এলাকা পুরন্দরপুর মহাশ্মশানের দায়িত্ব সামলে আসছেন।

Advertisment
  এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ 

কল্যাণপুর পঞ্চায়েতের পুরন্দরপুর জোড়া মন্দিরের কাছেই তার ঘর। বাড়ির লাগোয়া শ্মশানের ডোমের দায়িত্বে ছিলেন তাঁর বাবা বাপি দাস। ২০১৪ সালে হঠাৎ করেই বাবার মৃত্যু হয়। বাড়ির বড় মেয়ে টুম্পা। বাড়িতে রয়েছে ছোট বোন, মা এবং ভাই। তাই সংসার টানতে শ্মশানে বাবার কাজকেই উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি নিজের কাঁধে তুলে নেন মাধ্যমিক পাশ টুম্পা। তারপর থেকে পেরিয়ে গিয়েছে ১০ বছর। কোনও ভয়-ভীতি ছাড়াই নির্দ্বিধায় ডোমের কাজ করে চলেছেন।

 এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ 

শ্মশানে ডোমের দায়িত্বে বরাবরই থাকে ছেলেরা একজন মেয়ে হয়ে টুম্পা কেন পেশায় এলো? টুম্পার উত্তর, "এখন ছেলে মেয়ে বলতে আলাদা করে কিছু নেই। সবাই সমান। অভাবের সংসারে বেশিদূর পড়াশুনা করা হয়নি।মাধ্যমিকের পরে নার্সিং ট্রেনিং নিয়ে কাজও শুরু করেছিলাম। বাবা কাজ করতেন কল্যাণপুর শ্মশানে।  বাবার মৃত্যুতে সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যায়। এক ভাই দু বোন আমরা। ভাই তখন ছোট। আমি বড় হওয়াতে সংসার চালানোর জন্যে বাড়ির পাশে ডোমের চাকরিতেই নাম লেখালাম। আর তাছাড়া নার্সিংয়ের কাজে যা বেতন পেতাম তাতে ঘরে পাশে এই কাজই অনেক ভালো।"

আরও পড়ুন- Human trafficking: নাটকীয় অভিযানে RPF! পাচারের পথে নাবালিকাদের উদ্ধারের এগল্প দারুণ চর্চায়

Baruipur Woman Dom Tumpa Das: বারুফুর মহিলা ডোম টুম্পা দাস
কর্তব্যে অবিচল টুম্পা দাস। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ।

গত দশ বছর ধরে টুম্পার রুটিন গতে বাঁধা। সকাল ছ’টায় ঘুম থেকে ওঠেন, বাড়ির কাজকর্ম সামলে সকাল ৮টায় শ্মশানে ডিউটিতে ঢোকেন। এক হাতে গ্লাভস গলিয়ে নেন। কাঠের চুল্লি রেডি করেন। ২০১৯ সালে এই শ্মশানে ইলেকট্রিক চুল্লি বসেছে। সেটিও তাঁর দায়িত্বে। অধিকাংশ কাজ নিজের হাতে করেন। বাকি কাজ করেন তাঁর সহকর্মীরা। শ্মশানে মৃতদেহ ঢুকলে ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায়। প্রথমে দেহের নাম নথিভূক্তি করান টুম্পা। তারপর চুল্লিতে দেহ ঢোকানো। কাঠের চুল্লিতে পুড়লে খাটনি বেশি। দাহ সম্পূর্ণ হলে অস্থিকলস তৈরি থেকে বিসর্জনের কাজের যাবতীয় কাজের দায়িত্ব থাকে টুম্পার কাঁধে। গত দশ বছরে পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষের সৎকার করেছেন। 

শ্মশানের ডোম বলতেই চোখের সামনে যেন ভেসে ওঠে ভয়ানক কোন চেহারা। পেশীবহুল হাত। রক্তের মতো লাল চোখ। রগচটা মেজাজ। টুম্পার ক্ষেত্রে এসব একদমই খাটেনা। মৃদু গলার স্বর। ভীরু চাউনি। মুখে হাসি। তাঁকে দেখে কস্মিনকালেও কেউ ভাববে না, তরুণী মেয়েটি শ্মশানে ডোমের কাজ করেন। একটা সময় অবশ্য তিনি নিজেও ভাবতে পারেননি এই কাজ করতে হবে। 

আরও পড়ুন- Sandakphu: সান্দাকফু গিয়ে কলকাতার পর্যটকের মর্মান্তিক মৃত্যু, উদ্বিগ্ন প্রশাসন কঠিন নিয়ম আরোপের পথে...

Woman Dom Tumpa Das: মহিলা ডোম টুম্পা দাস
এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।

এই  শ্মশানে একা থাকতে ভয় হয় না? "মরা মানুষের থেকে জীবিত মানুষে ভয় বেশি। প্রথম প্রথম একটু ভয় লাগতো। তারপর আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে গিয়েছে। শ্মশানেই মানুষের সব শেষ। যত দম্ভ, টাকা পয়সা, এমনকি গায়ের কাপড়টুকু পর্যন্ত মানুষ চিতায় নিয়ে যেতে পারে না। তাই বাইরের জগতের থেকে এখানেই আমি অনেক বেশি সুরক্ষিত থাকি।"

পঞ্চায়েত থেকে ডোমের চাকরিতে মাইনে মাত্র সাড়ে ৩ হাজার টাকা। আজকালকার যুগে এই বেতনে সংসার চলে? টুম্পার মুখের হাসিতে লুকিয়ে থাকে চাপা দুঃখ।  প্রশ্ন শুনে চোখ সরিয়ে ফেলে। শ্মশানে আসা স্বজনহারা মানুষগুলোর চোখের দিকে তাকিয়ে যেন নিজের দুঃখগুলো ভুলতে চেষ্টা করে। বাবা বেচেঁ থাকলে হয়তো টুম্পার জীবনটা হয়তো এমন হত না! 

 এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ 

দূর থেকে ভেসে আসে 'বল হরি, হরি বল'। খই ছিটাতে ছিটাতে এগিয়ে আসে মৃত দেহ। ইতস্তত কান্না। খিস্তি খেউড়। মৃতদেহের কাগজপত্র তৈরি করতে। টুম্পা জায়গা ছেড়ে উঠে তৈরি হতে থাকে। মুখে মাস্ক বাঁধেন। দু'হাতে গলিয়ে নেন গ্লাভস। কাঠের চুল্লি রেডি করেন। পুরোহিতের কাজ শেষ হলে। তারপর হা করা চুল্লির মধ্যে ঢুকিয়ে দেন মৃতদেহ। 

আরও পড়ুন- Jaynagarer Moa: নভেম্বর শেষ হতে চললেও জমাটি শীত অধরা! ঘোর চিন্তায় মোয়া ব্যবসায়ীরা

Purandarpur crematorium in Baruipur: বারুইপুর পুরন্দরপুর শ্মশান
এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।

এরপর ৪৫মিনিট ব্যস্ততা থাকে না টুম্পার। বাকি কাজ আগুনের। এরকম ভাবেই আগুন আস্তে আস্তে পুড়ে শেষ হয় মানব শরীর। টুম্পা অপেক্ষায় থাকে অস্থি বের করে আনার। এই মৃতদেহটি হয়তো কারো, মা কিংবা বাবা হয়তো ভাই বোন! টুম্পারও হয়তো তার বাবার কথা মনে পড়ে। বুকের ভিতরে মোচড়ে ওঠে। এই শ্মশানেই তো সব শেষ হয়েছে। হাজার কাকুতি মিনতি করেও এখান থেকে কেউকে ফেরানো আর যায় না। টুম্পা বন্ধু হয়ে থাকে শেষ শেষ যাত্রার মানুষটির।

Women Dom Tumpa Das Baruipur News South 24 Pgs
Advertisment