RG Kar Protest: আরজি কর কাণ্ডের পর রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বাসা বেঁধে থাকা দুষ্টচক্রের নানা কুকীর্তি সামনে আসছে। যা জেনে এই বাংলার আর পাঁচটা সাধারণ নাগরিকের মতোই স্তম্ভিত পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর ব্লকের পাঁচড়া গ্রামের বাসিন্দারা। তাঁরা এখন আশঙ্কা করছেন, হয়তো এমনই কোনও দুষ্টচক্রের শিকার হয়ে 'কোমায়' চলে যেতে হয়েছে তাঁদের গ্রামের শতাব্দী প্রাচীন হৈমাবতি দাতব্য চিকিৎসালয়কে। পাঁচড়া গ্রামের মানুষজন আরজি করের নির্যাতিতার খুনের ন্যায় বিচারের দাবির সঙ্গেই এখন 'জাস্টিস ফর হৈমাবতি হাসপাতাল' স্লোগান তুলে আন্দোলনে নেমে পড়েছেন। আন্দোলনে শান দিতে তাঁরা হৈমাবতি হাসপাতালেই বসিয়েছেন 'অভয়া ক্লিনিক'।
এলাকাবাসীর কথায়, “১০৭ বছর আগে দেশ তখন পরাধীন। ওই সময়ে পাঁচড়া গ্রাম তো দূরের কথা, গোটা জামালপুর ব্লকের কোথাও তখন কোনও হাসপাতাল ছিল না। এমনকী বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালও তখন গড়ে ওঠেনি। ওই সময় চিকিৎসার অভাবে সামান্য রোগ ব্যাধিতেই মারা যেতেন এলাকার মানুষজন। এই বিষয়টি পাঁচড়া গ্রামের পশ্চিম পাড়ার বাসিন্দা মানবদরদী বধূ হৈমবতী মুখোপাধ্যায়কে ভীষণভাবে ব্যথিত করে।
এর পরেই হৈমাতিদেবী একটি হাসপাতাল গড়ার ব্যাপারে উদ্যোগী হন। এর জন্যে তিনি পাঁচড়া গ্রামে থাকা নিজের বেশ কয়েক বিঘা জমি দান করেন। সেই জমিতে গড়ে ওঠে হাসপাতাল ভবন। যেহেতু সর্বসাধারণের জন্য হাসপাতাল গড়ার ব্যাপারে হৈমাবতিদেবী উদ্যোগী হয়েছিলেন, তাই হাসপাতালটির নাম রাখা হয় 'হৈমাবতি দাতব্য চিকিৎসালয়'। ১৯১৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর ব্রিটিশ রাজত্বে তৎকালীন বর্ধমানের ডিভিশনাল কমিশনার ডি. এইচ .লিস (D.H. Lees) হৈমাবতী দাতব্য চিকিৎসালয়টির উদ্বোধন করেন।
পাঁচড়া গ্রামের বাসিন্দা তথা প্রবীণ আইনজীবী রবিশংকর চট্টোপাধ্যায় বলেন, “বাবা ও ঠাকুরদার কাছে শুনেছি, সূচনালগ্নে একাধিক ডাক্তার ও কমপাউন্ডার হৈমাবতি দাতব্য চিকিৎসালয়ে চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার কাজে নিযুক্ত ছিলেন। রোগীদের চিকিৎসালয়ে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থাও তখন ছিল। পাঁচড়া গ্রাম ছাড়াও আশপাশের অনেক গ্রামের বহু মানুষজনের চিকিৎসা পরিষেবা পেতে এই চিকিৎসালয়ই ছিল একমাত্র ভরসা।"
বন্ধ চিকিৎসালয়ের বারান্দায় খোলা হয়েছে 'অভয়া ক্লিনিক'। ছবি: প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন- Manik Bhattacharya: প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি, জামিন পেলেন মানিক ভট্টাচার্য
রবিশংকরবাবু আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, "সবার প্রত্যাশা ছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মানোন্নয়ন ঘটবে চিকিৎসালয়টির। কিন্তু তা হয়নি। উল্টে চিকিৎসালয়ের পরিষেবা আরও দুর্বল হতে শুরু করে। অবিভক্ত বর্ধমান জেলা পরিষদ চিকিৎসালয়টি পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পরেও উন্নতি হয়নি। তারই মধ্যে ২০১৭ সালের ৭ এপ্রিল বর্ধমান জেলা ভাগ হয়। পূর্ব বর্ধমান জেলা পরিষদ চিকিৎসালয়টি পরিচালনার দায়িত্ব পায়। তাদের তত্ত্বাবধানে একজন মাত্র চিকিৎসকের উপর নির্ভর করে চলছিল হৈমাবতী দাতব্য চিকিৎসালয়। ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ওই চিকিৎসক অবসর নেন। তার পরেই চিকিৎসকের অভাবে হৈমাবতী দাতব্য চিকিৎসালয়টিতে তালা পড়ে যায়।
আরও পড়ুন- Eastern Rail: অভাবনীয় তৎপরতা ভূয়সী প্রশংসা! রেলের! যাত্রী স্বার্থে এমন তাকলাগানো উদ্যোগের
পাঁচড়া গ্রামের অপর বাসিন্দা বুদ্ধদেব নন্দী ও শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়’রা বলেন, "হৈমাবতি হাসপাতালটিকে হেরিটেজ হাসপাতালের মর্যাদা দিয়ে আরও উন্নত করা উচিত ছিল। কিন্তু প্রশাসন বা স্বাস্থ্য দফতর কেউ তা করেনি। বরং জুটেছে শুধু অবহেলা। দুয়ারে হাসপাতাল থাকতেও নেই। চিকিৎসা পরিষেবা পেতে পাঁচড়া সহ আশেপাশের ২০-২৫ টি গ্রামের বাসিন্দাকে এখন দূরের হাসপাতালে যেতে হচ্ছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না। তাই শুরু হয়েছে আন্দোলন।"
অপর বাসিন্দা মিরাজুল মল্লিক, জগবন্ধু ঘোষরা বলেন, "আরজি কর হাসপাতালে কর্তব্যরত মহিলা ডাক্তারকে নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা ঘটেছে। তারপর পরই সামনে এসেছে বাংলার স্বাস্থ্য দফতরে বাসা বেঁধে থাকা দুষ্টচক্রের নানা কুকীর্তি। যে সব কীর্তির নায়কদের কয়েকজনকে সিবিআই ইতিমধ্যেই জালে পুরেছে। আরও কয়েকজনকেও হয়তো যেতে হতে পারে সিবিআইয়ের শ্রীঘরে। আমাদের মনে হয়েছে পাঁচড়া গ্রামে থাকা শতাব্দী প্রাচীন একটা হাসপাতালের ফটকে তালা পরিয়ে দেওয়ার নেপথ্যেও এই রকমই কোনও দুষ্টচক্রের হাত রয়েছে। তাই অভয়াকে খুনের ঘটনায় ন্যায় বিচারের দাবিতে আমরা গ্রামের সবাই গলা মেলাচ্ছি। বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা হৈমাবতি দাতব্য চিকিৎসালয়ের দুয়ারেই আমরা 'অভয়া ক্লিনিক' বসিয়েছি।"
আরও পড়ুন- RG Kar Case: আরজি কর কাণ্ডে আগুনে প্রতিবাদ, কৌশলী তৃণমূল, ড্যামেজ কন্ট্রোলে 'মাস্টারপ্ল্যান'!
হৈমাবতি চিকিৎসালয়ের দেওয়ালের চারপাশে সাঁটানো 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস ফর হৈমাবতি হাসপাতাল’। এই দাবির পক্ষে দাঁড়িয়ে গলা চড়াতে পিছুপা হননি পাঁচড়া গ্রামনিবাসী সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধা রেখা চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, "পাঁচড়া গ্রামের বধূ হয়ে আসার পর আমি হৈমাবতি দাতব্য চিকিৎসালয়ের রমরমা দেখেছি। বহু মানুষ এই হাসপাতালে চিকিৎসা পরিষেবা পেতেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য সেই হাসপাতাল আজ তালা বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। হাসপাতালের ডাক্তারবাবু ও স্বাস্থ্য কর্মীদের থাকার কোয়াটার রুমও ভগ্নপ্রায়।"
এই বিষয়ে জামালপুরের বিধায়ক আলক মাঝি বলেন, “হৈমাবতি দাতব্য চিকিৎসায়টিকে কি ভাবে পুনরুজ্জীবিত করা যায় সেই বিষয়ে আমি চেষ্টা করব। প্রয়োজনে স্বাস্থ্য দফতরেও কথা বলবো। জেলাপরিষদ সভাধিপতি (পূর্ব বর্ধমান) শ্যামাপ্রসন্ন লোহার বলেন, "আমি হাসপাতালটির ব্যাপারে খোঁজ খবর নেব। কী করা যায় সেটা দেখব।"