/indian-express-bangla/media/media_files/2025/10/24/cover-photo-1-2025-10-24-11-39-00.jpg)
Mail carrier: দুর্গম পাহাড়ি পথ পেরিয়ে খবরের বোঝা কাঁধে চলেছেন 'রানার'! এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।
'রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে'...ঝোলায় খবরের বোঝা, পায়ে ঘুঙুর, হাতে লন্ঠন, সঙ্গে বল্লম আর সেই সঙ্গে অদম্য এক সাহস। পাহাড়ের দুর্গম আকাবাঁকা পথ পেরিয়ে চিঠি নিয়ে যেত ডাকহরকরা বা ডাকপিয়ন। এই ডাকহরকরারা অযোধ্যা পাহাড়ে পরিচিত রানার নামে। কালীপদ মুড়া, অনাথ সিংদের সঙ্গে কাজ করা ভোঁদু গোপই এখন কর্মরত শেষ রানার। এখনও খবরের ঝোলা ব্যাগ নিয়ে অযোধ্যা পাহাড়ের জঙ্গল ঘেরা পথে ডাক নিয়ে যায় ভোঁদু।
শেষ রানারের সঙ্গে দেখা করতে আমরা সাতসকালে অযোধ্যার বাঘমুন্ডিতে হাজির হই। ডাকপিয়ন বছর আটান্নর ভোঁদু গোপের পরিচিতি বাঘমুন্ডি-অযোধ্যাজুড়ে। এখন তাঁর পোশাকি পদ অ্যাসিস্ট্যান্ট ব্রাঞ্চ পোস্ট মাস্টার। যথারীতি সটান ভোঁদু গোপের বুরুকুলি পাড়ার বাড়িতে হাজির হয়ে যাই। বাড়ির উঠোনের ওপর খাটিয়ায় বসে ভোঁদু গোপ শোনালেন তাঁর দীর্ঘ কর্ম জীবনের অভিজ্ঞতার কাহিনী। বহু বছর আগে তাঁর বাবা আবাস যোজনায় ঘর পেয়েছেন। কিন্তু বাড়িতে শৌচাগার নেই। ভোঁদুর স্ত্রী জঙ্গল থেকে কাঠ সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। "দু'জনের রোজগারে কোনও রকমে সংসারের হাঁড়ি চড়ে," বললেন ভোঁদু। তবে অযোধ্যার শেষ রানার বলে গর্ব বোধ করেন ভোঁদু।
/filters:format(webp)/indian-express-bangla/media/media_files/2025/10/24/inline-photo-1-2025-10-24-11-40-31.jpg)
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে ভোঁদু গোপ বলেন, "বাবা রানারের কাজ করতেন। তাঁর কাছ থেকেই শেখা। ১৯৮১ সাল থেকে আমি রানারের কাজ করে চলেছি। কালীপদ মুড়া ও অনাথ সিং সর্দারের সঙ্গে কাজ করেছি। আমরা তিনজন ছিলাম এই অযোধ্যা-বাঘমুন্ডির শেষ রানার। এখন একমাত্র আমিই হলাম কর্তব্যরত। শেষ রানার হিসাবে পরিচিতি পেয়ে আমি বেশ গর্ব বোধ করি। উচ্চপদে না থাকতে পারি, চুক্তি ভিত্তিক কর্মী, কিন্তু আমার রানার পরিচিতিতে এক ডাকে সবাই আমাকে চেনে।"
রাণার ভোঁদু গোপের ঝুলিতে রয়েছে জঙ্গলপথের নানা অভিজ্ঞতা। ঘন জঙ্গলের কয়েক কিলোমিটার পথ আমরাও তাঁর সঙ্গে শামিল হয়েছি। জঙ্গলে নিদেনপক্ষে সাপের ভয়ও তো আছে। কিন্তু রোজকার সেই দুর্গম পথও ভোঁদু গোপের অতি পরিচিত। রানার বলেন, "দুর্গম জঙ্গলে যাতায়াত করতে গিয়ে বহুবার ভাল্লুকের মুখোমুখি হয়েছি। হাতির পালের সামনে পড়েছি। কৌশল করে তা এড়িয়ে গিয়েছি। এছাড়া আরও নানা বন্য জন্তুর বাধা পেরিয়েছি। তবু ডাক বয়েছি। হাতের বল্লমই তখন আত্মরক্ষার একমাত্র ভরসা। একটা সময় পায়ে ঘুঙুরও পড়তে হত। মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছি দরকারি চিঠি, নানা নথি, চাকরির নিয়োগপত্র। এখন তো ব্যাংক সহ নানা দরকারি নথি আমাদের হাত দিয়েই মানুষের কাছে পৌঁছায়।"
/filters:format(webp)/indian-express-bangla/media/media_files/2025/10/24/inline-photo-2-2025-10-24-11-41-37.jpg)
শেষ রানার বলে আলাদা পরিচিতি রয়েছে ভোঁদুর। তবে এখনও সে ডাক বিভাগের চুক্তিভিত্তিক কর্মী। সংসারের হাল কেমন? এই প্রশ্ন শুনে রানারের মুখ শুকিয়ে যায়। আমতা আমতা করে ভোঁদু বলেন, "সংসার আর চলে কোথায়?" তাঁর মুখ থেকে কথা কেড়ে স্ত্রী ননীবালা গোপ বলেন, "খুব কষ্টে সংসার চলছে। শুধু ওই রোজগারে আমাদের সংসার চলে না। আমি রোজ জঙ্গলে যাই। সেখানে কাঠ কুড়োই। সেই কাঠ মাথায় বয়ে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে বাজারে যাই। সেখানে ওই কাঠ বিক্রি করে যে টাকা পাই তা দিয়ে চাল, ডাল, তেল, নুন কিনে আসি। দু'জনের রোজগারে কোনও রকমে সংসার চলছে।" "চার মেয়ের মধ্যে তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এক মেয়ে বিবাহযোগ্য ও একমাত্র ছেলে পড়াশোনা করে। আবাস যোজনায় কোনও রকমে একটা বাড়ি বাবা পেয়েছিল। তাতেই বসবাস করি।" বলেন, রানার ভোঁদু।
আরও পড়ুন- Kolkata Metro:কলকাতার প্রাণের পাতালরেল, মেট্রো আজও শহরের অহঙ্কার! জন্মদিনে ফিরে দেখা সোনালী অতীত!
বাড়ি থেকে বেরিয়ে সকাল ১০টার মধ্যে বাঘমুন্ডি উপ-ডাকঘরে হাজির হয়ে যান ভোঁদু গোপ। তারপর সেখানে ডাকের থলি নিয়ে আরেক গন্তব্যের দিকে পাড়ি দেন। আগে পুরোটাই হাঁটতে হত, এখন কিছুটা পথ সাইকেল যান। তারপর পাহাড়ের শর্ট রুট জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ছুঁটতে থাকেন ভোঁদু। তুর্গা জলপ্রপাতের কাছে গিয়ে ডাক বিনিময় করেন আরেক ডাক পিয়নের সঙ্গে। দীর্ঘ বছরের পেশা এখন পুরদস্তুর নেশায় পরিণত হয়েছে। ভোঁদুর কথায়, "ডাকবিভাগে বহু লোক কাজ করে। কিন্তু সকলে আমাকে চেনেন। শেষ রানার হিসাবে আমাকে সবাই মনে রাখবে। এটাই আমরা বাড়তি পাওনা।"
/filters:format(webp)/indian-express-bangla/media/media_files/2025/10/24/inline-photo-3-2025-10-24-11-42-21.jpg)
রানার ভোঁদুর আক্ষেপ সংসারের কষ্ট আর ঘুচলো না। বহু কষ্টে এখনও সংসার টানতে হয়। সকালে মার-ভাত খেয়েও কাটাতে হয়। তাছাড়া জঙ্গলের কাঠ সংগ্রহ আছে। ভোঁদুর স্ত্রীর চোখ তখন ছলছল অথচ জীবনযুদ্ধের লড়াইয়ের মনোভাব অটল। আপনার স্বামী রানার। ডাক হরকরা। যে রোজগার মাসে হয় তাতে কী আপনাদের সংসার চলে? এই প্রশ্ন শোনামাত্রই ঠোঁটের ডগায় জবাব লেগেই ছিল ভোঁদুপত্নীর।
আরও পড়ুন- Travel:পাহাড়ের কোলে শান্তির নীড়, প্রকৃতি প্রেমীদের 'স্বর্গরাজ্য' পাহাড়ি এই প্রান্ত
তিনি বলেন, "না তাতে সংসার চলে না। কেন না জঙ্গলে যাই সেখান থেকে কাঠ বয়ে নিয়ে আসি, তা বিক্রি করি, সেই টাকাতেই আমার সংসার চলে। এভাবেই চলছে আমাদের জীবনসংগ্রাম, বেঁচে থাকার লড়াই। ঝড় হোক, বৃষ্টি হোক তাও আমাদের জঙ্গলে যেতেই হবে।" এরপর তিনি যোগ করেন, "উনি যেটা কাজ করেন মানুষের স্বার্থে। জঙ্গলের মানুষ উপকার পান। এত মানুষের জন্য করেন তবু অসহায় অবস্থায় রয়ে গিয়েছি।" কাজের নেশায় কখনও কর্তৃপক্ষকে জোরালো ভাবে বলে উঠতে পারেনি ভোঁদু।
কীভাবে রানারের কাজে যুক্ত হলেন? ভোঁদু বলেন, "এর আগে আমার বাবা রুইটু গোপ রানারের কাজ করতেন। বাবার সঙ্গে আসছি আর কি, বাবাই শিখিয়ে দিয়েছিল এভাবে ডাক নিতে হয়। সেই ১৯৮১ সাল থেকে। একইভাবে চলছে।" হাতে বল্লমটা কীসের জন্য? "বল্লমটা ওই যে বন্য জন্তুদের জন্য। যদি ভাল্লুকের দেখা মেলে। একসময় ভাল্লুকের বেশ ভয় ছিল। বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎও হয়েছে।" হাতি পড়েছে কখনও? "হাতি তো দিনের বেলায় খুব একটা পাওয়া যায় না। সন্ধ্যেবেলায় দেখা হয়।" বলেন ভোঁদু।
/filters:format(webp)/indian-express-bangla/media/media_files/2025/10/24/inline-photo-4-2025-10-24-11-43-25.jpg)
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য রানারের সঙ্গে সাধারণ মানুষের পরিচয় করিয়ে ছিলেন। তাঁর কবিতা রাণারের খ্যাতি জগৎজোড়া। ভোঁদুর দাবি তিনিই শেষ রানার। তাহলে আপনি কি এখানের শেষ রানার? ভোঁদুর জবাব, "হ্যাঁ আমি। এর আগে আরও দু'জন ছিল অযোধ্যা পাহাড়ে। কালীপদ মুড়া ও অনাথ সিং সর্দার। ওঁদের সঙ্গে আমি কাজ করেছি। ওরা দু'জন তো নেই এখন। মারা গিয়েছে। সেই হিসাবে আমিই এখন শেষ রানার। এখনও কাজ করে চলেছি।" বাঘমুন্ডির এই পোস্ট অফিসে চুক্তিভিত্তিক কাজে যুক্ত রয়েছেন মুরলীধর সেন। ১৯৮৮ সাল থেকে তিনি এখানে কাজ করছেন। তিনি বলেন, "কালীপদ মুড়া, অনাথ সিং সর্দার ও ভোঁদু গোপ, এই তিন রানারকে কাছ থেকে দেখেছি। এখনও কাজ করছে ভোঁদু গোপ।" সহকর্মী ভোঁদু গোপের কাজের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন মুরলীধর।
আরও পড়ুন-Bengali sweets: রসগোল্লা থেকে মোয়া, বাংলার মিষ্টির মাধুর্যে জড়িয়ে স্বর্ণালী এক ইতিহাস!
/filters:format(webp)/indian-express-bangla/media/media_files/2025/10/24/inline-photo-5-2025-10-24-11-44-54.jpg)
ভোঁদু গোপের আর্থিক অনটন আছে। টানাটানির সংসার। তবে একটা গর্ববোধও আছে। অনেক অনেক বড় আধিকারিক থাকলেও তিনি শেষ রানার। পাশাপাশি তাঁর সরাসরি পরিচয় অন্যদের থেকে অনেক বেশি। এই অনুভূতি তাঁর কাছে স্বর্গসুখের সমান। আপনি শেষ রানার, এই অনুভূতিটা কেমন লাগছে? ভোঁদু বলেন, "অযোধ্যা পাহাড়ের সবার সঙ্গে আমার পরিচয় রয়েছে। মানুষ আমার জন্য অপেক্ষা করছে। এই ঝোলায় সব চিঠিপত্র থাকে মানুষের। কারও মনে করুন চাকরি হবে। অ্যাপয়েনমেন্ট লেটারের জন্য অপেক্ষায় আছে, আজকে সকালে এলে কালকে জয়েন করবে। এইভাবে মানুষ আশায় থাকে কবে আসবে আমার চিঠিটা।"
একসময়ের গ্রামীণ ডাক সেবক মেইল ক্যারিয়ার, এখন পোস্ট হয়েছে অ্যাসিস্ট্যান্ট ব্রাঞ্চ পোস্ট মাস্টার। ৬৫ বছরে অবসর। ডাকপিয়ন কনফিডেন্ট- "ভোঁদু গোপ হিলটপের এক নম্বর প্লেয়ার।"
/indian-express-bangla/media/agency_attachments/2024-07-23t122310686z-short.webp)
Follow Us