Motivational Story: নিজের হাতে তিল তিল করে গড়ে তোলা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের আসনে বিশ্বনাথ নারু। এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।
apart from running a fish business Bishwanath Naru of Kolkata runs a school: শিক্ষার প্রসারে এই লড়াইয়ের গল্প আপনাকে অনুপ্রাণিত করবেই। এই কাহিনী যে কোনও মানুষের মন ভালো করে দেবে অনায়াসে। একদিকে যখন সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সরকারি বা সরকারি পোষিত স্কুল-কলেজে নিয়মিত হারে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা কমছে। ঠিক এই পরিস্থিতিতে এক মাছ বিক্রেতার শিক্ষা প্রসারের অনবদ্য লড়াইকে কুর্নিশ জানাচ্ছে সারা বাংলা।
Advertisment
ভোরে উঠে বিক্রি করার জন্য পাইকরি বাজার থেকে মাছ কেনা, তারপর বাজারে বসে হাঁকাহাঁকি করে সেই মাছ বিক্রি করা। বড় আঁশ-বটি নিয়ে একের পর এক ১০-১২ কেজি ওজনের কাতলা কেটেই চলেছেন। হাড়ভাঙা খাটুনি আর কি! না...তাঁর যেন কোনও বিরাম নেই। অনবরত পরিশ্রম করেই চলেছেন একাত্তরের 'যুবক'। কিন্তু ১১টা বাজলেই আর মন বসে না মাছ-বাজারে। তখন মাছ বিক্রেতার চোখের সামনে ভাসতে থাকে স্কুলের কঁচিকাচাদের মুখ। বাড়ি গিয়ে তড়িঘড়ি তৈরি হয়েই ছোটেন নন্দীপুরের স্বামী বিবেকানন্দ বিদ্যামন্দিরে। তখন তাঁর অস্থির মন প্রশান্ত হয়। ৭১ বছরের 'যুবক' বিশ্বনাথ নারু ৫১ বছর ধরে এই রুটিনেই চলেছেন। তিনি ওই খুদেদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক।
দমদম পার্ক বাজারে গিয়ে দেখা মিলল শিক্ষক বিশ্বনাথ নারুর। তখন অবশ্য তিনি মাছ কাটায় ব্যস্ত ছিলেন। ওজন করছেন, দাম নিয়ে চলছে ক্রেতাদের সঙ্গে দরাদরি। একেবারে পুরোদস্তুর মাছ বিক্রেতা। তিনিই আবার সারাদিন একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদের গুরুদায়িত্ব সামলান। শ্যামনগরের নন্দীপুরের বিবেকানন্দ বিদ্যামন্দিরের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৭৪ সালের ৭ জানুয়ারি। এ যেন বাস্তবেই বিদ্যার মন্দির। বিশ্বনাথ নারু ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে গত ৫১ বছরের লড়াইয়ের কথা বললেন। তাঁর লড়াই এখনও চলছে। এই স্কুল যেন তাঁর আরেকটা হৃদপিন্ড।
বাজারে তখন তিনি পুরোদস্তুর একজন মাছ ব্যবসায়ী। এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।
কীভাবে শুরু এই স্কুল? বিশ্বনাথ নারু বলেন, "আমি নিজে পড়াশোনা সম্পূর্ণ করতে পারিনি। পারিবারিক কারণে বিএসসি প্রথম বর্ষ পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পেরেছি। সেই থেকে মাছের কারবারও শুরু। কিন্তু স্থানীয় এলাকায় ছোটদের শিক্ষার ব্যবস্থা কীভাবে করা যায় তা নিয়ে উদ্বেগে ছিলাম। শেষমেশ বহু প্রচেষ্টার পর ১৯৭৪ সালের ৭ জানুয়ারি ২৩১ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। সেই থেকেই আমার জীবন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে এই স্কুলের সঙ্গে। এই স্কুল আমার হৃদয়। এখানে না এলে, শিশুদের না দেখতে পেলে মন অস্থির হয়ে ওঠে।"
মাছ বিক্রির ব্যস্ততায়। এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।
এখন স্কুল দোতলা হয়েছে। স্মার্ট ক্লাসেরও ব্যবস্থা আছে। চলছে কম্পিউটার শিক্ষা। বহু আবেদন-নিবেদন সত্ত্বেও এই স্কুল সরকার অধিগ্রহণ করেনি। "সরকারি অনুমোদনের জন্য বহু চেষ্টা করেছিলাম", বলেন বিশ্বনাথ বাবু। কিন্তু নানা কারণে তা হয়নি। তবে তা নিয়ে এখন আর কোনও আক্ষেপ নেই এই লড়াকু শিক্ষকের। এখন তো রাজ্যের হাজার হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীর অভাবে ধুঁকছে বহু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ে ৭০-৮০ জন ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে।
শুরুর সময়টায় কেমন ছিল এই স্কুল? বিশ্বনাথ নারু বলেন, "এই স্কুল প্রথমে ছিল টালির চাল, ছিটে বেড়া। মেঝে ছিল মাটিতে ইঁট পাতা। এই স্কুল থেকে বহু ছাত্র-ছাত্রী জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। মোড়ায় বসতেন শিক্ষকরা, খেঁজুর পাতার চাটাই, বস্তা পেতে বসতে হত ছাত্র-ছাত্রীদের। এখন বহু মানুষের সহযোগিতায় দোতলা ভবন, চেয়ার টেবিল, স্মার্ট ক্লাস, কম্পিউটার ক্লাস, বিশেষ মাত্রা পেয়েছে আমাদের স্কুল। এখন সীমানায় পাঁচিল দেওয়া বাকি রয়েছে। বিশিষ্ট সমাজসেবী শিরীষ মুখোপাধ্যায় স্কুল তৈরিতে খুব সাহায্য করেছিলেন।"
অঙ্কের শিক্ষক বিশ্বনাথ নারু আরও বলেন, "অনেক আশা নিয়ে স্কুল তৈরি করেছিলাম। বহু চিঠিচাপাটি, যোগাযোগ করেও সরকারি অনুমোদন পায়নি, সেই আক্ষেপ একসময় ছিল। এখন আর কোনও আক্ষেপ নেই। বহু ব্যক্তি ও সমাজসেবী সংস্থার সহযোগিতায় এখন স্কুল ভালোই চলছে। আমার আত্মীয়-স্বজনের কাছে কথা শুনতে হয় ব্যবসা আর স্কুল নিয়ে আমি থেকে গেলাম। যতদিন আমার শরীর দেবে ততদিন এই স্কুলে নিয়ে আমি থাকব।"