ব্যক্তিগত জীবনের শোক সব মানুষকেই চূর্ণ করে দেয়। কিন্তু সব ধরনের মানসিক আঘাত কাটিয়ে আবারও ঘুরে দাঁড়াতে হয়। অভিনেত্রী অনিন্দিতা সরকার তাঁর অদম্য জীবনীশক্তি দিয়ে জয় করেছেন ডিপ্রেশনকে। ৯ মাসের মধ্যে একে একে হারিয়েছেন দাদা, বাবা ও মা-কে। কিশোরী বয়সের সেই আঘাত, সেই ক্ষত কখনও পুরোপুরি সেরে ওঠার নয়।
''আমি তখন স্কুলে পড়ি। আমার মেজদা চাকরি করতেন কলকাতার বাইরে। হঠাৎ জুলাই মাসে ধরা পড়ল ডায়বিটিস। দুটো কিডনিই তখন ড্যামেজ হয়ে গিয়েছে। ট্রান্সপ্লান্ট করার মতো অবস্থাও নেই'', বলে চলেন অনিন্দিতা, ''অক্টোবরে দাদা মারা গেলেন। তখন তাঁর একটা ছোট ছেলে রয়েছে। ওই দাদাই আমার বাবার মতো ছিল কারণ আমি বাবা-মায়ের একটু পরের দিকের সন্তান। ছোট দাদার থেকেই আমি ১৩ বছরের ছোট। মেজদা চলে যাওয়ার পরে ঠিক পরেই বাবার গলায় ক্যানসার ধরা পড়ল। অক্টোবরে দাদা আর তার পরে ডিসেম্বরে বাবা চলে গেলেন। মা এই শোকটা নিতে পারেনি। তার পরের বছর জুন মাসে মা মারা গেল। ৯ মাসের মধ্যে পরিবারে ৩টে মৃত্যু!''
আরও পড়ুন: ”আমি শান্তি চাই, কাশ্মীর থেকে অশান্তির বাতাবরণ দূর হোক”
পারিবারিক সচ্ছ্বলতা ছিল কিন্তু প্রবলভাবে যদি কোনও কিছুর অভাব থেকে থাকে ওই সময়ে তবে তা নিরাপত্তা। অসম্ভব শূন্যতা তাঁর মনের মধ্যে চেপে বসেছিল। পর পর তিন প্রিয়জনকে হারিয়ে মানসিক ভাবে এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন অভিনেত্রী যে ঘুমের ওষুধের আশ্রয় নিতে হয়েছিল। ''এমন হয়েছে যে আমি কোচিং ক্লাসে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। তার পরে স্যার যখন ডেকে তুললেন, আমার বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল বুঝতে যে আমি আসলে কোথায় আছি। এই শূন্যতা যাকে ফেস করতে হয় সেই জানে। এমনও হয়েছে যে আমি বাড়িতে ভাঙচুর করেছি। কিন্তু একটা সময় পর ঠিক করলাম যে না, এটা থেকে বেরতে হবে'', বলেন অনিন্দিতা।
আরও পড়ুন: টেলিপর্দায় ডান্স শো নিয়ে ফিরছেন মিঠুনদা
এই শূন্যতা নিয়েই ২০১০ সালে টেলিজগতে পা রেখেছিলেন অনিন্দিতা 'সাত পাকে বাঁধা' ধারাবাহিক দিয়ে। ওই ধারাবাহিকে তাঁর নেগেটিভ চরিত্রটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। তার পরেই 'বয়েই গেল' ধারাবাহিকে অত্যন্ত পজিটিভ একটি চরিত্র। 'ভালবাসা ডট কম', 'আমার দুর্গা', 'ভুতু', 'কিরণমালা', 'দুর্গা', 'সোনারপুর লোকাল'-- অভিনেত্রী অনিন্দিতার পেশাগত জীবন যত এগিয়েছে, ততই আরও বেশি করে তাঁকে লড়াই করতে হয়েছে নিজের ডিপ্রেশনের সঙ্গে।
আরও পড়ুন: ”পার্নো কোন রাজনৈতিক দলের অংশ তার সঙ্গে ছবিটার কোনও সম্পর্ক নেই”
''একটা সময় ঠিক করেছিলাম যে আমি আর ঘুমের ওষুধ খাব না। জেগে থেকেছি রাতের পর রাত, মুড সুইং হয়েছে। ওই সময় মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়েছি। পরে আবারও যখন ডিপ্রেশনটা বাড়ে আমার কাউন্সেলিং করতেন ঝুমা বসাক। আমি ওঁর সেশনগুলোতে শুধুই গল্প করেছি'', বলেন অনিন্দিতা, ''ঝুমাদি বার বার একটা কথাই বলতেন যে তোমার এত মনের জোর, তোমার কোনও ওষুধের দরকার নেই। আস্তে আস্তে রিকভার করতে থাকি। নিজেকে প্রত্যেকটা স্টেপে এক্সপ্লোর করেছি। বাবা-মা আর মেজদা মারা যাওয়ার ১১ বছর পরে বড়দা অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান। তার চারদিন পরে ইংল্যান্ডে বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলনে আমার নাটকের পারফরম্যান্স। কোনও উপায় ছিল না। ওষুধ খেতেই হয়েছিল। কিন্তু তার পরেও সেটাকে আসক্তিতে পরিণত হতে দিইনি।''
আরও পড়ুন: বারো বছর পরে পর্দায় আবার কাজল-অজয় দেবগণ জুটি
ডিপ্রেশন, শূন্যতাবোধ ও নিরাপত্তাহীনতা থেকে বেরিয়ে আসতে অনিন্দিতাকে প্রবলভাবে সাহায্য করেছে মেডিটেশন। কিন্তু ক্ষতগুলো তো রয়েই গিয়েছে। মাঝেমধ্যেই সেগুলো নতুন করে জেগে ওঠে, কষ্ট দেয়। কিন্তু অনিন্দিতা বলেন সেই যন্ত্রণা থেকে নিজেকে আবার বার করে নিয়ে আসতে তিনি শিখে গিয়েছেন। তাঁর কোনও রকম নেশা নেই। যেটা রয়েছে তা বাঁচার নেশা। অনিন্দিতা বলেন, ''জীবনটা অনেক বেশি দামি। ভালর পরে খারাপ, খারাপের পরে ভাল।''
টেলিভিশন থেকে আপাতত একটু বিরতি নিয়েছেন অভিনেত্রী। সম্প্রতি ঋত্বিক চক্রবর্তীর বিপরীতে অভিনয় করেছেন অতনু ঘোষের 'বিনি সুতোয়' ছবিতে। সম্ভবত পুজোর আগেই মুক্তি পেতে চলেছে সেই ছবি।