Uttam Kumar: শুধু বাংলাকে ভালোবেসে! 'নায়ক’ সিনেমার পর যা ঘটেছিল উত্তম কুমারের সঙ্গে, তা অনেকেই জানেন না!

Uttam Kumar: উত্তম কুমার – এই নামটা শুধু বাংলা সিনেমার ইতিহাসে নয়, বাঙালির মনের আবেগের জায়গা করে নেওয়া এক চিরন্তন ভালোবাসার নাম। এমন একজন মানুষ, যাঁর হাসি, চোখের চাহনি আর সংলাপ বলার ভঙ্গি দিয়ে হাজারো হৃদয়ে আজও বেচেঁ আছেন।

Uttam Kumar: উত্তম কুমার – এই নামটা শুধু বাংলা সিনেমার ইতিহাসে নয়, বাঙালির মনের আবেগের জায়গা করে নেওয়া এক চিরন্তন ভালোবাসার নাম। এমন একজন মানুষ, যাঁর হাসি, চোখের চাহনি আর সংলাপ বলার ভঙ্গি দিয়ে হাজারো হৃদয়ে আজও বেচেঁ আছেন।

author-image
Shashi Ghosh
New Update
Uttam kuma Untold Story

শুধু বাংলাকে ভালোবেসে! 'নায়ক’ সিনেমার পর যা ঘটেছিল উত্তম কুমারের সঙ্গে, তা অনেকেই জানেন না!

Uttam Kumar: “আমি বিদেশে গিয়ে অভিনয় করে যদি নিজের ভাব প্রকাশই না করতে পারি, তবে সে অভিনয়ের কী মূল্য? আমি বাংলার অভিনেতা, আমার ভাষা, আমার দর্শক, আমার আবেগ—সবই বাংলা।” (দেশ পত্রিকা, ১৯৭০-এর বিশেষ সাক্ষাৎকার)।

Advertisment

চলে গেলেন কাপুর পরিবারের মূল্যবান সদস্য

উত্তম কুমার – এই নামটা শুধু বাংলা সিনেমার ইতিহাসে নয়, বাঙালির মনের আবেগের জায়গা করে নেওয়া এক চিরন্তন ভালোবাসার নাম। এমন একজন মানুষ, যাঁর হাসি, চোখের চাহনি আর সংলাপ বলার ভঙ্গি দিয়ে হাজারো হৃদয়ে আজও বেচেঁ আছেন। অথচ জানেন কি, এক সময় এই মহানায়ককে হলিউড থেকেও ছবির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল? 

হ্যাঁ সত্যিই তাই, বাংলার অভিনেতার হলিউডের ছবির প্রস্তাব পাওয়া মানে এক বিরাট প্রাপ্তি। যদিও উত্তম বাবু সেই প্রস্তাব পেয়েও খুব সহজভাবেই ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। অলস দুপুরে আজও টিভির পর্দায় বাংলার স্বর্ণ যুগের ছবিগুলো ফিরে ফিরে আসে। ঠিক যেমন পুরনো ম্যাগাজিনের পাতা উল্টে বেরিয়ে আসে পুরনো ছবির গল্প, সাক্ষাৎকার। যা মনে দাগ কেটে যায়। 

Advertisment

রোম্যান্স থেকে ধুঁয়াধার অ্যাকশন, সুপারস্টারের 'বাদশাহী' ছবি দেখলে তাজ্জব বনে যাবেন

উত্তম কুমার। এই নামটা শুধু বাংলা সিনেমার ইতিহাসে নয়, বাঙালির মনের গভীরে জায়গা করে নেওয়া এক চিরন্তন ভালোবাসার নাম। বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি মহানায়ক। বাঙালির রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে আছে যার নাম। সেই উত্তম কুমারের জীবনে এমন অনেক অধ্যায় আছে, যা আজও লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে গিয়েছে। তেমনই একটি ঘটনা , হলিউডের ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব। 

uttam Kumar Nayak
উত্তম কুমার – এই নামটা শুধু বাংলা সিনেমার ইতিহাসে নয়, বাঙালির মনের আবেগের জায়গা করে নেওয়া এক চিরন্তন ভালোবাসার নাম

 অবাক করা বিষয় হল, তিনি সেই প্রস্তাব অবলীলায় প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বাংলাকে ভালোবেসে। নিজের কাজের প্রতি, দায়বদ্ধতার প্রতি। এত বছর পরে দাঁড়িয়ে, এই সিদ্ধান্ত কেবল বিস্ময়ই জাগায় না, এক অদ্ভুত গর্বেও মন ভরে যায়, কারণ এ ছিল তাঁর বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি অটল নিষ্ঠার বহিঃপ্রকাশ। 

সত্যজিত এবং 'নায়ক' ছবির হাত ধরে আন্তর্জাতিক দরজায় এসে দাঁড়ায় উত্তম কুমার  

১৯৬৬ সালে সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় ‘নায়ক’ সিনেমা কান (Cannes Film Festival) আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়। এক ভারতীয় তারকার ভিতরে জমতে থাকা অন্তর্জ্বালা ও আত্মসংঘাত নিয়ে নির্মিত এই ছবিতে উত্তম কুমার অরিন্দম মুখার্জি চরিত্রে অভিনয় করে চমক লাগিয়ে দেন দর্শক ও সমালোচকদের। 

ফরাসি চলচ্চিত্রপত্রিকা ‘কায়িয়ে দ্য সিনেমা’-তে লেখা হয়, "উত্তম কুমারের চোখ যেন কথা বলছে, ছুঁয়ে যাচ্ছে মনের প্রতিচ্ছবি—ভাষা না জেনেও তাঁর অভিব্যক্তি দর্শককে স্পর্শ করে।" (ফ্রান্স, ১৯৬৬)

এই অভিনেতার উপনয়নে গিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়, তাঁর 'নিম্নমানের' ছবি হিট হতেই বলেছিলেন, 'কোটি কোটি বাঙালি..'

ঠিক এই সময়েই তাঁর দিকে নজর পড়ে কয়েকজন ইউরোপিয়ান ও আমেরিকান পরিচালকের। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে ঘটনাটি না বললেই নয়, সালটা ১৯৬৭।  হলিউডের এক স্বাধীন প্রযোজক সংস্থা তাঁকে একটি আন্তর্জাতিক ছবির স্ক্রিপ্ট পাঠায়। পরবর্তীতে চলচ্চিত্র সমালোচক নবারুণ বসু তাঁর স্মৃতিচারণে লেখেন—
“উত্তম কুমারের কাছে একটি প্রস্তাব এসেছিল একটি যৌথ প্রযোজনার ছবিতে, যেখানে ভারত, ফ্রান্স ও আমেরিকার শিল্পীরা অংশ নিতেন। স্ক্রিপ্টেও তাঁর চরিত্রটি মূল নায়ক ছিল। কিন্তু উত্তম সেই প্রস্তাব নেননি।”

সহজে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন বাংলার মহানায়ক। যদিও প্রস্তাব ফেরানো হয়েছিল অনেক ভেবেচিন্তেই। তাঁর ভাষায় তিনি বলেছিলে, “ভাষা না বুঝে অভিনয় মানে মনের কথা না বোঝা। আমি অভিনয় করি প্রাণ খুলে কথা বলার জন্য, চোখে-মুখে নিজের অনুভূতি পৌঁছে দেওয়ার জন্য। সেটা যদি না করতে পারি, তবে আমি নিজেই অখুশি থাকব।”

তাঁর এই সিদ্ধান্ত নিছক ভাষাগত সীমাবদ্ধতার কারণে নয়।  যদিও পরে অনেক বিষয় থেকে জানা যায় এ ছিল এক সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের প্রতি তাঁর অঙ্গীকার। উত্তম কুমার বিশ্বাস করতেন, একজন শিল্পীর আসল দায়িত্ব নিজের মাটিকে তুলে ধরা। সেই কাজটাই আমৃত্যু করে গিয়েছেন।

Uttam Kumar.
চোখের চাহনি আর সংলাপ বলার ভঙ্গি দিয়ে হাজারো হৃদয়ে আজও বেচেঁ আছেন।

 

হলিউডকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, আঁকড়ে ধরেছে নিজের বাংলাকে। বাংলা ছবির প্রতি ভালবেসে সে সময় মহানায়ক একের পর এক কালজয়ী সিনেমা করে চলেছেন—‘সন্ন্যাসী রাজা’, ‘চৌরঙ্গী’, ‘সপ্তপদী’, ‘চিড়িয়াখানা’। এক মাসে তিন-চারটি ছবির শ্যুটিং চলত। একদিকে প্রযোজকের দায়, অন্যদিকে কলকাতার দর্শকের অমোঘ টান—এই সব কিছুর ভেতরে বিদেশে গিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে শ্যুটিং করার বিষয়টি তাঁর পক্ষে কার্যত অসম্ভব ছিল।

সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন স্বয়ং সত্যজিৎ, ৩ যুগ আগের স্মৃতির ঝাঁপি উজাড় বিখ্যাত পরিচালকের

যদি উত্তম বাবু হলিউড যেতে রাজি হতেন?

হয়তো বাংলা ছবির  ইতিহাস খানিক বদলে যেত। উত্তম কুমার সেই হলিউড ছবিতে অভিনয় করতেন। তবে হয়তো ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে বাংলা সিনেমার মুকুটে আরেকটা স্বর্ণ পালক গেঁথে যেত। ভারতীয় সিনেমা বিশ্বমঞ্চে শক্ত অবস্থান তৈরি করত। তবে তাঁর সিদ্ধান্ত আজও সম্মান ও অনুপ্রেরণার প্রতীক। বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও দর্শকের প্রতি তাঁর এই অঙ্গীকার তাঁকে শুধু “নায়ক” নয়, মহানায়ক করে তুলেছে।

 উত্তম কুমার প্রমাণ করেছিলেন নিজের শিকড়েই প্রকৃত গৌরব লুকিয়ে থাকে। বিদেশের ডাকে সাড়া না দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন বাংলার দর্শকদের ভালোবাসা নিয়েও সারা বিশ্বে বাংলা ছবিকে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। বাঁচতে চাইলে এভাবেও বাঁচা যায়।

তথ্যসূত্র:
দেশ পত্রিকা, ১৯৭০ (বিশেষ সংখ্যা: উত্তম কুমার সাক্ষাৎকার)
The Statesman, Kolkata Edition, June 1972
আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯৮৫: “চলচ্চিত্রের স্মৃতি ও উত্তম”,  নবারুণ বসু
Uttam Kumar