/indian-express-bangla/media/media_files/2025/10/12/kanika-bandyopadhyay-2025-10-12-05-06-45.jpg)
Kanika Bandyopadhyay: কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়।
Rabindra Sangeet Legend: শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণে এক ঝড়ের বিকেলে ছোট্ট অণিমার জীবন বদলে গেল। বন্ধুদের সঙ্গে আম ও জাম কুড়োতে গিয়ে সে একবাড়ি সামনে পৌঁছলে চোখ পড়ল জানালার দিকে। সাদা চুল, সাদা গোঁফ-দাড়ি আর অদ্ভুত চোখের মানুষটি তাকিয়ে ছিলেন বাইরে। মেয়েটির হঠাৎ হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল; এই তো সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর—যাঁর গান সে সারাক্ষণ গায়।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ
রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাছে গান শুনতে চাইলেন। মেয়েটি গেয়ে উঠল তাঁর একটি গান। রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়ে বললেন, 'ওরে বাবা, তুই এতটা শিখেছিস!' এই প্রথম সাক্ষাতেই কবির কাছ থেকে পেয়েছিল মেয়েটি স্নেহ ও উৎসাহ। সেই বিকেলেই অণিমার নাম বদলে 'কণিকা' রাখা হল। পরবর্তীতে তিনি শান্তিনিকেতনের বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও শিক্ষিকা হিসেবে পরিচিত হন।
আরও পড়ুন- এই ৫ সুস্বাদু খাবার কেবল ভারতেই মেলে, খেতে কিন্তু দুর্দান্ত!
সাহিত্যিক দেবেশ রায় লিখেছেন, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া গান ছিল 'অলৌকিক'। প্রতিটি গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত যেন নতুন সৃষ্টি। তাঁর ছোটবেলার বন্ধু ও প্রশিক্ষকরা তাঁকে উৎসাহিত করতেন, এবং কণিকার প্রতিভা এতটাই প্রখর ছিল যে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বিশেষ নজর দিতেন। 'নটীর পূজা' নাটকের জন্য তিনি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন 'আকবরী মোহর' নামে। পরবর্তীতে কণিকার গান রবীন্দ্রসংগীতকে ভারতীয় সংগীতের মানচিত্রে প্রসারিত করার এক মহান দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন- স্বাদে, গন্ধে খাসা! রবিবারই বানিয়ে ফেলুন মাংসের গরগরা
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১২ অক্টোবর ১৯২৪, বাঁকুড়ার সোনামুখীতে। পিতার নাম সত্যচরণ মুখোপাধ্যায় ও মায়ের নাম অনিলা দেবী। পাঁচ কন্যা ও তিন পুত্রের মধ্যে কণিকা ছিলেন জ্যেষ্ঠ। শৈশবে তিনি শান্তিনিকেতনের আশ্রমে পিতার সঙ্গে এসে ভর্তি হন। তাঁর জীবনের এক কালবৈশাখীর সন্ধ্যায় আম চুরি করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা তাঁর জীবনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত।
আরও পড়ুন- কলকাতার সবচেয়ে সস্তা লাইটের বাজার, দীপাবলির আগেই জমজমাট!
১৯৩৫ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাম বদলে কণিকা রাখেন ডাকনাম হয়ে ওঠে 'মোহর'। শিশু শিল্পী হিসাবে প্রথম মঞ্চে তাঁর আত্মপ্রকাশ শান্তিনিকেতনের শারদোৎসবে। ১৯৪০ সালে তিনি বোলপুরে বেতারে গান করেন, যা তাঁর প্রথম বেতার অনুষ্ঠান। পরবর্তীকালে তিনি কলকাতায় মঞ্চেও রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন।
আরও পড়ুন- কলকাতার এই ঐতিহাসিক মন্দির, আজও হয় জীবন্ত দেবীর আরাধনা!
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম রেকর্ড ১৯৩৮ সালে, আধুনিক গান নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ চাননি, সেই কারণে তিনি আধুনিক গান থেকে সরে এসে রবীন্দ্রসংগীতের দিকে মনোনিবেশ করেন। ১৯৩৮-৩৯ সালে হিন্দুস্তান রেকর্ডের মাধ্যমে তাঁর প্রথম রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। কণিকার গান ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’ সর্বাধিক জনপ্রিয় অর্জন করে। তিনি স্বরবিতান অনুযায়ী এই গানটির মূল সুরে রেকর্ড করেছিলেন।
তিনি শান্তিনিকেতন এবং গীতবিতান সংগীত বিদ্যালয়ে রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষিকা ছিলেন। শাস্ত্রীয় সংগীত, নজরুলগীতি, অতুলপ্রসাদী, ভজন এবং কীর্তনেও ছিলেন পারদর্শী। ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইংল্যান্ড, জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড এবং বাংলাদেশে সংগীতের কারণেই সফর করেছেন। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতের স্মৃতি তাঁর জীবনের অমূল্য অভিজ্ঞতা।
ব্যক্তিজীবনে তিনি খুবই লাজুক ছিলেন। অপরিচিত স্থানে গান গাইতে চাইতেন না। তাঁর আত্মকথা, স্মৃতিকথা ও রেকর্ডগুলো তাঁর জীবনের গল্প তুলে ধরেছে। ১৯৯৩ সালে গৌতম ঘোষ তাঁর জীবনভিত্তিক তথ্যচিত্র 'মোহর' তৈরি করেছিলেন। ১৯৯৪ সালে শেষবার বাংলাদেশ সফর করেন। ১৯৯৯ সালে গীতবিতান ও ২০০০ সালে ‘গোল্ডেন আওয়ার’ রেকর্ড প্রকাশিত হয়।
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ৫ এপ্রিল ২০০০ সালে কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯৩৮ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত মোট ৫৯টি রেকর্ডে তিনি রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেছেন। তিনি আজও রবীন্দ্রসংগীতের অমর কণ্ঠ হিসেবে সমাদৃত।