/indian-express-bangla/media/media_files/2025/08/07/ghoramara-island-2025-08-07-13-05-54.jpg)
এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ
Curse of the sea: বিকেলে মেঘের আড়ালে আকাশে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। নদীতে মাছ ধরার নৌকাদের সারি। লঞ্চঘাটে ঘরে ফেরার শেষ লঞ্চ কাকদ্বীপ থেকে ছেড়ে যাওয়ার জন্যে চলছে তোড়জোড়। খানিকবাদেই সন্ধ্যা নামবে। আকাশে খুচরো মেঘেদের আনাগোনা। হালকা হওয়া গায়ে এসে লাগছে। প্রকৃতি যেন ক্যানভাসে তার রং ঢেলে দিয়েছে। শিল্পীর হাতে আঁকা ছবির কোন দৃশ্য। হুগলি নদীর শেষ প্রান্ত মুড়িগঙ্গা। এই নদী গিয়ে মেশে বঙ্গোপসাগরে। জোয়ারের জলে নদীর বুক চিড়ে এগিয়ে যাচ্ছে নৌকা।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/870b44d9-86f.jpg)
খেয়াঘাটে যখন লঞ্চ এসে ঠেকল। নদীর জল তখন ছুঁয়ে আসছে বাঁধের মাটি। একটু একটু করে ক্ষয়ে যাচ্ছে। তীব্র হয়ে উঠছে জলের শব্দ। ভাঙা বাঁধের ধারে বসে শেফালি করক চুপচাপ নদীর দিকে তাকিয়ে আছেন। নদীর ওপারে আলো জ্বলছে। হলদিয়ার। বছর দেড়েক আগেও ওই জলের মাঝামাঝি জায়গায় ঘর ছিল তাঁর। উঠোনে ধানের গোলা। হাঁস মুরগি। সেই জায়গা আর কোনোদিনই ছুঁতে পারবেন না তিনি। এখানেই স্বামী-সন্তানের হাসি-আনন্দে ভরা সংসার ছিল। এক সন্ধ্যায় উত্তাল জল এসে সব কিছু কেড়ে নিল। কোনো সতর্কবার্তা ছিল না, না ছিল রক্ষা করার সময়।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/feed9838-5a5.jpg)
শেফালি করক ধীরে ধীরে বললেন, "আমাদের নাম জেনে কি হবে নাম? এরকম কতজন শহরের মানুষ আসে আমাদের ভাঙ্গা দ্বীপের গল্প শুনতে! শুধু গল্পটাই শুনে চলে যায়। আমাদের তো নদীই সব কেড়ে নিয়েছে। আমরাও একদিন চলে যাব এই নদীর গর্ভে।", কথা শেষ করেই মুখ ঘুরিয়ে ফেলেন। ঘোড়ামারা দ্বীপ একসময় শুধু সুন্দরবনের গর্বই ছিল না, রাজ্যের ইতিহাসেও তার বিশেষ স্থান ছিল। ব্রিটিশ আমলে এখানে গড়ে উঠেছিল পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় টেলিগ্রাফ অফিস। নদীর বুকে দাঁড়িয়ে থাকা সেই তিনতলা দালান একসময় দূরদূরান্তের সঙ্গে যোগাযোগের কেন্দ্র ছিল। সেই পুরনো জৌলুস আর সেই কোথায়? সবই ক্ষয়ে গিয়েছে। গিলে খেয়েছে নদী।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/28a06391-95d.jpg)
নদীর ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শহরের মানুষের কাছে অপরূপ এক সাহিত্যের অংশ কিংবা গানের কোনও লাইন। ঘোড়ামারার মানুষের কাছে তা আতঙ্কের। এই শব্দ চোখের ঘুম কেড়ে নেয়। মনে হয়, প্রতি নিয়ত ঘাড়ের উপর নিশ্বাস ফেলছে সর্বগ্রাসী নদী। যে কোনও মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়বে সবকিছুর উপর।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/fba0eb23-b7c.jpg)
এখানের বাসিন্দারা সব সময় মাপতে থাকেন নদীর জল কতটা এগিয়েছে! যার চৌকাঠে পৌঁছে যায় জল, তার জন্য এ যেন শেষ সতর্কবার্তা। এবার নদী এটাকেও খাবে। আস্তে আস্তে গিলে খাবে পুরো ঘরটাকে। এখানে জল আর মানুষের বসতির সীমারেখা বদলায় প্রতিদিন। জল যত এগোয়, মানুষ তত সরে যায়। নিয়তির হাতে জীবন সঁপে দিয়ে গৃহস্থেরা শুধু দেখেন, দিন দিন ছোট হয়ে আসছে তাদের বসতির বৃত্ত, আর ভারী হচ্ছে জলের পাল্লা।
আরও পড়ুন- 'কোন আপোষ নয়'! ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের ঘোষণায় সরাসরি হুঙ্কার মোদীর
/indian-express-bangla/media/post_attachments/9af09ee5-228.jpg)
চারপাশে নদী আর সমুদ্রের আলিঙ্গনে ঘোড়ামারা একা পড়ে আছে। জরাজীর্ণ কঙ্কালসার দেহে প্রাণটুকু পড়ে আছে। "ঘোড়ামারা দ্বীপ ২২ হাজার একর বিঘার সম্পত্তি ছিল তা ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে এখন ৭হাজার একর বিঘায় এসে দাঁড়িয়েছে। আমার নিজের বাড়ি ৭ বার ভেঙেছে ভাঙ্গনে। নদী থেকে পিছিয়ে এখন অনেক ভিতরে চলে গিয়েছি। এটা এমন একটা জায়গা যেখানে হিন্দু মুসলিম সবাই একসাথে মিলে মিশে থাকে। শত্রু বলতে নদী।" সন্ধ্যায় মসজিদের নামাজ শেষে বলছিলেন শেখ আফতাবউদ্দিন, ৭৭বছর বয়সী মসজিদের ইমাম।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/6565fc57-f8d.jpg)
এক পাশে বটতলা, মুড়িগঙ্গা, হুগলির স্রোত, অন্য পাশে অগাধ বঙ্গোপসাগর। একসময় সাগরদ্বীপের অংশ ছিল, মাঝখানে ছিল সরু খাল, এখন তা বিস্তীর্ণ নদী। প্রতিদিন জোয়ারে একটু একটু করে ক্ষয়ে যাচ্ছে দ্বীপের শরীর। ভরা কোটালে বাঁধ ভাঙলেই সর্বগ্রাসী জল ভাসিয়ে নেয় ঘর, ফসল, জীবন। কত সংসার এভাবে মুছে গিয়েছে মানচিত্র থেকে, তার কোনও হিসেব নেই। কত লোক যে জমি জায়গা ছেড়ে দেশান্তরী হয়েছে তার হিসেবও রাখতে পারে না। শুধু রয়ে গিয়েছে নদীর গিলে নেওয়া নীরব স্মৃতি।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/a0895da1-975.jpg)
আম্বিয়া খাতুন বিবি, ঘোড়ামারা গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান, তাঁর কথায়, "হয়তো ঘোড়ামারা দ্বীপ হারিয়ে যাবে! আবার থেকেও যেতে পারে। সবটাই নির্ভর করছে প্রকৃতির উপর। এখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের কোনও লড়াই নেই। এখানে মানুষের লড়াই প্রকৃতির সঙ্গে। আমরা চেষ্টা করছি ভাঙ্গন রোধ করার। সরকারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। কিভাবে কতটা বাঁচানো যায়।"
আরও পড়ুন- স্বাধীনতা দিবসের আগে জম্মু-কাশ্মীরে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা, সেনা মৃত্যুর আশঙ্কা, আহত বহু
/indian-express-bangla/media/post_attachments/6fc70abb-924.jpg)
তথ্য ঘাঁটলে যতটুকু জানা যায়, ঘোড়ামারা ছিল প্রায় সাড়ে ৯ বর্গ কিলোমিটার। আজ তা নেমে এসেছে মাত্র সাড়ে ৩ কিলোমিটারে। প্রতিদিন জোয়ারের ধাক্কা, মালবাহী জাহাজের তৈরি ঢেউ আর জলবায়ু পরিবর্তনের আঘাতে দ্বীপটি ক্ষয়ে যাচ্ছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর গড় হারে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বছরে ৩.২৩ মিলিমিটার বাড়লেও ঘোড়ামারায় তা ৮ মিলিমিটার হারে বাড়ছে। এই হারে চলতে থাকলে হয়তো কয়েক দশকের মধ্যেই মানচিত্র থেকে পুরোপুরি হারিয়ে যাবে ঘোড়ামারা।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/c9f3eb64-749.jpg)
ধান আর পান, এই দুই ফসলের জন্যই একসময় গর্ব ছিল ঘোড়ামারার। উর্বর ধানের ক্ষেত আর বরোজে ভরা সবুজ পানলতা যেন এই দ্বীপের পরিচয়পত্র। তাই ভিটেমাটি হারালেও অনেকেই দ্বীপ ছাড়তে রাজি নন। ঘোড়ামারার বাসিন্দা ময়না, ভালো নাম শেখ দিলজান, পেশায় টোটোচালক। নদীর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, "এখানে দিন দিন ঘর খালি হচ্ছে। ছেলেমেয়েদের নিয়ে অনেকেই শহরে চলে যাচ্ছে। আমার বাপ-ঠাকুরদার যত জমি ছিল, সব নদীতে চলে গিয়েছে। বুড়োরা ভিটে আঁকড়ে আছে, কিন্তু নবীনরা থাকতে চায় না। আর থাকবেই বা কেন? এখানে কেউ মেয়ের বিয়ে দিতে চায় না। কবে কার ঘর নদী ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, বলা যায় না। ঘোড়ামারার ছেলেদের কেউ জামাই করতে চায় না, মেয়েদেরও বিয়ে হয় অন্য গ্রামে।"
আরও পড়ুন- 'এক্তিয়ার বহির্ভূত কাজ কমিশনের', রাজ্যের অফিসারদের সাসপেন্ড ইস্যুতে বিস্ফোরক অভিযোগ অভিষেকের
/indian-express-bangla/media/post_attachments/bfaeaa7a-004.jpg)
কাকদ্বীপের লঞ্চ ঘাট থেকে কিছুটা পথ পেরোলেই দেখা মেলে ঘোড়ামারার, আদখাওয়া বিস্কিটের মতো রোজ একটু একটু করে ভাঙছে এই দ্বীপ। একসময় যেখানে ধানের গাছ, পানের বরজ ছিল এখন সেখানে বিস্তীর্ণ জলরাশি। গ্রামের বয়স্করা বলছেন "লোহাচরা, সুপারিভাঙাচরা, এই দ্বীপগুলো আগেই জলের নীচে চলে গিয়েছে। এবার ঘোড়ামারার পালা।" নদীর তোড়ে স্কুল, অফিস, ডাকঘর সবই ডুবেছে। বৃষ্টি হলেই ত্রাণশিবিরই ভরসা। জলবায়ু বদলের ছায়ায় অস্তিত্ব হারানো দ্বীপবাসীরা এখন শুধুই সময়ের অপেক্ষায়। জীবন আর জলের লড়াইয়ে কবে কোনটা হার মানবে, কেউ জানে না।