/indian-express-bangla/media/media_files/2025/08/14/burdwan-2025-08-14-16-19-32.jpg)
Independence Day 2025:ছবির বাঁদিকে ওপরে বীর বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর নামাঙ্কিত ফলক, তার নীচে ভগ্নপ্রায় এই বাড়িতেই বিপ্লবী ভগত সিং ও বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্ত আত্মগোপন করেছিলেন। ছবির ডানদিকে ওপরে বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্তের মূর্তি, তার নীচে স্বাধীনতা সংগ্রামের গর্বের ইতিহাস বহন করে চলা গোপালপুর মুক্তকেশী বিদ্যালয়।
Burdwan revolutionaries India independence:ইংরেজদের শাসন থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট ভারত স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু এই স্বাধীনতা খুব সহজেই আসেনি। দেশ মাতৃকার অনেক বীর সন্তানের আত্মবলিদান ও ত্যাগের মধ্যদিয়েই মিলেছে স্বাধীনতা। দেশের এই স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে পূর্ব বর্ধমান জেলার অনেক বীর সন্তানের নাম।
ভারত মাতাকে ব্রিটিশদের কব্জা থেকে মুক্ত করার শপথ নিয়ে তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বিপ্লবী আন্দোলনে। সেই সব বীর বিপ্লবীদের মধ্যে বটুকেশ্বর দত্ত, রাসবিহারী বোস, রাসবিহারী ঘোষ এবং অনিল বরণ রায়ের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের পাতায়। এরা ছাড়াও অবিভক্ত বর্ধমান জেলার আরও অনেকে বিপ্লবী আছেন যাঁদের অবদান গোটা দেশবাশী আজও স্মরণ করেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পেরিয়ে গিয়েছে ৭৮ বছর। বর্ধমান জেলার স্বাধীনতা সংগ্রামীরা সারাটা বছর একপ্রকার বিস্মৃতির অতলেই রয়ে থাকেন। তবে স্বাধীনতা দিবসে দেশ মাতৃকার জন্য জীবন উৎসর্গ করা জেলার মহান বিপ্লবীদের শ্রদ্ধা জানাতে ভোলেন না দেশভক্ত বর্ধমানবাসী। ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায়, লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ১৯০৫ সালে গোটা ভারতজুড়ে যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল, তার ঢেউ সেই সময় বর্ধমান জেলাতেও আছড়ে পড়েছিল। শুধু শহর বর্ধমানের মানুষজনই নয়, গ্রামীণ বর্ধমানের মানুষজনও সেই সময়ে সামিল হয়েছিলেন বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদ আন্দোলনে।
স্বাধীনতা আন্দোলনকে উদ্বুদ্ধ করেছিল অবিভক্ত বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামের সন্তান কাজী নজরুল ইসলামের দেশাত্মবোধক গান ও কবিতা।
স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ১৯২৫ সালে বর্ধমানে এসে তদানীন্তন বর্ধমানের মহারাজা বিজয় চাঁদের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে ইতিহাসবিদরা মনে করেন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে বর্ধমানের গুরুত্ব কোনও অংশেই কম ছিল না।
আরও পড়ুন- Sundarban:সুন্দরবনে একেবারে তিন তিনটি বাঘের সামনে পর্যটকের দল! পরের ঘটনা জানলে...
স্বদেশী আন্দোলন থেকে শুরু করে বিপ্লবী আন্দোলন, সবেরই উত্তরণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বর্ধমানের বিপ্লবীদের নাম। এই জেলার জ্যোতিন্দ্রনাথ বন্দ্যেপাধ্যায় যৌবনেই বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। পরে অবশ্য তিনি আধ্যাত্মিকতায় মনোনিবেশ করে ’নিরালঙ্গ স্বামী ’নামে পরিচিত হন। ১৮৭৬ সালে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ’ভারত সভা’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । সেই ’ভারত সভার’ তিনটি শাখা গড়ে উঠেছিল অবিভক্ত বর্ধমান জেলার বিভিন্ন প্রান্তে। ওই শাখাগুলি ’বর্ধমান শাখা’, ’কালনা শাখা’ ও ’পূর্বস্থলী হিতকরী সভা’ নামে আত্মপ্রকাশ করে।
কালনার কবিরাজ বংশীয় উপেন্দ্রনাথ সেন ও দেবেন্দ্রনাথ সেনের উদ্যোগে কালনা ও কাটোয়ায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল বঙ্গভঙ্গ বিরোধী সভা। ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায়, সেই সভায় স্বয়ং সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন। কালনা মহকুমা ইতিহাস ও পুরাতত্ব চর্চা কেন্দ্রের সভাপতি সিদ্ধেশ্বর আচার্য্যর দাবি, "স্বদেশী আন্দোলনের ঢেউ সেই সময়ে কালনার বাঘনা পাড়ার যুবক মহলে প্রভাব ফেলেছিল। ১৯০৬ সালে বিদেশি দ্রব্য লুঠ করে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটিয়েছিল কালনার বাঘনা পাড়ার যুবকরা। সেই ঘটনায় ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন কালনার গৌর গোবিন্দ গোস্বামী,মণিগোপাল মুখোপাধ্যায়, সন্তোষ বন্দ্যোপাধ্যায়,বৃন্দাবন গোস্বামী,বলাই গঙ্গোপাধ্যায় ও বলাই দেবনাথ।"
তাঁর আরও দাবি, “এসব দেশ ভক্তদের গ্রেপ্তারি সংক্রান্ত মোকদ্দমাই ছিল বঙ্গে প্রথম রাজনৈতিক মোকদ্দমা। সেই সময়ে বাঘনা পাড়ায় স্বদেশী ভাণ্ডারও প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। ১৯৪২-এ 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনেও বাঘনা পাড়ার যুবকরা যুক্ত হয়েছিলেন।"
জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে উৎসাহিত করার জন্য নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু দু’বার বর্ধমানে এসেছিলেন। ইংরেজ আমলে জাতীয় শিক্ষা নিয়েও বর্ধমান জেলা উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিল । ইংরেজি বিদ্যালয়ের পরিবর্তে জাতীয় বিদ্যালয় তৈরিতে খণ্ডঘোষের তোরকোনার রাসবিহারী ঘোষ টাকা দিয়েছিলেন। কালনা,বর্ধমান সদর, বৈকন্ঠপুর প্রভৃতি স্থানে জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ’বান্ধব সমিতি’ ,’মহামায়া সমিতি’ প্রভৃতি নামে জেলার কালনা,পূর্বস্থলী ও মন্তেশ্বরে বিপ্লববাদী গুপ্তসমিতি গড়ে উঠেছিল। মানকরের জমিদার রাজকৃষ্ণ দিক্ষিত ও দুর্গাপুরের ভোলানাথ রায় সেই সময়ে স্বদেশী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন।
আরও পড়ুন-Jammu kashmir Cloudburst: প্রকৃতির তান্ডবলীলা, মৃত্যুমিছিল...! উপত্যকা জুড়ে শোকের ছায়া
স্বরাজ তহবিলের চাঁদা তোলার জন্যে ১৯২১-২২ সালে চিত্তরঞ্জন দাস বর্ধমানে এসেছিলেন। তাঁর আগমনের পরিপ্রেক্ষিতে বর্ধমান জেলায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ভিন্ন মাত্রা পেয়েছিল। জাতীয়তাবাদী কবিতা লোখার জন্য বর্ধমানের জামালপুরের গোপালপুর গ্রাম নিবাসী গোবিন্দরাম বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্কুল থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল। ১৯২২ সালের ৫ জানুয়ারি এই গোপালপুরের ইংরেজ বিরোধী মানুষজনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা পায় ’গোপালপুর মুক্তকেশী বিদ্যালয়’।
মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে বিদ্যালয়ের প্রথম পরিচালন সমিতি এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত হয়, ইংরেজদের নিয়ম মেনে রবিবার নয় - বিদ্যালয় ছুটি থাকবে সোমবার। সেই থেকে আজও রবিবার পুরোমাত্রায় পঠনপাঠন চালু থাকে গোপালপুর মুক্তকেশী বিদ্যালয়ে। সোমবার এই বিদ্যালয় ছুটি থাকে।
পরাধীন ভারতবর্ষের মাটিতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে ভিন্নমাত্রায় পৌছে দিতে বর্ধমানের মহিলারাও মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন।এই বিষয়ে উল্লেখযোগ্যরা হলেন সুরমা মুখোপাধ্যায় ও নির্মলা সান্যালনাম।১৯৩১ সালে কংগ্রেসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বর্ধমান জেলা কৃষক সমিতি’। তদানিন্তন কালেই কৃষক সমিতির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল।যে সভার সভাপতি হয়েছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত।তাঁর নামেই পরবর্তীকালে বর্দমানের হাটগোবিন্দপুরে গড়ে ওঠে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি মহাবিদ্যালয় ।
আরও পড়ুন- ELECTION COMMISSION: কমিশনের চাপে মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ, দেওয়া হল সাত দিনের আলটিমেটাম
রাজ্যের পঞ্চায়েত মন্ত্রী তথা বর্ধমানের দক্ষিণ দামোদর এলাকার ভূমিপুত্র প্রদীপ মজুমদার বলেন, “দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অবিভক্ত বর্ধমান জেলাবাসীর অবদান কোন অংশেই কম ছিলনা।এই জেলার খণ্ডঘোষের ওঁয়াড়ি গ্রামের বিপ্লবী তথা ভগৎ সিং এর সহযোগী বটুকেশ্বর দত্ত ছাড়াও রায়নার সুবলদহ গ্রামের রাসবিহারী বসু,খণ্ডঘোষের তোড়কনা গ্রামের রাসবিবাহী ঘোষ এবং খণ্ডঘোষের গুইর গ্রামের অনীল বরণ রায়ের নাম আজও দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।এঁনারা ছাড়াও জেলার আরও যাঁরা দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন তাঁদের অবদানও জেলাবাসী মনে রেখেছে।তাই শুক্রবার স্বাধীনতার ৭৯ তম দিবসে কৃষি সমৃদ্ধ এই জেলার বাসিন্দাগণ ও প্রশাসন সকল স্বাধীনতা সংগ্রামীর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে ব্রতী হবেন।"