/indian-express-bangla/media/media_files/2025/10/21/tripura-2025-10-21-10-24-51.jpg)
Diwali festival 2025: ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দিরে কালীপুজোর রাতে ভক্তদের উপচে পড়া ভিড়।
নবকলেবরে নতুন ভবন উদ্বোধন হওয়ার এক মাসের মাথায় ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দিরের ঐতিহ্যবাহী দীপাবলি উৎসব। ৫২৪ বছর পুরনো এই শক্তিপীঠটিতে প্রতিবছর কয়েক লক্ষ সন্ন্যাসী ভক্ত ও দর্শনার্থীদের সমাগম ঘটে দীপাবলি উৎসবে। ত্রিপুরার রাজন্ন ইতিহাস ত্রিপুরার রাজমালায় কথিত আছে, মহাভারতের সম্রাট যুধিষ্ঠিরের রাজ্যভিষেকে অংশ নিয়েছিলেন ত্রিপুররাজ।
ভারতবর্ষের দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন রাজ বংশের মধ্যে একটি ত্রিপুরার মানিক্য রাজবংশ। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হবার পরও গোটা দু'বছর এই রাজ্যটিতে চলেছিল রাজন্য শাসন। অবশেষে ১৯৪৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর মহারানী কাঞ্চন প্রভা দেবী, যিনি '৪৭ সালে ত্রিপুরার শেষ স্বাধীন রাজা বীর বিক্রম কিশোর মানিক্য বাহাদুরের প্রয়াণের পর রাজ্যের শাসনভার সামলাচ্ছিলেন, ভারত সরকারের তৎকালীন উপদেষ্টা ভিপি মেননের সাথে মার্জার চুক্তি অথবা ভারতে অন্তর্ভুক্তিকরনের চুক্তি সই করেন। ১৫ সেপ্টেম্বর সরকারিভাবে ভারতের সাথে মিশে যায় ত্রিপুরা।
তখন ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা। তবে অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই আগরতলায় রাজধানী স্থানান্তরিত হয়ে আসার আগে ত্রিপুরার রাজধানী ছিল উদয়পুর। এই উদয়পুর শহরের অবশ্য আরো একটি নাম ছিল আগে - রাঙ্গামাটি। সরকারি হিসেব অনুযায়ী ৫৯০ খ্রিস্টাব্দে যূযারুফার নেতৃত্বে মগ রাজাদের পরাজিত করে তৎকালীন রাঙ্গামাটি দখল করেন বর্তমান মানিক্য রাজবংশের শাসকেরা।
আরও পড়ুন- West Bengal live news update:কালীপুজোর পর বড়মার মন্দিরে অভিষেক, কুণালের মন্তব্যে চর্চা
১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন সেনাপ্রধান গোপীপ্রসাদ মহারাজ অনন্ত মানিক্যকে খুন করে নিজে উদয় মালিককে নাম নিয়ে রাজ সিংহাসন দখল করেন। একই সঙ্গে রাঙ্গামাটির নাম বদলে উদয়পুর নাম রাখা হয়। সেই থেকে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত উদয়পুরই ছিল রাজন্য ত্রিপুরা রাজধানী। ১৭৬০ সালে মহারাজ কৃষ্ণ মানিক্য উদয়পুর থেকে রাজধানী সরিয়ে পুরাতন আগরতলায় নিয়ে আসেন। পুরাতন আগরতলার সেই পুরানি হাভেলি এখন অবশ্য আর নেই। এক বিধ্বংসী ভূমিকম্পে সেই রাজবাড়ী সহ সমস্ত রাজন্য স্থাপত্য ধ্বংস হয়ে যাবার পর বর্তমান আগরতলা শহরে নতুন করে রাজবাড়ী গড়ে তোলে রাজপাট নিয়ে আসেন মহারাজ কৃষ্ণ কিশোর মানিক্য বাহাদুর (পৃথক আরেকজন রাজা)।
আরও পড়ুন-Fire:কালীপুজোর পরের দিনেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড! দাউদাউ করে আগুনে ভস্মীভূত কারখানা
বর্তমান উজ্জ্যয়ন্ত প্রাসাদ ও তার পার্শ্ববর্তী গোটা প্যালেস কম্পাউন্ডের গড়নটি আরও পরে মহারাজ রাধা কিশোর মানিক্য সময়। কথিত আছে আদি শক্তি অথবা মহামায়ার কাছ থেকে স্বপ্নাদেশ পাবার পর ১৫০১ খ্রিস্টাব্দে উদয়পুরে ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দির গড়ে তোলেন তৎকালীন মহারাজ ধন্যমানিক্য বাহাদুর। বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে দেবী ত্রিপুরা সুন্দরীর মূর্তি এনে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় মন্দিরটি। পরবর্তী সময়ে মন্দির প্রাঙ্গণ সংলগ্ন দিঘী যা কল্যাণসাগর নামে পরিচিত, সেটি খনন করার সময় ছোট্ট অপর একটি কষ্টিপাথরের মূর্তি উদ্ধার করা হয়। সেই মূর্তিটিকে 'ছোটি মা' বলে একই সাথে পূজা করা হয়।
রাজধানী শহর আগরতলা থেকে ৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত এই ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দির ভারতবর্ষের একান্নটি হিন্দু শক্তিপীঠ অথবা সতীপীঠ এর অন্যতম। প্রতিবছর দু লক্ষেরও বেশি ভক্তের সমাগম হয় এই মন্দিরে। ১৯৪৯ সালে ভারতবর্ষের সাথে ত্রিপুরা মিশে যাওয়ার পর থেকে মার্জার চুক্তি অনুযায়ী আগরতলার দুর্গাবাড়ি, খয়েরপুরের চৌদ্দ দেবতা বাড়ি এবং উদয়পুরের ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দিরের যাবতীয় পূজার্চনা এবং ব্যয়ভার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় হয়ে আসছে।
আরও পড়ুন-Crime News: আলোর উৎসবের রাতেই অন্ধকার! বৃদ্ধ বাবাকে পিটিয়ে খুন ছেলের
মন্দির পরিচালনা কমিটির প্রধান হিসেবে থাকেন সেবাইত, যেই পদে এক্স অফিসিউ হিসেবে দায়িত্ব নির্বাহ করে থাকেন স্থানীয় জেলাশাসক। শুধু জাতীয় উপজাতির মধ্যে মেলবন্ধন নয়, বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে ঐক্যেরও চিহ্ন এই ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দির। মানিক্য রাজাদের শাসনকালে স্থানীয় উপজাতি রিয়াং সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের মধ্যে 'জোলাই' বলে পরিচিত প্রথাগত পদাধিকারীরা প্রত্যেক অমাবস্যার রাতে এসে মশাল ধরতেন মায়ের মন্দিরে; হতো মহিষবলি। এখন অবশ্য সরকারি নিয়মানুসারে শাক্তপূজা পদ্ধতি মেনে অমাবস্যার রাতে একটি মহিষ বলি হয় সরকারি খরচে।
রাজন্য আমলে অবশ্য স্থানীয় মুসলমান সম্প্রদায়ের 'মহিষাল' বলে কিছু লোকের ওপর বলির জন্যে নির্দিষ্ট মহিষ লালন পালন করার দায়িত্ব থাকতো। শমসের গাজীর ত্রিপুরা আক্রমণের ইতিহাসের সাথেও জড়িয়ে রয়েছে ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দিরের নাম। কথিত আছে, দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে এক ব্রাহ্মণ পুরোহিতের হাতে পুজো দিয়েছিলেন শমসের। আজও সকল ধর্ম, বর্ণ, জাতি, উপজাতি অংশের মানুষের এক মেলবন্ধনের মুক্তাঞ্চল ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দির।
এই মন্দিরে সাধারণ ভক্তের সমাগম যেমন হয়, তেমনি এখানে ইতিপূর্বে এসেছেন বহু গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব। এসেছেন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি ভিকে কৃষ্ণকান্ত, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহসহ অনেকেই। ২০১৮ সালে ত্রিপুরায় ভারতীয় জনতা পার্টির সরকার প্রতিষ্ঠিত হবার পর প্রথমবার প্রথা ভেঙ্গে কল্যাণসাগরে গঙ্গা পূজা ও গঙ্গা আরতির আয়োজন করা হয়। ৫১ জন পুরোহিত ৫১ টি ঢাক এবং মোমবাতি হাতে অজস্র মহিলা ও পুরুষ ভক্তদের উপস্থিতিতে আয়োজিত হয়েছিল গঙ্গা আরতি। এ বছরও তার পরিবর্তন ঘটেনি।
আরও পড়ুন-বর্গী হানার সাক্ষী ওঁয়াড়ি গ্রামের বড়মা, ৫০০ বছরেও অটুট সম্প্রীতির প্রতীক
মন্দিরের প্রধান পুরোহিত চন্দন চক্রবর্তী জানিয়েছেন, "পরপর তিনদিন একই নিয়মে পুজো হবে। স্থানীয় পূজা পদ্ধতি মেনে মন্দির সংলগ্ন কল্যাণসাগরে পুজো এবং আরতির পর বেনারস থেকে আগত কিছু পুরোহিতরা তাদের নিজস্ব পুজো এবং আরতি অনুষ্ঠিত করবেন। এই মন্দিরের প্রথা অনুযায়ী অমাবস্যার রাতে আরতির পরই দেবীর স্নান এবং পুজো অনুষ্ঠিত হয়।" হাজার হাজার ভক্তের মাঝখানে ঢাক, উলুধ্বনি, শঙ্খ ও ঘন্টাধ্বনির মাঝে আজ সন্ধ্যায় ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দিরে এবছরের দীপাবলি উৎসবের সূচনা করেন মুখ্যমন্ত্রী ড. মানিক সাহা।
তাঁর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন পর্যটন ও পরিবহন মন্ত্রী সুশান্ত চৌধুরী। দীপাবলি উৎসবে যোগ দেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারের মধ্যস্থতায় এবছর উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলওয়ের পক্ষ থেকে আগরতলা থেকে ধর্মনগর এবং আগরতলা থেকে সাব্রুম এই দুটি বিশেষ যাত্রী পরিবাহী ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিন দিনব্যাপী এই দীপাবলি উৎসবের প্রথম দিনেই মন্দির প্রাঙ্গণে বিশেষ ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। এবছরের ২২ শে সেপ্টেম্বর ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দিরের পরিবর্ধিত রূপ উন্মোচন করে গেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
সেই অনুযায়ী ত্রিতল বিশিষ্ট মন্দির প্রাঙ্গনটিতে এখন ৮৬ টি স্টল, মাল্টিপারপাস হল, একাধিক প্রসাদ ঘর, ডরমিটারি, সন্ন্যাসীদের জন্য বাস কক্ষ এবং নাট মন্দির ও মূল মন্দির নিয়ে মোট ১৬৪৫৬ বর্গমিটার এলাকার পরিকাঠামো রয়েছে এখানে। নিরাপত্তার জন্য রয়েছে নিশ্ছিদ্র প্রহরা। গোমতী জেলার পুলিশ সুপার কিরণ কুমার জানিয়েছেন, তিন হাজারেরও বেশি নিরাপত্তারক্ষী, ৩৭ টি সিসিটিভি ক্যামেরা, ১০টি ওয়াচ টাওয়ার, ২৭টি ড্রপ গেট ও নাকা পয়েন্ট ইত্যাদি নিয়ে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে হচ্ছে এবারের দীপাবলী উৎসব।
/indian-express-bangla/media/agency_attachments/2024-07-23t122310686z-short.webp)
Follow Us