Rath Yatra 2025: কলকাতার আড়াইশো বছরের বেশি পুরনো একটা রথ, একটা উঠোন, আর অনেক না-বলা গল্প
Rath Yatra 2025: উত্তর কলকাতার তারকনাথ প্রামাণিক রোডে আজও টিকে আছে ২৫০ বছরের পুরনো পিতলের রথ। একসময় গোটা পাড়ার উৎসব ছিল এই রথযাত্রা, আজ পরিবারের উঠোনেই ফিরে দেখা হয় ইতিহাস। জানুন সেই রথের অজানা গল্প।
Rath Yatra 2025: উত্তর কলকাতার তারকনাথ প্রামাণিক রোডে আজও টিকে আছে ২৫০ বছরের পুরনো পিতলের রথ। একসময় গোটা পাড়ার উৎসব ছিল এই রথযাত্রা, আজ পরিবারের উঠোনেই ফিরে দেখা হয় ইতিহাস। জানুন সেই রথের অজানা গল্প।
কলকাতার আড়াইশো বছরের বেশি পুরনো একটা রথ, আর না বলা কত কথা... Photograph: (এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ)
Rath Yatra 2025:উত্তর কলকাতার পুরনো রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ যেন সময় থেমে যায়। এদিক ওদিক পুরনো দালান বাড়িগুলোর দেয়ালে লেগে থাকে মলিন কালের ছাপ, খসে পড়া কার্নিশ, জং ধরা লোহার রেলিং, আর মরচে খাওয়া বেলকনির ফাঁকে ফাঁকে ফুটে থাকে অতীতের ছবি। ঠিক এমনই এক রাস্তা, তারকনাথ প্রামাণিক রোড। এখানেই রয়েছে এক অমূল্য ঐতিহ্য। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা প্রামাণিক বাড়ি রথযাত্রার দিনে যেন ইতিহাসের পাতা উলটে দেয়। গল্প বলে পুরনো কলকাতার ফেলে আসা দিনের।
Advertisment
এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ
আষাঢ়ের আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা। মাঝে মাঝে বৃষ্টি। বাড়ির সামনে চাতাল স্যাঁতস্যাঁতে। পাড়ার চায়ের দোকান থেকে ভেসে আসছে ৯০'র দশকের গান। বিকেলে চপ ভাজার তোড়জোড় চলছে। বৃষ্টির দিনে এক আলাদা আমেজ। বিশেষ বিশেষ দিনে নতুন প্রাণ পায় প্রামাণিক বাড়ির উঠোন। এরকম একটি বিশেষ দিন রথ যাত্রার আগে। শুরু হয়ে যায় আড়াইশো বছরেরও বেশি পুরনো পিতলের রথ জোড়া লাগানোর তোড়জোড়। খুলে রাখা হাড় পাঁজর সব জড়ো করে একে একে সঠিক জায়গায় ফিট করার কাজ।
এক সময় এই এলাকার অলিগলি দিয়ে প্রায় তিরিশটি রথ ঘুরে বেড়াত, কখনো পিতলের ঝলমলে রথ, কখনো কাঠে লোহার কারুকাজ, তো কখনো রুপোর মতো চকচকে নির্মাণ। আজ অনেক কিছু হারিয়ে গিয়েছে, বদলে গিয়েছে শহরের চালচিত্র। তবে কিছু ঐতিহ্য এখনো বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অতীতকে আঁকড়ে ধরে, ঠিক যেমন দাঁড়িয়ে আছে উত্তর কলকাতার তারকনাথ প্রামাণিক রোডের ২৫০ বছরের পুরোনো এই পিতলের রথ।
Advertisment
এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ
বৃষ্টির জন্যে ফিটিংয়ের কাজ শুরু করতে অনেকটায় দেরি হয়ে গিয়েছে। বাড়ির কনিষ্ঠ সদস্যরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে কাজে। কারও হাতে পিতলের খুঁটি, কারও হাতে অলংকরণের ঝালর। আর তাদের মাথার উপর ছায়ার মতো দাড়িয়ে রয়েছেন বাড়ির প্রবীণ সত্যেন কুমার প্রামাণিক। বয়স আশির উপরে। এখন আর শরীর চলে না, কিন্তু মন তো চায়। তাই তো দোতলার পুরনো খড়খড়ি জানলার ফাঁক দিয়ে তিনি দেখেন রথ তৈরির প্রতিটি ধাপ, ঠিকঠাক হচ্ছে কি না।
এই দোতলা পিতলের রথ, যার উচ্চতা প্রায় ১৪ ফুট আর ওজন ২২ টনের বেশি, এই বাড়িতে এটি শুধুই রথ নয়। এর সাথে জড়িয়ে আছে আবেগ। এক চলমান ইতিহাস। একসময় হুগলির ব্যান্ডেল অঞ্চলে প্রামাণিক পরিবারের কাঁসা-পিতলের কারখানায় তৈরি হয়েছিল এই রথ। রথটি নির্মাণ করেছিলেন গুরুচরণ প্রামাণিক, তারকনাথ প্রামাণিকের পিতা। সে সময় কলকাতা ও তার পারিপার্শ্বিক অঞ্চলে এমন কারিগরি ও নির্মাণ এক বিস্ময়ের নাম ছিল।
এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ
রথের প্রতিটি তলায় চার কোণে চারটি করে পরীর মূর্তি আজও দাঁড়িয়ে আছে অভিভাবকের মতো। তাদের ঘিরেই যেন গড়ে উঠেছে প্রামাণিক পরিবারের এই উৎসবের মাধুর্য। অতীতের মতো আজও রথটি ধাপে ধাপে খোলা হয়, পালিশ হয় পিতলের গায়ে জমে থাকা কালের ধুলো। তারপর আবার গড়ে তোলা হয় সেই ঐতিহাসিক কাঠামো। যেখানে ধর্ম, শিল্প আর পারিবারিক গর্ব একসূত্রে বাঁধা।
আগে এই রথ যাত্রা করত সিমলার কাঁসারি পাড়া থেকে বড়বাজার পর্যন্ত। ঢাক-ঢোল বাজিয়ে, পাড়ার মানুষের ঢল নামিয়ে চলত রথের যাত্রা। বড়বাজারে পরিবারের কারখানায় রথ থাকত সাতদিন, সেখানে পূজা, প্রসাদ, গানের আসর। সব মিলিয়ে উৎসব জমত। তারপর উল্টোরথের দিন, আবার সেই বিশাল রথ টেনে আনা হতো বাড়িতে।
এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ
এই রথযাত্রা শুধু প্রামাণিক পরিবারের নয়। এটা ছিল গোটা পাড়ার উৎসব। পাড়ার গিন্নিরা ভোগ রান্নায় ব্যস্ত, ছোটরা রথ টানার লড়াইয়ে, আর বয়োজ্যেষ্ঠরা ব্যস্ত নিয়ম রক্ষা আর প্রথা পালনে।
যদিও এসব বন্ধ হয়ে গিয়েছে বহুদিন। আগের মতন এখন সে লোকবল কোথায়! বাড়ির মধ্যিখানেই সব সীমাবদ্ধ। হৈ হৈ করে আনন্দে মাতে পরিবারের সদস্যরা। কথায় আছে রথের দড়িতে টান পড়লেই তো দুর্গা আসেন স্বপরিবারে।
সময় বদলালেও, বদলায়নি ঐতিহ্য! আজ সেই কারখানা নেই। রথ আর রাস্তায় নামে না। বদলে গেছে শহরের ছন্দ, বদলেছে রাস্তা, গাড়ি, মানুষের ব্যস্ততা। তবে বদলায়নি প্রামাণিক পরিবারের রথ টানার মন।
আজও রথ টানা হয় বাড়ির উঠোনেই। পুরনো উঠোনে জড়ো হন পরিবারের সব সদস্য, পাড়া-প্রতিবেশী। তোলা হয় ঢাক, বাজে শঙ্খ, গলায় উঠে আসে পুরনো কীর্তনের সুর।
এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ
সত্যেন কুমার প্রামাণিক বলেন,"ছোট থেকে নিজের হাতে রথের প্রতিটা দিক সাজাতাম, এখন আর পারি না। রথ এলেই সবাই মিলে কাজে লেগে পড়তাম। পাড়ায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা রথ নিয়ে বেরোত। এখন সেসব আর কোথায়! কিন্তু চোখে সেই সময়টা এখনো স্পষ্ট, বাড়ির উঠোনে রথ দাঁড় করানো, পাড়ার লোকের ভিড়, আনন্দ, কীর্তন। সব যেন গতকালের স্মৃতি।"
এই রথ কেবল রথ নয়, এ কলকাতার আত্মপরিচয়ের এক জীবন্ত দলিল এই রথ আজ উত্তর কলকাতার একমাত্র নয়, বরং সমস্ত শহরের এক ঐতিহ্য। আর কলকাতা এই ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে দিনের পর দিন। প্রতিটি ধাতব গায়ে লেগে আছে সময়ের ছাপ, পারিবারিক ইতিহাসের গল্প, শিল্পের ছোঁয়া।
রথের দিনে যখন আকাশে ঘনিয়ে আসে কালো মেঘ, হালকা বৃষ্টিতে কালো পিচ রাস্তা চকচক করে ওঠে, গাছের পাতা আরও সবুজ হয়। তখন মনে হয়, সময় থেমে আছে প্রামাণিক বাড়ির উঠোনে, সেই পুরনো দিনের মতোই।