ইন্দ্রাশিস আচার্য্য
সম্ভবত এখনও আমরা নিটোল গল্প আর বেশ আরাম দায়ক শেষ দেখতে ভালবাসি সিনেমায় কারণ এখনও এটা আমাদের কাছে এখনও শুধুই বিনোদন। প্রায় একশ পনেরো বছর পেরিয়ে যাওয়া চলমান গল্প বলার রীতি, ঢং, ধরন চলন সবই ধীরে ধীরে পাল্টেছে। পাল্টেছে চারপাশ, মানুষ, মন, ভাবনা চিন্তা। সিনেমা, গল্প থেকে কবিতা হয়েছে, কবিতা থেকে বাস্তব হয়েছে। কখনো সেখানে ইতিহাস এসেছে, সমাজ পরিবর্তনের কথা এসেছে, কখনো এসেছে বিপ্লব। সময়ের সঙ্গে, ভাবনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছবি বা সিনেমা তার ভাষা বদলে বদলে নিয়েছে। সিনেমা দেখে যেমন বিপ্লবের কথা মনে হয়েছে, তেমনই কখনওবা নিজেকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে উলঙ্গ করতে ইচ্ছে হয়েছে। আর এই সব কিছুকে সঙ্গে নিয়ে সিনেমার ফর্ম ,ফরম্যাট, সব মিলিয়ে সিনেমাটিক ল্যাংগুয়েজ ব্যাপারটা ভীষণ জরুরি হয়েছে দেশ কাল ধর্ম জাতির কাছে সিনেমার বার্তা সঠিক ভাবে পৌঁছোবার জন্য।
আরও পড়ুন: উত্তর সত্য, সাংবাদিকতা এবং আমরা
এমনতর কর্মকাণ্ড যেমন আর্ট ফর্মকে সমৃদ্ধ করেছে আবার কখনো কখনো উল্টোও ঘটেছে। অনেক পরিচালক সব জেনেও অন্য পথে চলেছেন সময়ের থেকে এগিয়েও কথা বলেছেন। তাই নিজের মতো করে বদলে দিয়েছেন সিনেমার গতানুগতিক ভাষা, ভেবে দেখার দরকার মনে করেন নি তাঁর ভাষা বুঝবেন কারা, বিশ্বাস করেছেন ভবিষ্যৎকে (অবিশ্বাস ও করেছেন নানান বিষয়কে)। তাও আবার যেরমসেরম নয়, এমন ঢঙেই বদলেছেন, আসলে বলা উচিত সিনেমার চিরায়ত বাঁধা ছন্দ এমন করেই ভেঙেছেন যে সিনেমা প্রিয় মানুষও প্রথম প্রথম সেই ছন্দে তাল মেলাতে পারেনি। তবে কারিগর যদি তেমন হয় তবে শিল্পের কদর একদিন না একদিন করতেই হবে। তাই শুরুতে না করতে পারলেও ধীরে ধীরে সিনেমার নতুন রূপকে গ্রহণ করেছে মানুষ। সিনেমার এই চালচলনের বদল কখনো এসেছে নিউ ওয়েভ ফরম্যাটে কখনওবা সাধারণভাবে আস্তে আস্তে অভিযোজনের মতো। নিজের ঘরের ইতিহাসই তো সেই বদলের সাক্ষী, পথের পাঁচালীকে তো প্রথমেই আলিঙ্গন করে ঘরে তুলতে পারেনি কেউ, কারণ সিনেমার ভাষা সমস্যা,পরিবর্তনকে নিতে পারার সমস্যা। কিন্তু পরবর্তী কালে গ্রহণযোগ্যতা পেতে অসুবিধে হয়নি। যখন মানুষ বুঝতে পেরেছে সিনেমা তার পরিচিত বিষয়ের কথাই বলছে, চরম দারিদ্র্য, মৃত্যু, ফ্যান্টাসি, শৈশব এই বিষয়গুলো তো বড্ড চেনা, আর হৃদয়ের যন্ত্রণার খুব কাছের এক বিষয় বলা যেতে পারে সেনসেশনাল। তার সঙ্গে অভূতপূর্ব সিনেম্যাটিক ল্যাংগুয়েজ। এবার মজাটা হলো, নতুন কিছু শিখলে তার আলাদা নেশা তৈরি হয়, তাতে শেখার পরিশ্রমের আনন্দ থাকে,অনাবিল আবেগ তাই স্বতস্ফুর্ত ভাবে চলে আসে। এই তালে পা মিলিয়েই পথের পাঁচালী বসে গেল মণিকোঠায়। কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘা, আবার নতুন ভাষা, এবারে কিন্তু তেমন ফল হলোনা, কারণ ওই সেনসেশন অনুপস্থিত, নাটকশূন্য চিত্রনাট্য। বহুস্তরীয় মনস্তত্ত্ব, দেশ নয় বিদেশেও খুব কিছু হলোনা এই ছবির।
আরও পড়ুন: আমাদের পহেলা বৈশাখ: বাংলাদেশ থেকে বলছি
সময় লাগলো, সিনেমার ভাষার ক্রমাগত পরিবর্তন আর প্রসার ঘটলো, আজ হয়তো কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখলে অসুবিধে হবে না বরং তার সিনেম্যাটিক ব্রিলিয়ান্স নিয়ে কথা হবে । আর এই সবকিছু, এসথেটিক্স, লেয়ার্স, ফর্ম্যাট, ফর্ম, ল্যাংগুয়েজ, এর ওপর বাটপাড়ি করা কিছু মানুষের কথাই আমার মনে আসছে যারা পাল্টে দেবার দক্ষতা রাখেন নিজেদের মতো করে। বিশ্বাস রাখেন নিজেদের ওপর, আগামীর ওপর। সিনেমা তো শুধু গল্প নয়, মানে ক্লাইম্যাক্স শুধু নয়, একটা চলা, চলতে চলতে নানান ঘাত-প্রতিঘাত, ভালোবাসা, প্রেম-অপ্রেম, সমাজ, বিপ্লব, রাজনীতি, ঘুরে ফিরে আসে যায় সেখানে। আর তৈরি হয় দলিল, আমাদের সমাজ, দেশ, মানুষ, ইতিহাসকে চেনা হয়।পরিচালক কখন কোথায় কী চেনাবেন, সেই তেষ্টা নিয়ে অপেক্ষা করি আমরা। কখনও তিনি বিশ্বনাগরিক হয়ে ঢুকে পড়েন তৃতীয় বিশ্বের এঁদো গলিতে, লুকোনো জীবন দেখে ফেলেন, অথবা রাজনীতি দিয়ে চেপে রাখা সমাজ সংসার দেখে ভেতরে ভেতরে অপরাধ বোধে ভোগেন। বোঝা হয় এভাবেও বেঁচে থাকা যায়। এক জীবন অনুভব করে অনেক জীবন, এক হৃদয় অনুভব করে অনেকের হৃদয়, অনেকের প্রেম , আমরা অজান্তে মুচকি হাসি আবার একলা কাঁদি, আমাদের পেছনে বেহালা বা চেলো বেজে চলে তাই সিনেমায় বেঁচে থাকে সুপ্ত ঈপ্সা, যে জীবন উৎরেও দেওয়া যায়। আমাদের দেশে সেইভাবে সিনেমা বানানো কিন্তু সত্যি ধন্যবাদযোগ্য। এখানে পয়সা আর ঐ তিন নম্বর পাতার লোভেই যাবতীয় কিছু। দোষ নেই কারণ সিনেমা না চললে সেই পরিচালকের সেখানেই সমাধিস্থ হওয়ার উপক্রম হয়। আর বিদেশে? আপনি ভালো ছবি বানালেই যে সবাই দেখবে তার কোনো মানেই নেই। সত্যি বলছি দেখে না দেখবে না কিন্তু তাও কোথাও বিশ্বাস রাখতে হবে। তাই এই মুহূর্তে যাদের সিনেমা দেখলে ঠিক মনে হয় অনেক জীবন বেঁচে নিলাম, জীবন থেকে কিছু প্রগাঢ় অনুভুতি আত্তীকরণ করলাম তাদের থেকে পাঁচজন রইলো। বাদ রইলো অনেকজন, হয়ত পরে কোনোদিন । আমি সিনেমা বোদ্ধা নই। আমার ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র মস্তিস্ক আর আবেগকে ভরসা করে সিনেমার প্রতি যে ভালোলাগাটুকু আছে, সেটুকুই ভাগ করে নিচ্ছি আপনাদের সঙ্গে।
সিনেমা আমি ব্যক্তিগত ভাবে দুরকম দৃষ্টিকোণে দেখি ১, ফাংশনাল, ২, টেকনিক্যাল। যেহেতু বিষয়টা প্রিয় পরিচালকদের নিয়ে তাই টেকনিক্যাল ব্যাপারটা উহ্য রাখি। কিন্তু ছবির চলনভঙ্গিমা যার ভেতরে অভিনয় থেকে আবহ সবকিছুর নিবিড় যোগ থাকে তার থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া দুস্কর। আর সেখানেই একজন পরিচালক প্রিয় হয়ে ওঠেন তাঁর স্বাক্ষর বা সিগনেচার দিয়ে। যদিও ব্যাপারটা আপেক্ষিক ।
মাইকেল হেনিকে: “I hope all my films are provocative and obscene,” Michael Haneke
মিউনিখে জন্ম, অস্ট্রিয়া তে বড় হয়ে ওঠা । নাটক পরিচালনা থেকে টেলিভিশন প্রোডাকশন হয়ে নিজেই নিজের চিত্রনাট্য লিখে পরিচালনা শুরু করেন হেনিকে। ১৯৮৯ সালে প্রথম ছবি " The seventh continent”. এক অস্ট্রিয়ান মধ্যবিত্ত পরিবারের আত্মহত্যার গল্প। এরপর Benny's Video যেখানে এক টিনএজার খুন করে একটি বাচ্চা মেয়েকে শুধু দেখার জন্য মৃত্যু সত্যি কেমন হয়। এরপর 72 fragments of a choronology of chance, funny games, the piano teacher, cache, white ribbon, amour, happy end । ওপরের বিষয় গুলো থেকে হেনিকের উক্তির সারমর্ম বুঝতে আর বেগ পাওয়া উচিৎ নয়। ওঁর ছবি দেখার সময়ে পরের সময় টুকু আমি আমার এই উপলব্ধি এনে দেখার প্রস্তুতি দরকার। হয়ত বিচ্ছিন্ন হয়ে এই চারপাশ থেকে। একাধিক পালম দি ওর, একাধিক একাডেমি পুরস্কার সঙ্গে বহু সর্বোচ্চ স্বীকৃতি পাওয়া পরিচালককে অনেকেই কিংবদন্তি auteur বলে থাকেন। অস্ট্রিয়াতে শুরু করলেও ফ্রান্সকেই বেছে নেন হেনিকে ছবি বানানোর জন্য।
আরও পড়ুন : রমনার বটমূল কেঁপে উঠেছিল বিস্ফোরণে
অবজেক্টিভ ক্যামেরা এবং রিয়াল টাইম এডিটিং তার বিশেষত্ব বহন করে। যদিও মনে করা হয় তার ছবিতে ব্রেসনিয়ান ইম্প্যাক্ট নাকি অস্বীকার করা যায় না। নিজেও অবশ্য তিনি রবার্ট ব্রেসর ছবির ব্যাপারে তাঁর মুগ্ধতার কথা বলেন । মজার ব্যাপার হলো তাঁর চরিত্ররা যে স্বভাবে সিনেমায় তৈরি হয় আর যে সিদ্ধান্ত তারা নিয়ে থাকে তা অনেক অংশেই কোনো যুক্তি খুঁজে পায় যায় না। এখানেই তাঁর সিনেম্যাটিক দর্শন, এখানেই তিনি মস্তিকের গোপন গভীরে লুকিয়ে থাকা অদেখা নানা ডাইমেনশন চরিত্রের ভেতর দিয়ে প্রকাশ করান। তাঁর চরিত্ররা কেমন যেন শান্ত, স্থবির, আবেগহীন, অনেকটাই যেন যুগের থেকে আলাদা অথচ হলেও হতে পারে গোছের একটা বাস্তব স্তর যেন তাদের গায়ে বিষাদের মতো লেগে থাকে। আসলে বোঝা যায়না কত বারুদ কত আবেগ মানুষ পুষে রাখে নিজের গভীরে। তীব্র বিষণ্ণতা, চরম আবেগ লুকিয়ে রেখে লালন করাটাই যেন রোমান্টিসিজম।
চিত্রনাট্য থেকে শুষে নেওয়া হয় নাটকীয়তা, বিমূর্ত মুহূর্ত তৈরি হয় , বিমূর্ততা ভেঙে যায় কোনো মাহেন্দ্রক্ষণে, সেই ক্ষণের প্রতীক্ষা ছবি জুড়ে। হেনিকে চেয়ে থাকেন, অপেক্ষা করেন , কখন আমাদের সঙ্গে ভেঙে পড়বে এই আপাত ছুটে চলা অথচ জগদ্দল স্থবির এক পৃথিবী। সিনেমাটিক যুক্তির পরোয়া করেন না, তোয়াক্কা করেন না চরিত্রায়নের পর চরিত্রের অসামঞ্জস্যের। এর সঙ্গে থাকে সম্পাদনা, ফ্রেমিং ( অফ ফ্রেমিং বা পারশিয়াল ফ্রেমিং-এর চমকপ্রদ ব্যবহার চমকে দেয়) সাউন্ড ডিজাইনিং , সব মিলিয়ে একটা disturbingly beautiful narrative তৈরি হয়। অনেক স্তর অনেক গভীরে লুকিয়ে থাকা মনস্তত্ত্বের ভেতর ইউরোপিয় রাজ্য,রাজনীতি, ক্লাস সিস্টেম, জেন্ডার রোলস এবং তার প্রভাব ভয়ানক ভাবে বাস্তবের সাথে এসে উপস্থিত হয়। তাঁর ছবিতে শব্দ, সম্পাদনা অভিনয় আলাদা ভাবে আলোচনা হতে পারে। নাওমি ওয়াট বিপদে পড়েছিলেন funny games ছবিতে অভিনয় করার সময়। কারণ হেনিকে সব কিছুই নিজের ছন্দে করেন। জল ঢালা গ্লাস হাতে নেওয়া থেকে জল খাওয়া, এটাও নাকি কোনো অভিনেতা স্বাভাবিক ভাবে করতে পারেন না, করতে হবে পরিচালকের ছন্দের ওপর। কারণ ছবির শুরু থেকে সেই ছন্দেই ছবি বোনা হয়ে যায় এই বিরল প্রতিভার মননে। প্রিয় বিষয় এই পরিচালকের? যাঁরা এঁর ছবি দেখেন বোধহয় একমত হবেন, সুইসাইড এবং ভায়োলেন্স। বেশিরভাগ ছবিতেই হেনিকে ভয়ানক, গাস পার নুই এর থেকেও অনেক বেশি রূঢ় তাঁর প্রতিস্থাপনা। ইসাবেলা হারপেটকে নিয়ে প্রত্যেক ছবিতেই এনেছেন আচমকা চমক। প্রত্যেক সুইসাইড, খুন বা ভায়োলেন্স আপাতভাবে ব্যক্তিবিশেষের ব্যক্তিগত আক্রোশ মনে হলেও পরিচালক এথিক্যাল, পলিটিকাল এবং ফিলসফিক আস্পেক্ট কে অস্বীকার করানোর জায়গা রাখেন না, এভাবেই তৈরি করেন ছবির স্তর বিন্যাস। তবে ethical interrogation of violence এর ওপর পরিচালক বেশি জোর দেন। পোস্ট মডার্ন সোসাইটি, লেট ক্যাপিটালিস্ট এলিয়েনেশনের সঙ্গে ব্যক্তির আত্মধ্বংসের যে কারণ তা বার বার উঠে আসে এবং এই আত্মসর্বস্বতা ও রাজনীতি থেকে ব্যক্তিজীবন যে ধ্বংসের দিকে পা বাড়াচ্ছে তার গল্পই হয়তো ভেতরে অনুরণিত করার চেষ্টা করেন। ছবিতে বিষাদ থাকে,অন্ধকার অলিগলি ঘুরে ঘুরে সে বিষাদ জমা থাকে নানান পথের মধ্যে লুকোনো চোরা কুঠরিতে। মনোযোগী দর্শক তাকে যখন খুঁজে পান বা তল পান সিনেমা দর্শন সমৃদ্ধ হয়।হেনিকেও বোধ হয় এই জন্যই আজও ৭৪ বছর বয়েসে ছবি বানাবার উৎসাহ পান।
প্রিয় ছবি: Cache, The White Ribbon, Amour, Benny's Video. The piano teacher.
যে নিউওয়েভ সিনেমার কথা লেখার শুরুতে বলেছিলাম, তা শুধু কোনও একবার একজায়গায় হয়ে থেমে যায়নি। সিনেমার এ এক বারংবার নতুন হয়ে জন্ম নেওয়া। আমার পছন্দের তালিকায় এবার যে পরিচালকের কথা বলব নিউ ওয়েভ সিনেমা নিয়ে আলোচনায় তাঁকে বাদ দেওয়াই যাবে না।
আরও পড়ুন : দুটি কবিতা: ফেরদৌস নাহার
ওং কার ওই : হং কং নিউ ওয়েভ শুরু করেছিলেন সুই হার্ক , আন হুই এবং প্যাট্রিক টম।প্যাট্রিক-এর সাথে কাজ করেছিলেন দ্বিতীয়বার নিউ ওয়েভ নিয়ে আসা পরিচালক ওং কার ওয়াই। ওং কার ওআই দের সাথে আমার প্রথম অভিজ্ঞতা in the mood for Love । 1962 সালের অশান্ত হং কং। 13 বছর পর চায়নায় কমিউনিস্ট জামানা চলার পর ও হংকং ব্রিটিশ অধ্যুষিত। সেখানে প্রধান দুই চরিত্র জার্নালিস্ট চাউ আর এক জাহাজ কোম্পানির সেক্রেটারি সু, এরা বুঝতে পারেন এদের স্বামী স্ত্রী একে অন্যের সাথে প্রেমে মগ্ন। কিন্তু এরা আবার প্রতিবেশী হয়ে থাকেন। নিজেদের ছোট ঘরে দুজন দুজনের মতো। নিঃসঙ্গতা ঘিরে থাকে দুজনকেই মাঝখানের দেয়াল দম বন্ধকরা পরিবেশ কে মনে করিয়ে দেয় রাজনৈতিক অস্থিরতা। দুজনের দেখা হয় নুডলস এর দোকানে যাওয়ার পথে। চেলো বেজে যায়। বৃষ্টি ভেজা রাস্তায় নিঃসঙ্গ চাউ হেঁটে যায় আর স্লো মোসানে হাতে খাবারের জায়গা নিয়ে হেঁটে যায় সু। এ এক আশ্চর্য পরিমিতি বোধের ছবি। এই প্রেমে শরীর নেই, স্বপ্ন নেই কিন্তু বেঁচে থাকার রসদ জমা হতে থাকে সময়ের বহমানতার মধ্যে। ইতিহাস নস্টালজিয়া ওং কার ওয়াই এর সাক্ষর তৈরি করে দেয়। আর পৃথিবী পেয়ে যায় আরেকটা এশিয়ান মাস্টারপিস। সময়, ওং কার ওয়াই এর পছন্দের বিষয়। বেশিরভাগ জায়গাতেই সময়ের নিরিখে সমাজ, জায়গা, অর্থনীতির বিভিন্ন পরিবর্তন নানান সময় এসেছে। চুং কিং এক্সপ্রেসেও সেই ঘড়ির দৃশ্য তার প্রমাণ রাখে। সেখানে একজন পুলিশ অফিসার ক্যানে আনারস খাবার পর দেখা যায় তার expiary ডেট । যেখানে মনে হয় পৃথিবীর যাবতীয় বিষয়ের একটা এক্সপায়ারি ডেট থাকে সেটা প্রেমের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। হং কং চায়নার সম্পর্ক সিনেমায় এক অন্য সুর তৈরি করে। Happy together ছবিতে হং কং চায়নার কাছে চলে যায়, যেখানে সময় স্মৃতি হাত ধরাধরি করে চলে। শোনা যায় কোনো চিত্রনাট্যের ধার ধারেন না, ইনসটিংট আর ইমপ্রোভাইজেশনের ওপর আস্থা রেখে ছবির শুটিং চালিয়ে যান ওং কার ওয়াই। আর যিনি না থাকলে এই আস্থা হয়তো অর্জিত হতো না তিনি সিনেমাটোগ্রাফার Chirstopher Doyle। ওংকার ওয়াই এর ছবিতে তাই রং আর আলো অন্য মাত্রায় লক্ষ্য করা যায়।পার্শ্ব সহচরিত্রদের নিজেদের গল্পে, রঙের ক্লাইডোস্কোপে , নন লিনিয়ার ন্যারেটিভে উঠে আসা স্লো মোসান, অফ সেন্টার ফ্রেমিং, অন্ধকারে ক্যামেরার চলা সব কিছুর মধ্যেই স্বকীয়তা ভরে থাকে তার ছবিতে তার মতো করে। বেশিরভাগ ছবির চরিত্ররা শেকড়হীন , তাই ইতিহাস বিহীন কিন্তু নিজেরাই ইতিহাস গড়ে নেয়। এ যেন অবিরাম এক জনস্রোত কে চিনিয়ে দেওয়া। স্রোতে ভেসে যায় হং কং-ও যখন যেদিকে মানুষের স্রোত ভেসে যায়। এ যন্ত্রণার ক্ষরণ একমাত্র তিনিই দেখাতে পারেন যিনি উপলব্ধি করেন। অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত চরিত্ররা আঁকড়ে ধরতে চায় স্থবির কিছু। আপাতভাবে মনে হলেও আদতে স্থবিরতা কোথাও নেই। সেখানেই প্রশ্ন আসে আমাদের মনে, আর ওং কার ওয়াই আমাদের কান মুলে ভাবনায় ডুবিয়ে দেন, আমরা ডুবে থাকতে ভালোবাসি তাই ডুবতেই থাকি।
আরও পড়ুন : হত্যা হাহাকারে – অপরাধসাহিত্যে বিনির্মাণ ও আধুনিকতা
প্রিয় ছবি: in the mood for Love, chunking express, Days of Being Wild.
বিশ্বসিনেমার আলোচনায় ইরানকে আনতেই হবে। তবে একটু সাহস দেখিয়েই ইরানের সেই পরিচালককে নিয়েই কিছু কথা লিখছি আর মনে মনে ভয়ও পাচ্ছি। এত খ্যাতি, এত চর্চা এনাকে নিয়ে হয়েছে যে আমার কথায় কোথাও যদি ভুল হয়ে যায়, তবে তো পাতালপ্রবেশ অবধারিত। তবুও,
মাজিদ মাজিদি: চিলড্রেন অফ হেভেন নিশ্চই প্রচুর মানুষ দেখেছেন। ভাই বোনের জুতো হারিয়ে সেটাকে পাবার চেষ্টা করতে থাকে, খুঁজে না পেয়ে অন্য উপায় ভাবে খুঁজে বের করার। এই বিষয় নিয়ে গল্প চলাকালীন ইরানের সমাজ, অর্থনীতি আর প্রান্তিক মানুষদের রোজকার সংগ্রাম ছবির সাথে এক হয়ে যায়। মাজিদ মাজিদির বেশির ভাগ ছবিতে এটাই উঠে আসে। সমাজ আর তার প্রান্তিক মানুষের নিজেদের ভেতর ভালোবাসা আর অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। আত্মপ্রত্যয় থাকে কিন্তু উত্তরণ বেশিরভাগ জায়গাতেই ঘটেনা, অথচ হার মানে না কেউ, উপরন্তু শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে সেই দুঃসহ জীবনে বেঁচে থাকার। চরিত্ররা বেশিরভাগ শান্ত, স্থিতধি, কেউ কেউ আত্মমগ্ন, প্রতিশোধ নেই , অনুশোচনাও খুব কম, চরিত্ররা ধীরে ধীরে ঐশ্বরিক হয়ে ওঠে। এখানে সমালোচনা হতে পারে, রিয়ালিসম এর বিরুদ্ধে, মানবিক ইনস্টিক্টকে চ্যালেঞ্জ করা যেতে পারে আর সেখানেই জিতে যান মাজিদি। মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরের দর্শন খোঁজেন। সংগ্রাম এবং লড়াইকে মনে করিয়ে দেন অবশ্যম্ভাবী কিন্তু অনাখাঙ্কিত।সেই সংগ্রামে আপনি অংশ হয়ে উঠবেন অতিবাস্তবতার নিরিখে, আর সঙ্গে লো নোটে অভিনয় এবং জোনাল এক্টিং কে একটা বড় জায়গা দেন মাজিদি। ইতালির নিওরিয়ালিজমের সঙ্গে অনেক অংশে তাঁর ধারার মিল পাওয়া যায়। অসচ্ছল, প্রান্তিক প্রধান চরিত্র, নির্দিষ্ট ক্লাইম্যাক্স, লম্বা শর্টস, আবহ সংগীতহীনতা। এইসব মিলে গিয়ে তৈরি হয় এক চূড়ান্ত বাস্তব বাতাবরণ, দর্শকও যেখানে নিজের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারে, একজন পরিচালকের এর থেকে বড় সার্থকতা আর কি হতে পারে। মজা হলো আমরা স্লো মোশন ব্যাবহার করে, ছোট ছোট অংশ সম্পাদনা করে, মায়াময় আবহ সৃষ্টি করে একটা লোমহর্ষক, আবেগঘন মুহূর্ত তৈরি করি। আর মাজিদিরা সেখানেই চ্যালেঞ্জ ছোড়েন। সমস্ত কিছু ব্যতিরেকে শুধু বাস্তব ভাবে ছবি সম্পাদনা করেও আপনাকে কবিতায় ভাসিয়ে দেবে। মাজিদির ছবিতে সুফি কবিদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় ঘনঘোর বাস্তব ছাড়িয়ে যা চোরা স্রোত হয়ে ছবিতে বইতে থাকে।
প্রিয় ছবিঃ কালার অফ প্যারাডাইস, চিলড্রেন অফ হেভেন, সং অফ স্পারোস ।
আরও পড়ুন : অমর মিত্র: তাহাদের সংসার
পৃথিবীটা একটা সময়ের পর খুব তালগোল পাকিয়ে গেল। এই ব্যাপারটায় অনেকেই মানবেন। যাঁরা ১৯৮০ সালের এপাশে ওপাশে জন্মেছেন তারা এই সময়টায় কেমন যেন একটু ভেবড়ে গেলেন। ১৯৯৫ সালের এদিক ওদিক থেকে প্রগতির গুঁতোয় তাঁরা কেমন ছন্নছাড়া হয়ে গেলেন। এই ছন্দবদলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো প্রথম বিশ্বের সঙ্গে অন্তত ওই গ্যাজেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে এক হয়ে গেল <আর বাকি ক্ষেত্র গুলোতে , মানে অর্থনীতি, সামাজিক শিক্ষা, চেতনায়, তলায় তলায় রয়ে গেল অভাব, যন্ত্রণা আর অপরিবর্তনীয় ভাবনা। তাই কিছু আধুনিক পরিচালক তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেকে এসে সিনেমার দুনিয়ায় আলো জ্বালিয়ে দেখালেন। এদের মধ্যে আমি পছন্দের তালিকায় রাখছি কৃষ্টি পুইউ এর নাম। বেশি ছবি বানাননি কিন্তু নিজের স্বাক্ষর, ছবির নিজস্ব ভাষা তৈরি আর তা দিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে খ্যাতিতে বিশাল এক সম্ভবনা জাগিয়েছেন তিনি । রোমানিয়ান নিউ ওয়েভ এর গডফাদার বলা যেতে পারে তাঁকে। প্রথম ছবি The death of Mr. Lazaras তে পেয়ে গেলেন কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল থেকে Uncertain Regard এ শ্রেষ্ঠ ছবির তকমা। কৃষ্টি পুইউ র ছবিকে আমার ব্যক্তিগতভাবে সুপার রিয়ালিজম বলতে ইচ্ছে হয়। এই প্রতিনিয়ত পরিবর্তনে জর্জরিত সমাজ এর বহিরঙ্গে আর অন্তরঙ্গে যে আশ্চর্য এক খেলা চলছে কোথাও পুইউ তাকে ধরতে চেষ্টা করেন। পাল্টে যাবার ভান করছে অথচ পাল্টাচ্ছে না, চরম ভালোবাসা অথবা যন্ত্রণা থেকে বেরিয়ে আসে আসল মানুষ। পুইউ-এর ছবি রাজনৈতিক, সেটার প্রকাশ ওপর স্তরেই থাকে। Sieranavada তে চরিত্ররা আমেরিকা ৯ সেপটেম্বর ২০১১ আর ফ্রান্স এ চার্লি হেবো র মৃত্যু নিয়ে তর্ক চালাতে থাকে। পুইউ এর মতে এখন ইন্টারনেটের সময় আমাদের দেশ সমাজ কালের বিভেদ মুছে গেছে। কিন্তু সেটা আপাতভাবে মনে হয়। একটা অস্পষ্ট, অর্ধেক , অর্ধসত্য ইনফরমেশন এর ভিত্তি করে কত সময় আমরা সময়ের কাছে দিয়ে দিচ্ছি আমাদের ব্যাক্তিগত অমূল্য সময়। আমাদের অপদার্থতা, হেরে যাওয়ার একটা দুর্দান্ত প্ল্যাটফর্ম পেয়েছি অজুহাত তৈরি করার। সেটা ইন্টারনেট এর অজস্র জাগতিক অজাগতিক তথ্য থেকে সাজিয়ে শুধু বলার জন্য তৈরি করতে হবে। Sieranavada ছবিটা, প্রায় পুরো ছবিটা একটা বাড়ির ভেতর করা এবং বাড়ির বিভিন্ন ঘরের দরজা জানালাগুলো একেকটা চরিত্রের কাজ করেছে। খোলা অবস্থায় যেখানে বিভেদ নেই আবার বন্ধ হলে একে অপরের কাছে অপরিচিত অর্থাৎ বিভিন্ন টাইম আর স্পেসে আপনার সাথে আপনার পরিচিতের সম্পর্ক ক্রমাগত পাল্টাচ্ছে রাজনৈতিক ভাবে , ব্যক্তিগত ভাবে অথবা শুধুই ভাবনায়। ছবিতে বাবার মৃত্যুর ৪০ দিন পর এক নিউরোলজিস্ট পরিবারের আত্মীয়স্বজনের সাথে বাবাকে স্মরণ করতে চেয়েছিলেন। দিনটা ছিল চার্লি হেবদোর মৃত্যুর তিনদিন পর। সেখানে জানলায় পাখিদের বসা থেকে রাজনৈতিক তর্ক অর্থনীতি প্রগতি গিলে খেতে থাকে। পুরো ঘটনা আশ্চর্যভাবে ক্যামেরা বন্দি হয়। আর পারস্পেক্টিভ ছিল মৃত বাবার দেখার চোখ।
Death of Mr. Lazarascu তেও সিরোসিস আক্রান্ত একজন পেশেন্টকে নিয়ে একজন নার্স সারারাত নানান হসপিটালে ঘুরে যান কিন্তু সেদিন কোনো বড় বাস দুর্ঘটনার জন্য বা নানান অজুহাতে তাকে কেউ ট্রিটমেন্ট করতে চায়না। লাজরাসকুর ভাষা সংযত নয়, ব্যবহার আশাস্বরূপ নয়। তাই তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার অজুহাতও তৈরি হয়ে যায়। কারণ সে দুর্বল, হয়তো মৃত্যু একদম কাছে। পুইউ শেষে রেখে দেন তাকে শুয়ে থাকেন একলা, নিরাবরণ। আমরা এভাবেই উপলব্ধি করি কী করে ইরান, আমেরিকা, ভারতবর্ষ, রোমানিয়া এক হয়ে যায় যখন সেখানের রাষ্ট্র হাত তুলে নেয়। ব্যক্তি নয় রাষ্ট্রের কাছে মাথা নোয়ানো ছাড়া উপায় থাকে না। উল্টোটা হলে আর একলা হলে অনুগ্রহের দাসত্ব মেনে নিতে হয়। পুইউর ক্যামেরা চরিত্রের গতি অনুযায়ী চলে, এডিটিং বিশেষ ধরা পড়েনা, ওখানেই মুন্সিয়ানা আমরাও চরিত্রের সাথে ঘুরি, কথা বলি অথবা শুয়ে থাকি, হয়ত পুরনো জানালাটা যে সাক্ষ্য জমিয়ে রাখে একান্তে টাকে গিয়ে প্রশ্ন করি জিজ্ঞেস করি “সত্যিটা জানার জন্য”। আমরা ভাবি যা দেখছি তা কালকেই হবে আমার সাথে অথবা আমার এমন অভিজ্ঞতা নেই অথচ এখন আমি সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে এখন থাকব। একটা সিনেমা তে একটা জার্নি দিয়ে অভিজ্ঞতা করান পুইউ আমি তখন বিশ্বনাগরিক। সিনেমা পরিচালকের না বলা যন্ত্রণা যার রেশ টুকু থাকে আমার ভেতরে।
আরও পড়ুন : জেন্ডারঃ কী বুঝি – বুঝি কি?
প্রিয় ছবিঃ Death of Mr. Lazarascu, Sieranavada।
একেবারে সমসময়ের একজনকে নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। ২০১৭ তেও যিনি আমাদের ভাবনার উনুনে হাওয়া দিয়েছেন।
ফাতে আকিনঃ প্রথম সিনেমা শর্ট শার্প শক ১৯৯৮ তে। লোকর্ণ থেকে ব্রোঞ্জ লেপার্ড, বাভেরিয়ান আওয়ার্ড বেস্ট ইয়ং ডিরেক্টর। তারপর একইভাবে রোড মুভি I am Juli, 2002 তে solino , 2004 এ head on আর সেখানে আসে গোল্ডেন বিয়ার বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল থেকে। জার্মানির হামবুর্গ শহরে এই টার্কিশ পরিচালক প্রথম থেকেই যে সম্ভাবনা জাগিয়ে ছিলেন তা আজও বজায় রেখে চলেছেন। ২০১৭ সালে নতুন ছবি In the Fade পেয়ে গ্যাছে golden globe for best foreign language film। শুরুতে অভিনয় করতে এসে টার্কিশ ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করতে করতে ক্লান্ত হয়ে মার্টিন স্করসিসির ট্যাক্সি ড্রাইভার এর মত সিনেমা দেখে ফাতে আকিন নিজে চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করেন। আবেগ, অকপট বাস্তব, বন্যতা যাকে আমরা বলতে পারি wild, raw and impulsive তাঁর প্রথম ছবিগুলিতে দেখতে পাই। বারবার উঠে আসে বিভিন্ন ভাষা দেশের সংস্কৃতি , উঠে আসে জীবন যাপনের বৈপরীত্য উঠে আসে স্বপ্ন দেখা, আটকে পড়া মনের মুক্তির চিন্তা ও তার ধরণের কথা। ফাতে আকিন সেই নানান সংস্কৃতি মিলিয়ে দেন সীমানা রাখেন না। সেখানে জার্মান আর টার্কি এক হয়ে যায়। ওঁর সিনেমায় জার্মান আর টার্কি দেশের সংস্কৃতি মিলে যাবার কথা বেশি হয় বিচ্ছেদের থেকে।হেড অন ছবি এক জার্মান টার্কিশ মহিলার গোঁড়া টার্কিশ পরিবার থেকে মুক্তির পথ খোঁজার গল্প। আসলে এই গল্প হয়তো অনেক টার্কিশ মানুষেরই। কিন্তু দেশের ধর্মীয় গোঁড়ামি, প্রতিবন্ধকতা, সেখান থেকে মুক্তির পথ দেখানো খুব সোজাও তো নয়। ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি করে সেখানে সমাজকে স্থাণু রেখে নিজের শক্তির প্রতিষ্ঠা করে তাকে টিকিয়ে রাখার যে দস্তুর সেখানেই তাৎপর্য আনে হেড অন বা the edge on heaven এর মত ছবি। ছয়জন মানুষ জার্মান আর টার্কি র মধ্যে জীবন আর মৃত্যুর ভেতর যাতায়াত করতে থাকে। শুধু যাওয়া আসার খেলায় ম্যাজিক তৈরি হয়, সীমানা মুছে যায় দুই দেশের অথচ পেছনে টার্কি ফোক মিউজিক আর তার কথা যে মুড তৈরি করে কখন যে সেই ব্যথা, সেই কথা আমাদের কথা হয়ে যায়, নিজেরাই খেয়াল রাখতে পারি না। আর এভাবেই সিনেমা তার ভাষা ভাঙে, জন্ম নেয় আন্তর্জাতিক সিনেমা যার কোনো নির্দিষ্ট ভাষা, দেশ, মানুষ থাকেনা। প্রত্যেক আবেগ ভীষণ চেনা লাগে হোকনা সে জার্মান বা টার্কি কোথাও গিয়ে আকিন রা মানুষের universality র কথা বলতেই থাকেন। আধিপত্য গৌণ হয়। হয়তো হলিউডের ভেতরে চোরা স্রোত বয়ে যায়। মনে মনে আকিন'রা হাসেন আর ছবি বানিয়ে অংশ নেন অস্কার এ। আকিন নিজেকে পাল্টে ফেলেন তার 10 নম্বর ছবিতে। কিছু টিনএজার এর ভিউ পয়েন্ট দিয়ে ছবিতে গল্প বলতে থাকেন। অস্থিরতা, সাহস, দুর্দমনীয় মনোভাব, নিরাপত্তা হীনতার গল্প যেখানে আকিনকে অত্যন্ত ভালোভাবে মানায়। আকিনের ছবিতে মিউজিক এক অনবদ্য অধ্যায়, একটা জার্নি। বিমূর্ত সময় আস্তে আস্তে গ্রাস করছে আমাদের, সময় থমকে যায় হয়তো পেছনে যেতে চায়। আমরা এখানে বসে পৃথিবীর গল্প দেখি আর নিরবচ্ছিন্ন ভাবে অপেক্ষা করি মুক্তির, সেই মুক্তি নিজের স্বাধীনতার, নিজের বেঁচে থাকার, নিজের যৌনতার, অর্থনীতির, মননের, ভালোবাসার। আর এই সব মিলিয়ে মিশিয়ে ডানা ঝাপটিয়ে উঠি আমরা ঝড় সামলাবার জন্য।
প্রিয় ছবিঃ হেড অন, শর্ট শার্প শক।