প্রতিবছর হিন্দি দিবস পালনের প্রথা চালু হয়েছিল ১৯৪৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। ওই দিন ভারতীয় গণপরিষদ হিন্দিকে রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতি দিয়েছিল। তার পর থেকে পরবর্তী ১৫ বছরের জন্য ইংরেজিকে দেওয়া হয়েছিল স্রেফ সহযোগী ভাষার মর্যাদা। এটা ছিল আসলে একটা সমঝোতার অঙ্ক। যাকে মুন্সি-আয়াঙ্গার ফর্মুলাও বলা হয়। এই ফর্মুলার নামকরণ হয়েছিল খসড়া কমিটির সদস্য কেএম মুন্সি ও এন গোপালস্বামী আয়াঙ্গারের দৌলতে।
তাঁরা হিন্দিপন্থীদের চাপে হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন। আর, দক্ষিণ ভারতীয়দের চাপে ইংরেজিকেও একটা সাংবিধানিক মর্যাদা দিয়েছিলেন। এর আগে অবশ্য হিন্দির প্রাধান্য নিয়ে বিতর্ক যেটুকু, সেটা ছিল উর্দুর সঙ্গে। যে অঞ্চলগুলোকে আজ আমরা হিন্দিবলয় বলি, তার বিভিন্ন অংশে ছিল উর্দু ভাষাভাষীদের দাপট। মোগল সাম্রাজ্যের পতনের পর, ১,৮০০ শতকের মাঝামাঝি থেকে হিন্দি আর উর্দু ভাষাভাষীদের দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে।
হিন্দি-উর্দু যুদ্ধ
ইতিহাসবিদ সুমিত সরকার তাঁর বিখ্যাত বই, 'আধুনিক ভারত: ১৮৮-১৯৪৭' (১৯৮৯)-এ উল্লেখ করেছেন যে, "উর্দু উত্তর ভারতের একটি বড় অংশে ভদ্র জনসাধারণের ভাষা ছিল। তা যেমন হিন্দুদের জন্য। তেমনই মুসলমানদের জন্যও। তবে, মুসলমানদের জন্য অনেক বেশি।" তিনি উল্লেখ করেছেন যে ১৮৮১-৯০ সালের মধ্যে ইউনাইটেড প্রদেশে হিন্দির চেয়ে দ্বিগুণ উর্দু বই প্রকাশিত হয়েছিল। সংবাদপত্রের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। হিন্দিতে ৮০০২টি সংবাদপত্রের তুলনায় ১৬,২৫৬টি উর্দু সংবাদপত্র প্রচলিত ছিল।
ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (EIC) ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে শুরু করে। ১,৮০০-এর শতকের মাঝামাঝি সময়ে যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে তার অবস্থানকে সুসংহত করতে শুরু করে, তখন দেশের বড় অংশ মুঘল শাসনের অধীনে ছিল। সরকারি আদালতের ভাষা ছিল ফার্সি। ১৮৩০ সালের মধ্যে, কোম্পানি প্রশাসনের উচ্চস্তরে ফার্সির বদলে ইংরেজি চালু করে। স্থানীয় ভাষাগুলো প্রশাসনের নিম্নস্তরে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। উত্তর ভারতের স্থানীয় জনগণের মধ্যে উর্দুর জনপ্রিয়তার প্রেক্ষিতে, এটি নিম্নস্তরের সরকারি চাকরিতে প্রাধান্য উপভোগ করে এসেছে।
১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে উত্তর ভারতে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলো হিন্দি এবং উর্দু দুটি ভাষাকে বিভক্ত করার সঙ্গেই সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার দ্রুত সম্প্রসারণে জোর দেয়। যদিও উভয় ভাষাই কোনও নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের জন্য একচেটিয়া ছিল না। সেই সময়ের সমীক্ষা বলছে যে কীভাবে ব্রাহ্মণ, রাজপুত এবং বানিয়া বর্ণের লোকেরা হিন্দি স্কুলের দিকে ঝুঁকত। অন্যদিকে ফারসি এবং উর্দু স্কুলগুলো মুসলমান এবং কায়স্থদের মধ্যে বেশি জনপ্রিয় ছিল। ফলস্বরূপ, মুসলমান ও কায়স্থদের সরকারি পরিষেবায় নিয়োগ করা ছিল সহজ।
আরও পড়ুন- রানির শেষকৃত্যে থাকবেন দ্রৌপদী মুর্মু, লন্ডনে যাচ্ছেন রাষ্ট্রপতি
প্রশাসনে স্থান পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা হিন্দির সমর্থকদের গুণাবলী প্রচারে উৎসাহিত করেছিল। সেই সময়ে দাবি উঠতে শুরু করে যে হিন্দি ছিল উপমহাদেশের আদি বাসিন্দাদের ভাষা। মুঘল শাসনের সময় হিন্দি পরাধীন ছিল। ভারতেন্দু হরিশচন্দ্র, যিনি হিন্দি সাহিত্যের জনক হিসেবে পরিচিত এবং পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য, যিনি অখিল ভারতীয় হিন্দু পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, হিন্দিকে জনপ্রিয় করার আন্দোলনের মূল ব্যক্তিত্ব ছিলেন। নাগরি প্রচারিণী সভা-বেনারস, এলাহাবাদে হিন্দি সাহিত্য সম্মেলন এবং রাষ্ট্রভাষা প্রচার সমিতির মতো সংগঠনগুলো হিন্দির হয়ে সুর চড়াতে উত্তর ভারতের বৃহৎ অংশে সংগঠন তৈরি করেছিল।
অবশেষে ১৯০০ সালে, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ এবং অউধের সরকার দেবনাগরি এবং উর্দু লিপিকে সমান মর্যাদা দেয়। এই অঞ্চলের মুসলমানরা হতাশায় ভুগতে শুরু করেন। তাঁরা বিশ্বাস করতে শুরু করেন, তাঁদের ভাষা বিলুপ্ত হওয়ার মুখে। অনেকে যুক্তি দেন যে হিন্দু-মুসলিম বিরোধের বীজ যা উপমহাদেশের বিভাজনে পরিণত হয়েছিল, তা আসলে ১৯ শতকের হিন্দি-উর্দু বিতর্কে নিহিত ছিল। ভাষাগত বিভেদ আরও বাড়ে, যখন পাকিস্তান তার সরকারি ভাষা হিসেবে উর্দুকে বেছে নেয়। আর, ভারত বেছে নেয় হিন্দিকে।
১৯৪৭ সালের পরবর্তী সময়ে হিন্দি নিয়ে বিতর্ক
হিন্দিকে স্বাধীন ভারতের সরকারি ভাষা হিসেবে পছন্দ করার মূলে ছিল, এই ভাষা বৈচিত্র্যময়। এর লিপি এবং উপভাষাকে কেন্দ্র করে দেশে ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে খুঁজে বের করার প্রয়োজনীয়তা। যেহেতু হিন্দি উত্তর ভারতের বৃহৎ অংশের কথ্য ভাষা ছিল, তাই একে দেশের জাতীয় ভাষাগত একীকরণের জন্য একটি নিরাপদ বিকল্প হিসেবে দেখা হত। তবে, দেশের অহিন্দিভাষী অঞ্চলগুলোর একটি বড় অংশ এই ধারণার সঙ্গে সহমত ছিল না।
১৯৪৯ সালের ১২ থেকে ১৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ভারতের গণপরিষদে ভারতের ভাষার মর্যাদা নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। যে বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল, তার মধ্যে ছিল 'সরকারি' ভাষার পরিবর্তে 'জাতীয় ভাষা' শব্দের ব্যবহার; হিন্দি বনাম ভাষা যেমন বাংলা, তেলেগু, সংস্কৃত বা হিন্দুস্তানি; দেবনাগরী লিপি বনাম রোমান লিপি; উচ্চ বিচার বিভাগ এবং সংসদে ব্যবহৃত ভাষা; আন্তর্জাতিক সংখ্যা বনাম দেবনাগরী লিপি।
হিন্দি লেখক শেঠ গোবিন্দ দাস, যিনি সেন্ট্রাল প্রভিন্স এবং বেরার প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, 'এক ভাষা এবং এক লিপি'র পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন এবং পরামর্শ দিয়েছিলেন যে ইংরেজির জায়গায় হিন্দিকে প্রতিস্থাপন করা উচিত। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধিত্বকারী নাজিরুদ্দিন আহমদ যুক্তি দিয়েছিলেন যে, "যে সমস্ত উদ্দেশ্যে ইংরেজিকে ব্যবহার করা হয়েছিল তার জন্যই সরকারি ভাষা হিসেবে ইংরেজিকে চালিয়ে যাওয়া উচিত। যতক্ষণ না একটি 'সর্বভারতীয় ভাষা' বিকশিত হয়, যা চিন্তা প্রকাশ করতে সক্ষম হবে, ততক্ষণ ইংরেজিই ব্যবহার হোক। বিভিন্ন বিষয়ে ধারণা, বৈজ্ঞানিক, গাণিতিক, সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক, দার্শনিক, রাজনৈতিক সবক্ষেত্রেই ব্যবহার হোক ইংরেজির।"
বিধানসভায় কোয়েম্বাটোরের প্রতিনিধিত্বকারী টিএ রামালিঙ্গম চেত্তিয়ার বলেন যে ভাষা সমস্যাটি, "সম্ভবত দক্ষিণের জন্য জীবন ও মৃত্যু। হিন্দি দক্ষিণের বাসিন্দাদের কাছে ইংরেজির মতোই বিদেশি। আমি মনে করি না দক্ষিণ ভারত মোটেও হিন্দি নিয়ে সন্তুষ্ট হবে।” প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু বলেন, 'ইংরেজি জাতির জন্য অনেক ভালো কাজ করেছে। কিন্তু, কোনও দেশ বিদেশি ভাষার ভরসায় সফল হতে পারে না। হিন্দি ভারতের যৌগিক সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। তবে, ভারতের বৃহৎ অংশের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। সেটা হবে ভুল পদ্ধতি এবং বিপজ্জনক পদ্ধতি।"
অবশেষে একটি সমঝোতা হয়েছিল। সেই সমঝোতা অনুযায়ী হিন্দির সঙ্গে ইংরেজিকেও ১৫ বছরের জন্য ভারতের সরকারি ভাষা করা হয়েছিল। ঠিক হয়েছিল, এই মেয়াদ শেষ হলে ইংরেজির পরিবর্তে হিন্দিই সরকারি উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত একমাত্র ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হবে। পাশাপাশি, সংবিধানের ৩৫১ নম্বর অনুচ্ছেদে হিন্দি ভাষার প্রচার এবং বিকাশের কথাও বলা হয়েছিল। যাতে, হিন্দির মাধ্যমে অভিব্যক্তি প্রকাশে কোনও অসুবিধা না-হয়।
প্রতিবাদ থেকে হিন্দি দিবস
যখন ১৫ বছরের মেয়াদ শেষ হয়, তখন অ-হিন্দিভাষী ভারতের বড় অংশে, বিশেষ করে তামিলনাড়ুতে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার ভয়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৯৬৫ সালের জানুয়ারিতে মাদুরাইয়ে দাঙ্গা শুরু হয় এবং শীঘ্রই মাদ্রাজে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিরোধের ফলে কেন্দ্র সরকারি ভাষা আইন পাস করে, যেখানে বলা হয়েছিল যে হিন্দির সঙ্গে ইংরেজিও সরকারি ভাষা হিসেবে বহাল থাকবে। পরবর্তী সময়ে সরকার হিন্দিকে ভারতের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে প্রচার করার অনেক চেষ্টা করেছে। হিন্দি দিবস উদযাপন তার মধ্যে একটি।
ভারতে হিন্দি ভাষাভাষীর সংখ্যা
২০১১ সালের ভাষাগত আদমশুমারি অনুযায়ী, দেশে ১২১টি মাতৃভাষা রয়েছে। যার মধ্যে সংবিধানের ৮ম তফসিলে তালিকাভুক্ত 22টি ভাষা রয়েছে। ৫২.৮ কোটি ব্যক্তি বা মোট জনসংখ্যার ৪৩.৬%, হিন্দিকে তাদের মাতৃভাষা হিসেবে ঘোষণা করেছে। হিন্দি সবচেয়ে বেশি কথ্য ভাষা। পরবর্তী সর্বোচ্চ কথা ভাষা হল বাংলা। এই বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহার করেন ৯.৭ বা (৮%) মানুষ। যা হিন্দিভাষায় কথা মানুষের সংখ্যার চেয়ে এক-পঞ্চমাংশেরও কম। হিন্দি জানেন এমন লোকের সংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে, সংখ্যাটি দেশের অর্ধেকেরও বেশি ছাড়িয়ে গেছে। প্রায় ১৩.৯ কোটি (১১% এর বেশি) ভারতীয়র কাছে হিন্দি তাঁদের দ্বিতীয় ভাষা। সব মিলিয়ে এটি ভারতের প্রায় ৫৫% মানুষের হয় মাতৃভাষা নতুবা দ্বিতীয় ভাষা।
হিন্দি কয়েক দশক ধরে ভারতের প্রধান মাতৃভাষা হয়েছে। প্রতিটি আদমশুমারিতে এর জনসংখ্যা বাড়ছে। ১৯৭১ সালে ৩৭% ভারতীয় হিন্দিকে তাদের মাতৃভাষা বলে জানিয়েছিল। পরবর্তী চারটি আদমশুমারিতে সংখ্যাটা বেড়ে ৩৮.৭%, ৩৯.২%, ৪১% এবং ৪৩.৬% হয়েছে। ১৯৭১ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে, যে ব্যক্তিরা তাঁদের মাতৃভাষা হিন্দি ঘোষণা করেছিলেন, তাঁদের সংখ্যা ২.৬ গুণ বেড়েছে। ২০.২ কোটি থেকে বেড়ে ৫২.৮ কোটি হয়েছে। পাঞ্জাবি, মৈথিলি, বাংলা, গুজরাটি এবং কন্নড় ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। আর, মারাঠি ভাষাভাষীর সংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
ভারতে ইংরেজির অবস্থা
হিন্দির পাশাপাশি ইংরেজি ভারতের সরকারি ভাষার অন্যতম। তবে এটি ৮ম তফসিলের ২২টি ভাষার তালিকায় নেই। এটি ৯৯টি অনির্ধারিত ভাষার মধ্যে একটি। মাতৃভাষার পরিপ্রেক্ষিতে, ২০১১ সালে ভারতে ইংরেজি ভাষাভাষী নাগরিকের সংখ্যা ছিল মাত্র ২.৬ লক্ষ।
Read full story in English