এবারে দুর্গাপুজোতে রক্তাক্ত হয়েছে বাংলার মাটি। পুজোর মধ্যে বিজেপি আন্দোলন জারি রাখলেও দলবদলের তাপ-উত্তাপ এখন অনেকটাই কম। রাজনৈতিক মহলের মতে, পুজোর মরসুম শেষ হলেই ফের দলবদলের নাট্যপালা শুরু হবে রাজনীতির মঞ্চে। শ্যামাপুজোর পর আরও জমে উঠতে পারে বাংলার রাজনীতি। জলঘোলা শুরু শোভন ও বৈশাখীকে দলে নেওয়ার পর। তাই দলে যোগদান নিয়ে এখন অনেকটাই সতর্ক গেরুয়া শিবির।
তবে শুধু বৈশাখী-শোভন নয়, তৃণমূল বিধায়ক অভিনেত্রী দেবশ্রী রায়ের দিল্লির বিজেপি দফতরে হাজিরা নিয়েও জট পাকে। দেবশ্রীর দিল্লিতে যোগ দেওয়া নিয়ে বেঁকে বসেছিলেন শোভন চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর বান্ধবী বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিজ্ঞ মহলের মত, এরপর থেকেই বৈশাখীর নানা মন্তব্যে ক্রমাগত বিপাকে পড়তে হয়েছে বিজেপিকে। দেবশ্রীকে দলে নেওয়া হবে কি না তা নিয়েও জলঘোলা শুরু হয়ে যায়। দলের শীর্ষ নেতা মুকুল রায়, অরবিন্দ মেননদের সঙ্গে শোভন ও বৈশাখীর বৈঠক করেও সে জট কাটেনি। বরং এখন গেরুয়া শিবির থেকে শত যোজন দূরে রাজনীতির এই জুটি। এই ইস্যুতে দলের ছোট ও বড় নেতাদের মন্তব্যে চরম অস্বস্তি পড়েছে দল। পরিস্থিতি এতোটাই জটিল অবস্থান নিয়েছে যে দলের সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহর নেতাজি ইন্ডোরের সভাতেও উপস্থিত থাকেননি শোভন। অবশ্য বলা হয়েছিল ওই দিন বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলেজ গন্ডগোল হওয়ার কারণেই আসতে পারেনি দু'জনের কেউই। কিন্তু ৬ মুরলিধর লেনে কান পাতলে অবশ্য শোনা যায় অন্য গল্প। কলকাতার প্রাক্তন মেয়র ও বৈশাখীর কাজকর্মে দল এতটাই বিরক্ত যে তাঁরা স্বেচ্ছায় বিজেপি ছাড়ুক প্রথম থেকেই তা চাইছে দলের একটা বড় অংশ।
আরও পড়ুন ‘আমি দেবশ্রীর আত্মীয় নই, তাহলে কেন এসেছিলেন?’
এমনকি পদ্মশিবিরে আশ্রয় নিতে বৈশাখী, দেবশ্রী পর বিজেপির রাজ্য দফতরে হাজির হয়েছিলেন ভারতের ক্রিকেট তারকা সামির স্ত্রী হাসিন জাহান। কিন্তু পদ্মশিবির একেবারে সতর্ক। বেনোজলে বাঁধ দিতে তাই দেরি করতে রাজি নয় বিজেপি। কারণ দলের রাজ্য নেতারাই চাইছেন না বিতর্কিত ব্যক্তিদের নিয়ে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো করে দিতে। এমনিতেই দলে যোগ দেওয়ার দিন থেকে বৈশাখী ও শোভনের বক্তব্যে যথেষ্ট অপ্রস্তুত অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে দল। তা স্বীকারও করে নিয়েছেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। এর আগে একদা তৃণমূলের লাভপুরের বিধায়ক মণিরুল ইসলামকে দলে নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছিল বিজেপিতে। তবু মণিরুল চিঠি দিয়ে বিষয়টা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শোভনের বান্ধবীর বাক্যবাণে অস্বস্তি বেড়েছে দলের। বিজেপি দফতরে সংবর্ধনার দিনও বৈশাখীর 'গোমরা' মুখ প্রত্যক্ষ করেছেন অনেকেই।
বিজেপি রাজ্য নেতৃত্ব তাই আর চাইছে না এধরনের কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে দলের মুখ পোড়াতে। দল বদল করিয়ে বিজেপি দখল নিয়েছিল উত্তর ২৪ পরগনার একাধিক পুরসভা। একের পর এক সেই সব পুরসভা হাতছাড়া হয়েছে বিজেপির। তাই দলবদল করিয়ে পুরসভা দখলের দিকে এখন আর নজর নেই পদ্ম শিবিরের। দেবশ্রীর বিষয়েও আর আগ্রহ দেখাচ্ছে না দল। অভিজ্ঞ মহলের মতে, তৃণমূল বিধায়ক যখন বিজেপির সর্বভারতীয় দফতরে যান তখন নিশ্চয় ভ্রমনে যাননি। তিনি কার মাধ্যমে বিজেপি গিয়েছিলেন সেই রহস্য ফাঁস করেছিলেন দিলীপ ঘোষ। এমনকি তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রের নামও নিয়েছিলেন রাজ্য বিজেপির সভাপতি। আর এতেই ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে দলবদলের রাজনীতি।
আরও পড়ুন ‘বৈশাখী গেলে যাক, দেবশ্রীকে বিজেপিতে নিন’
সম্প্রতি বিজেপির রাজ্য দফতরে গিয়েছিলেন হাসিন জাহান। কিন্তু তাঁকে বিজেপিতে নেওয়ার ব্যাপারে কোনও আগ্রহ দেখায়নি দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। বরং তারা স্পষ্ট করেছে তাঁরা দলে নিতে চান না হাসিনকে। এমনিতেই বৈশাখী এবং দেবশ্রীকে নিয়ে বেশ কিছু দিন বাগযুদ্ধ চলেছে রাজ্য-রাজনীতিতে।সেই কাঁদা ছোড়াছুড়ি পৌঁছেছিল চরমে। দলবদলের এই রাজনীতিতে বিজেপির অন্দরেই সৃষ্টি হয়েছিল এক হাস্যকর পরিস্থিতির। তার উপর আরএসএস অনেকের ক্ষেত্রেই দলে যোগ নিয়ে আপত্তি জানিয়ে এসেছে। তবে তা কেবলমাত্র রাজনীতির বাধ্যবাধকতা এমন কথা বলে যুক্তিও সাজিয়েছেন দলের একাংশ। কিন্তু শোভন ও বৈশাখীকে দলে নিয়ে যে ভাবে দলের মুখ পুড়েছে তারপর থেকে যে একটু মেপেই পা ফেলছে বিজেপি, এমনটা স্পষ্ট।
বৈশাখী, দেবশ্রী, হাসিনের পর আর বিতর্ক চাইছে না দল। দলের শক্তি বৃদ্ধির থেকে ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে বলে মনে করছেন শীর্ষ নেতৃত্ব। তৃণমূলের সঙ্গে লড়াই করে রাজ্যে ১৮টি লোকসভা আসনে ইতিমধ্যেই জয় পেয়েছে বিজেপি। সামনেই বিধানসভার ভোট। তাই দলবদলের নীতিতে এখন সতর্কতাকে হাতিয়ার করেই পা ফেলতে চায় বিজেপি।