Advertisment

করোনায় গণতন্ত্র, এবং 'ফেক নিউজের' দাপট

আমেরিকায় এত মানুষ মারা গেছেন যে কবর দেওয়ার জন্য আলাদা জায়গা নেই। একসঙ্গে অস্থায়ী বড় গর্ত খুঁড়ে কবর দেওয়া হচ্ছে। এসব শুনলে মনে হচ্ছে, আমরা তো অনেক ভালো আছি।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদে চলছে দমকল বিভাগের পক্ষ থেকে জীবাণু নাশক স্প্রে করার কাজ। ছবি: প্রেমনাথ পাণ্ডে, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

ভারতে ভাবা যায়? ভারত কেন, এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশে এমনটা সম্ভব কিনা জানি না। অন্তত এমন কোন ঘটনা ঘটেছে বলে আমার তো জানা নেই। এই করোনা কাণ্ডের সময়ই এমন ঘটনা দেখছি বিবিসি-তে।

Advertisment

অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্য সরকারের শিল্পকলা মন্ত্রী ডন হারউইনের কাহিনী। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময় রাজ্যে অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের দায়ে দুদিন আগে তাঁকে জরিমানা করেছিল দেশটির পুলিশ বিভাগ। নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের প্রমাণ সহ অভিযুক্ত হন ডন হারউইন। এবার সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে তিনি মন্ত্রীর পদ থেকেও ইস্তফা দিলেন।

অভিযোগ কী ছিল? অভিযোগ হলো, ডন হারউইন কয়েক সপ্তাহ ধরে তাঁর সিডনির পূর্ব শহরতলির মূল বাড়ি থেকে প্রায় এক ঘন্টা দূরত্বের কেন্দ্রীয় উপকূলবর্তী এলাকার অবকাশকালীন বাড়িতে যাতায়াত করছিলেন। সরকার করোনার সময় এই যাতায়াত অনুচিত বলে মনে করে। শুধু তাই নয়, শহরতলিতে ইস্ট গার্ডেন্স ওয়েস্ট ফিল্ডে একটা শপিং সেন্টার আছে। সেখানে গিয়ে তিনি নিজে কেনাকাটাও করছিলেন।

আরও পড়ুন: নিজে কী খেলেন তার ছবি দিন, তবে অন্যের খাওয়ার ব্যবস্থা করতেও ক্ষতি কী?

আমাদের দেশে তো মন্ত্রীরা নিজে সকালে গিয়ে দোকানে পাঁউরুটি দুধ ডিম এসব কেনেন এমনটা দেখা যায় না, ভাবাও যায় না। তা অস্ট্রেলিয়ার এই মন্ত্রী রোজ সকালে গিয়ে বোধহয় একঘেয়েমি কাটাতে বাজার করতেও শুরু করে দিয়েছিলেন। প্রমাণসহ এই খবর প্রকাশিত হয় স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে। এটা জানাজানির পর স্থানীয় পুলিশ মন্ত্রীকে ১ হাজার ডলার জরিমানা করে। তিনি এরপর ক্ষমা চান।

ক্ষমা চেয়ে তিনি সিডনির বাড়িতে ফিরেও আসেন। রাজ্যবাসীর কাছে সরকার তাঁর আচরণের জন্য ক্ষমা চান। পরে তিনি দুঃখ প্রকাশ করে পদত্যাগও করেছেন। নিউ সাউথ ওয়েলস-এর প্রিমিয়ার গ্ল্যাডিস বেরেজিক্লিয়ান তাঁর ইস্তফাপত্র গ্রহণ করেছেন। রাজ্যের পুলিশ কমিশনার মিক ফুলার বলেছেন, কেউই আইনের ঊর্ধে নন। জনস্বাস্থ্য আদেশ লঙ্ঘনের দায়ে হারউইনকে জরিমানা করা হয়। তবে তিনি ইস্তফাও দিলেন। এটা বড় গণতান্ত্রিক দৃষ্টান্ত। আমাদের দেশে বড় বিরল।

তবে এ সপ্তাহে আপনাদের সঙ্গে সাপ্তাহিক আড্ডায় করোনা প্রসঙ্গে ভারত পরিস্থিতি নিয়েই আলোচনা করা যেতে পারে।

গোটা পৃথিবীতে করোনা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ১৭ লক্ষ অতিক্রম করেছে। এসবের মধ্যে ভারতেও করোনা আক্রান্ত সংখ্যা ৮০০০ ছাড়িয়ে গিয়েছে, মৃতের সংখ্যা এখন সরকারিভাবে ২৭৩। সত্যি বলছি, প্রত্যেকদিন সন্ধ্যায় টিভির দিকে তাকিয়ে এই মৃত্যুর সংখ্যা গুনতে ভাল লাগছে না। ১৪ এপ্রিলের জায়গায় ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ইতিমধ্যেই অনেক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী লকডাউন দীর্ঘায়িত করে দিয়েছেন।

আরও পড়ুন: করোনা নিয়ে ধর্মের রাজনীতি করলে লোকসান আমাদেরই

বাংলাদেশেও মৃত্যুর সংখ্যা এখনও পর্যন্ত ৩০। ৪৮২ জন আক্রান্ত। এর মধ্যে ৩৬ জন সেরে উঠেছেন। তবে ভারত যেভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা WHO, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যেভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন, তাকে রাজনীতির ঊর্ধে থেকে প্রশংসা করা প্রয়োজন।

দেখুন, বাংলাদেশে মৃত্যুর সংখ্যা ৩০, পাকিস্তানে সরকারিভাবে ৮৬। ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার কিছু বিশেষ অসুবিধেও আছে। যেমন গুজব। গুজব তো কোনও বিশেষ সার্বভৌম দেশের নয়। গুজবের বিশ্বায়ন হয়েছে। ভারতেও প্রথম দিকে হোয়াটস্যাপ এবং ইন্টারনেট ব্যবহার করে নানা ধরনের গুজব ছড়ানো হচ্ছিল।

একটা ছোট্ট ঘটনা বলছি, এই যে কিছু দিন আগে দিল্লির আনন্দ বিহার বাস টার্মিনালে একসঙ্গে প্রচুর বিহার এবং উত্তরপ্রদেশের মানুষ জড়ো হয়েছিলেন, তার কারণ কী বলুন তো? তার কারণ ছিল একটা ছোট্ট গুজব যা দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়েছিল, যে ওখানে পাটনা এবং এলাহাবাদ যাওয়ার বাসের ব্যবস্থা হয়েছে। ব্যস, অসংগঠিত শ্রমিকের দল, যাঁদের দিনগত রুজিরুটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পকেটে পয়সা নেই, খেতে পাচ্ছেন না, ভীতসন্ত্রস্ত, কী করবেন বুঝতে পারছেন না, তাঁরা দলবদ্ধভাবে বাস স্ট্যান্ডে এসে আরও আতঙ্ক ছড়ান। করোনার প্রকোপ বাড়ে। এখন তো হোয়াটস্যাপ বার্তা পাঠানোর ব্যাপারেও নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা হয়েছে।

বাংলাদেশে গুজব ছড়ানোর জন্য অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বরগুনার আমতলী উপজেলার আওয়ামী লীগ সভাপতি, সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, তথা মুক্তিযোদ্ধা জি এম দেলোয়ারের মৃত্যু করোনাভাইরাসের কারণেই হয়েছে। তাও জানা গিয়েছে। গণতন্ত্রের সমস্যা যেমন ভারতে, তেমন আপনাদের দেশেও। প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে দেলোয়ারের জানাজায় (শেষ যাত্রায়) সহস্রাধিক মানুষ অংশগ্রহণ করেন। বরগুনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমতলী উপজেলায় লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে।

গুজবের কথা হচ্ছিল। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস নিয়ে গুজব ছড়ানোর জন্য ৫০ জনকে আটক করা হয়েছে। বিরোধী প্রতিপক্ষরা ভারতেও বলছেন, ঢাকাতেও বলছেন, গুজব ছড়ানোর অজুহাতে সরকার বিরোধী সমালোচকদের আসলে আটক করছেন। তবে গুজব ব্যাপারটা এখন গোটা পৃথিবীতেই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এক প্রাক্তন ভারতীয় আমলা আমাকে বলছিলেন, টিভিতে খবর না শুনলে আমি 'uninformed' থাকি বটে, কিন্তু টিভি দেখলে সমস্যা হচ্ছে ''misinformed' হই।

আরও পড়ুন: করোনা আতঙ্কেও সক্রিয় রাজনীতি

টিভি সম্পর্কে এই রসিকতার পক্ষে আমি নই, কারণ করোনা দুর্যোগে ঘরে বসে সামাজিক একাকীত্বে থেকে এই টিভি চ্যানেলই তো দুনিয়ার সমস্ত খবর আমাকে দিচ্ছে। ড্রয়িং রুমে বসেই শুনছি। আসলে fake news আর গুজবের দাপট তা বেশি সোশ্যাল মিডিয়ায়।

একটা বই পড়ছিলাম, 'India Misinformed, the True Story'। লেখক প্রতীক সিনহা, ডঃ সুমাইয়া শেইখ এবং অর্জুন সিদ্ধার্থ। এই বইতে মিথ্যে প্রচারের নানা নমুনা দেখানো হয়েছে। দলমত নির্বিশেষে। নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধেও হচ্ছে, রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধেও হচ্ছে। এই বইটিতে একটি উদাহরণ দেওয়া হয়েছে, যে প্রাক্তন সিবিআই প্রধান অলোক ভার্মা ইস্তফা পাঠিয়েছেন মোদীর কাছে, তাতে লিখেছেন, "স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রধানমন্ত্রীকে এ চিঠি লিখছি"। ওপরে এই ফেসবুক/টুইটার/হোয়াটস্যাপ গ্রুপে লেখা - 'আই সাপোর্ট রবিশ কুমার - ইট ইস ভাইরাল বিগ ব্রেকিং নিউজ'। বাস্তব হলো, সেদিন অলোক ভার্মা ইস্তফা দেন, কিন্তু তিনি ইস্তফাটা দেন পার্সোনেল ও ট্রেনিং মন্ত্রকের কাছে। তাঁর চিঠিতে নরেন্দ্র মোদীর কথা বলাই হয়নি।

করোনার মৃত্যু ও ভয়াবহতা নিয়ে গুজব ছড়ানো বড় গর্হিত অমানবিক অপরাধ। বাংলাদেশের কত মানুষ পৃথিবীর কত প্রান্তে ছড়িয়ে আছেন। কতজন আক্রান্ত। কত মারা যাচ্ছেন। সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের মানুষ বেশি আক্রান্ত হয়েছেন কারণ দূতাবাস জানিয়েছে, ওঁরা একসঙ্গে দলবদ্ধ ভাবে থাকতেন। একটা পার্কে গিয়ে একসঙ্গে জমায়েত করতেন। আমেরিকায় এত মানুষ মারা গেছেন যে কবর দেওয়ার জন্য আলাদা জায়গা নেই। একসঙ্গে অস্থায়ী বড় গর্ত খুঁড়ে কবর দেওয়া হচ্ছে। এসব শুনলে মনে হচ্ছে, আমরা তো অনেক ভালো আছি।

অনেক বাংলাদেশি ব্যবসায়ী বিদেশে গিয়ে নিজেদের রেস্ত শেষ করে ফেলেছেন, এখন যে কোনও মূল্যে দেশে ফিরতে চাইছেন। বাংলাদেশ দূতাবাসের ওপর চাপ দিচ্ছেন। কোনও উপায় নেই। বিদেশে কত মানুষ, কত শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে, নানা দেশে তাঁদের বরফ দিয়ে রাখা হয়েছে অস্থায়ী ভাবে, শেষকৃত্য করতে চাইছে দূতাবাস, পরিবার বলছেন না, একবার শেষবারের মত দেহটা দেখব।

এসব শোনার পর মনে হয়, না, কষ্ট করে হলেও নিয়মটা মেনেই চলি।

Advertisment