(শুধু শহর কলকাতা নয়, এ রাজ্যের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে এমন অনেক স্থাপত্য, যারা নিত্য চোখের সামনে থাকে বটে, কিন্তু তার ইতিহাস ও তার সঙ্গে বিজড়িত কাহিনিগুলি অজ্ঞাতই থাকে। এ রাজ্যের কিছু ‘হেরিটেজ’ হিসেবে চিহ্নিত ও ‘হেরিটেজ’ ঘোষণার অপেক্ষায় থাকা স্থাপত্যের কথা তুলে আনছেন দুই স্থপতি সুতপা যতি ও সায়ন্তনী নাগ। সে সব স্বল্প-জানা কথা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায়।)
‘আর্মানি গির্জের কাছে আপিস। যাওয়া মুস্কিল হবে। পূর্বদিকের মেঘ ইস্পাতের মতো কালো’- সেই কোন ছোটবেলায় পড়েছিলেন সহজপাঠের দ্বিতীয় ভাগে। রবিঠাকুর বর্ণিত ‘ইস্পাতের মতো কালো’ মেঘ আকাশে না থাকলেও আর্মানি গির্জে, অর্থাৎ আর্মেনিয়ান চার্চে যাওয়া বেশ মুশকিল। বড়বাজারের অজস্র দোকান, ফুটপাথে উপচে পড়া তাদের পসরা, ঠেলা গাড়ি ও দলে দলে মুটেমজুর, পদচারীর ভিড়ে প্রায় হারিয়ে গেছে ২ নম্বর আর্মেনিয়ান স্ট্রীটে কলকাতার প্রাচীনতম চার্চটির মূল প্রবেশপথ, যা খোলা হয় কেবলমাত্র সার্ভিসের সময়। বাকি সময় যাতায়াত পাশের গেট দিয়ে।
আর্মেনিয়ানদের কলকাতায় আগমন সতেরোশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। প্রথম ইওরোপিয় জাতি হিসেবে এ দেশে আর্মেনিয়ানরা এসেছিল পার্সিয়া, আফগানিস্তান, তিব্বতের পথ ধরে, প্রতিষ্ঠা করেছিল বাণিজ্যকেন্দ্র। বস্তুত, তাদের হাত ধরেই ভারতে খ্রিস্টান ধর্মের প্রবেশ। কলকাতায় আসা আর্মেনিয়ানরা প্রত্যেকেই ছিলেন খ্যাতনামা ধনী ব্যবসায়ী, খুব দ্রুত তাঁরা এ শহরে গড়ে তোলেন নিজেদের উপনিবেশ, একাধিক বাড়ি, স্কুল, চ্যাপেল। ১৬৮৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাঁদের জন্য বানিয়ে দিয়েছিল একটি ছোট কাঠের চার্চ, বর্তমান চার্চটির দক্ষিণ-পূর্ব অংশে। ১৭০৭ সালে এক বিধ্বংসী আগুনে পুড়ে যায় সেটি। তারপর ১৭২৪ সালে জনৈক আগা জ্যাকব নাজারের উদ্যোগে তৈরি হয় আজকের ‘আর্মেনিয়ান হোলি চার্চ অব নাজারেথ’। ১৭৩৪ সালে হাজারমল পরিবারের অনুদানে তৈরি হয় ক্লক টাওয়ার সহ ঘন্টাঘরটি। এই পরিবারের বহু সদস্যের সমাধি রয়েছে চার্চ সংলগ্ন জমিতে। আসলে এই জমিটি ১৭২৪ সালের আগে পর্যন্ত সমাধিক্ষেত্র হিসেবেই ব্যবহৃত হত। জমি দিয়েছিলেন কেনানেনটেক ফানুস। স্থপতি ছিলেন ইরানের গ্যাভন্ড (মতান্তরে হেভন্ড বা কাভন্ড)। ১৭৯০ সালের পর আভ্যন্তরীণ কিছু সজ্জার পরিবর্তন ঘটানো হয়, তৈরি হয় পাদ্রিদের জন্য সংলগ্ন বাড়িটি এবং চারপাশের প্রাচীর। অন্দর সজ্জার পরিকল্পনা ছিল ক্যাটচিক আরাকিয়েল-এর। ঘন্টাঘরের ঘড়িটিও তাঁরই দান। বিভিন্ন ধনী আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ীদের অর্থানুকূল্যে গড়ে উঠেছে মূল চার্চের বাইরের বাড়িগুলিও। তাঁদের মধ্যে একজন অ্যারাটুন স্টিফেন, কলকাতার সুবিখ্যাত গ্র্যান্ড হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা ও মালিক।
যেসব মানুষের দানে গড়ে উঠেছে হোলি চার্চ অব নাজারেথ, তাঁদের নাম চার্চের ভিতরে ও বাইরে নানা পাথর ফলকে খোদাই করা আছে। মূল ফটকে প্রাচীন আর্মেনিয়ান হরফে যা লেখা আছে, তা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘পবিত্র মাতা নাজারেথ দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর হাত উন্মুক্ত প্রসারিত করে, তাঁর সন্তানদের অনুগ্রহের স্তন্যদুগ্ধে লালন করার জন্য’।
কলকাতার আর্মেনিয়ান সমাজের প্রায় সকলেই ইরানের জুলফার আর্মেনিয়ানদের বংশোদ্ভূত, জুলফার চার্চ কতৃপক্ষের থেকেই যাবতীয় অনুশাসন ও সিদ্ধান্ত এখানে পালিত হয়। আর্মেনিয়া বা এচমিয়াদজিন অ্যাপোস্টোলিক চার্চের সঙ্গে যোগাযোগ নেই বললেই চলে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে কলকাতার আর্মেনিয়ানরা বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অধিকার রক্ষার চুক্তি করেছিল ১৬৮৮ সালের ২২ জুন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে স্বাক্ষর করেন স্যার জোসিয়া চাইল্ড আর আর্মেনিয়ানদের পক্ষ থেকে ছিলেন খোজা সারহাদ আর খোজা ফানুস। এই চুক্তির শর্ত অনুসারে ভারতের যে কোনো জায়গায় যদি অন্তত চল্লিশজন আর্মেনিয়ান বাস করে, তবে তাঁদের জন্য একটি চার্চ বানিয়ে দিতেই হবে, এবং সেই চার্চের যাজককে ৫০ পাউন্ড বেতন দিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে চার্চগুলিই ছিল আর্মেনিয়ানদের যাবতীয় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র। এই চার্চটি ছাড়াও কলকাতায় আর্মেনিয়ানদের দুটি চ্যাপেল আছে, ট্যাংরার সেন্ট মেরিজ চ্যাপেল আর পার্ক সার্কাসের সেন্ট গ্রেগরি চ্যাপেল, যেটিকে আর্মেনিয়ানরা ‘ছোট চার্চ’ নামে ডাকেন। এছাড়া চুঁচুড়া শহরে রয়েছে আর্মেনিয়ানদের আরো পুরোনো সেন্ট জন চার্চ। এই সবকটি চার্চ এবং তাদের যাবতীয় স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বর্তমানে কলকাতা হাইকোর্টের আদেশানুসারে এক অফিশিয়াল ট্রাস্টির মাধ্যমে সরকার দেখাশোনা করেন।
হোলি চার্চ অব নাজারেথের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলেই বাইরের কোলাহল মুখরিত শহর এক লহমায় যেন নীরব হয়ে যায়। প্রাচীন আম ও জাম গাছে ভরা শান্ত পরিবেশ। প্রার্থনা কক্ষের দুদিকের দেওয়ালের ওপরদিকে সারসার গথিক স্টাইলের রোজ উইন্ডোর মত গোলাকৃতি জানলা, বিশালাকার ফ্লুটেড গোলাকার থাম, মাথায় কাঠের কড়িবর্গার সঙ্গে স্টিলের জয়েস্ট। রিসেপশন হলের দক্ষিণ দেওয়ালে লাগানো একটি কালো পাথরের ফলকে আর্মেনিয়ান হরফে লেখা আছে, নিউ জুলফা-র অ্যারাটুন স্টিফেন তাঁর স্বর্গীয় পিতামাতা স্টেফান আর হান্না এবং ভাই মার্টিরোজের স্মৃতিতে ১৯০০ সালে চার্চের মেঝে সাদা-কালো মার্বেল পাথরে ঢেকে দেন। ১৯২৭ সালে ছেষট্টি বছর বয়সে মৃত খোদ অ্যারাটুন সাহেবও সমাহিত হন এই চার্চের প্রাঙ্গণেই। একটি সর্পাকার সিঁড়ি উঠে গেছে গ্যালারিতে, যেখানে দেওয়াল ফ্রেসকো ও পেইন্টিং-এ সুসজ্জিত। চার্চের বেদীতে রয়েছে একটি ক্রুশ, গসপেল-এর ভাষ্য আর বারোটি মোমদানি যা যীশু খ্রিষ্টের বারোজন দূতের প্রতীক। বেদী ইংরেজ শিল্পী এ ই হ্যারিস কৃত তিনটি অপূর্ব তৈলচিত্রে সজ্জিত – ‘হোলি ট্রিনিটি’, ‘লাস্ট সাপার’ আর ‘দ্য এনশ্রাউডিং অব আওয়ার লর্ড’। চার্চের পূব দিকের দেওয়ালে আটকানো এক পিতলের ফলক থেকে জানা যায়, কারাপিয়েট বালথাজার ও হোসান্না বালথাজারের স্মৃতির উদ্দেশ্যে তাঁদের সন্তানরা ১৯০১ সালের জুলাই মাসে চার্চকে এই তিনটি ছবি দান করেছিলেন।
চার্চের প্রাঙ্গণে এমনকি চার্চের ভেতরেও নানা মাপের ও আকারের সমাধিফলকের ছড়াছড়ি, নজর কাড়ে শ্বেতপাথরের পরী, কারুকাজ করা ক্রুশ, ঈগল, বাইবেলের খোলা পাতা। সাদা মার্বেল ও কালো জেড পাথরের তৈরি ফলকের অধিকাংশ লেখাই আর্মেনিয়ান ভাষায়। এখানেই রয়েছে কলকাতার প্রাচীনতম সমাধিটি। ১৬৩০ সালে ১১ জুন রেজাবীবেহ সুকিয়াস নামে এক আর্মেনিয়ান মহিলাকে এখানে কবর দেওয়া হয়েছিল। তবে এ ব্যাপারে খানিক বিতর্কের অবকাশ আছে। কোনও কোনও ঐতিহাসিকের মতে মিসেস সুকিয়াসের মরদেহের অবশেষ পরবর্তীকালে চার্চ সমাধিক্ষেত্রের অন্যত্র কোথাও সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। মূল চার্চের প্রবেশপথের বাঁ দিকে আছে ‘আজদারার’ কাগজের সম্পাদক ও প্রতিষ্ঠাতা রেভারেন্ড হারুথিয়াম শমাভোনিয়ান (১৭৫০-১৮২৪)-এর একটি আবক্ষ মূর্তি, যাকে বলা হত ‘ফাদার অব আর্মেনিয়ান জার্নালিজম’, যিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ইরানের সাংস্কৃতিক পীঠস্থান শিরাজ শহরে। রয়েছে কলকাতার আর্মেনিয়ান কলেজ এবং ফিলানথ্রপিক অ্যাকাডেমির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আসত্বাসাতুর মুরাদখান-এর সমাধি (মৃত্যু ২৯ এপ্রিল ১৭৯৯)। উত্তরদিকের পোর্টিকোর হাতার নীচে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত অজস্র আর্মেনিয়ানদের স্মৃতির উদ্দেশে নির্মিত একটি সৌধ যা তৈরি হয়েছিল ১৯৬৫-র ২৪ এপ্রিল, বিশ্বযুদ্ধের বিপর্যয়ের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে। আরও একটি কারণে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য এই চার্চটি। বিংশ শতকে রাশিয়ান বংশোদ্ভূতদের জন্য রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চ সার্ভিসের উদ্দেশ্যে দরজা খুলে দিয়েছিল এই চার্চ, সেযুগের পরিপ্রেক্ষিতে যা খুবই বিরল। শোনা যায় ইওরোপেও আর্মেনিয়ানরাই প্রথম জাতি যারা খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিল।
আরও পড়ুন, ছোট হয়ে আসা দিনগুলোতেই শহরে আবার বড়দিনের প্রস্তুতি
অতীতে একবার আর্কিওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে আর্মেনিয়ান চার্চ কতৃপক্ষের বিরোধ ঘটে। সরকারের অনুমতি ছাড়াই কর্তৃপক্ষ একাধিক সমাধিফলক ও স্মারকফলক ধ্বংস করেন গাড়ি ঢোকার রাস্তা ও পার্কিং বানানোর জন্য। আর্কিওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার মতে এই কাজ রীতিমত অপরাধ, কারণ এই ক্ষতি অপূরণীয়। আর্কিওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার তদানীন্তন ডিরেক্টর ডক্টর পি কে মিশ্রের মতে, ‘এ সব সৌধ ইতিহাসের অমূল্য দলিল। প্রতিটি সৌধ একটি নির্দিষ্ট সময়ের কাহিনি শোনায়। প্রাচীন কলকাতার আর্মেনিয়ানদের বংশপরম্পরায় খুঁজে পাওয়া যায় এখানে। মার্বেল ও লোহার তৈরি এসব সমাধি ও স্মৃতি ফলকগুলির নষ্ট হয়ে যাওয়া ইতিহাস নষ্ট করার চেয়ে কম নয়।’ চার্চ কর্তৃপক্ষের এই হঠকারী সিদ্ধান্ত সব শ্রেণির খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ও ঐতিহ্যপ্রেমী মানুষের ধিক্কারের কারণ হয়েছিল।
২০০৮ সালে তিনশো বছর পূর্ণ করেছে ‘আর্মানি গির্জে’। নিয়মিত সার্ভিস এখনো হয় এখানে। ৬ জানুয়ারি দিনটি প্রতিবছর পালিত হয় আর্মেনিয়ান ক্রিস্টমাস হিসেবে। আর চার্চ প্রাঙ্গণে ২৪ এপ্রিল দিনটি আর্মেনিয়ান গণহত্যা স্মরণ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন হোলি চার্চ অব নাজারেথ-কে হেরিটেজ বিল্ডিং ঘোষণা করেছে।