Advertisment

অমরত্বের প্রত্যাশা

১৯৫১ সালের ২৯শে জানুয়ারি। ঠান্ডায় কাঁপুনি ধরে যায়, সর্বাঙ্গ শিরশির করে। হেনরিয়েটা হাঁটতে পারছে না, কষ্টে প্রাণ বেরিয়ে আসছে কিন্তু থামা যাবেনা- এটা সাদাদের জায়গা।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Science and Scientific Research

ততদিনে বিজ্ঞানীরা বুঝে গেছেন ক্যান্সারে যে আসলে কোষের মৃত্যু হয়না, উলটে তারা বছরের পর বছর বাড়তেই থাকে।

১.
ঘুরন্ত ব্যারেলটার সামনে চুপ করে বসে ছিলেন ড. ম্যারি ক্যুবিচেক। আজ মনটা বারবার অন্যদিকে ঘুরে যাচ্ছে- দশটা পায়ের আঙুল। বাঁ পায়ের মধ্যমার উপরে একটা মাছি এসে বসছে মাঝেমাঝেই, আঙুলগুলোয় দায়সারা ভাবে লাল নেলপলিশ লাগানো যারা নখ থেকে বেরিয়ে হেনি'র কালো, মৃত চামড়ায় লেগে আছে। কী-ই বা বয়েস ছিল মেয়েটার? একত্রিশ বছর একটা আয়ু হল! বাচ্চাগুলোরই বা কী হবে এবার? ম্যারি আজ কিছুতেই কাজে মনোনিবেশ করতে পারছিলেন না, কিন্তু বৈজ্ঞানিকদের মানবিকতা থাকতে নেই। তাছাড়া এই প্রথম পেশেন্ট তো নয়! এর আগে এই ল্যাবেই গাদা স্যাম্পল এনেছেন তিনি। অজস্র মৃত্যু দেখেছেন এই জন হপকিন্সে বিগত চার- পাঁচ বছরে। তবে? কী ছিল হেনির মধ্যে যা এভাবে ঘেঁটে দিচ্ছে সবকিছু! ব্যারেলটা সমানে ঘুরেই যাচ্ছিল, মার্গারেট ম্যাডাম একটু আগে খেতে বলে গেছিলেন, যাওয়া হয়নি।

Advertisment

"ইটস অ্যালাইভ! ভাবতে পারছ ম্যারি? উই ফাইনালি ডিড ইট!" এর মধ্যেই পেছনে কখন ড. গে এসে দাঁড়িয়েছেন খেয়াল হয়নি। ড. বলে চললেন, "আমরা সায়েন্স বদলে দিয়েছি ম্যারি, তোমার হেনি অমর হয়ে গেছে। গোটা পৃথিবী কৃতজ্ঞ থাকবে হেনরিয়েটা ল্যাক্সের কাছে!" ড. ক্যুবিচেক বিশেষ কিছু না বলে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন, মাথার ভেতর থেকে লাল নেলপলিশের ভেংচিটা কিছুতেই যাচ্ছেনা। ড. জর্জ অটো গে তখন আনন্দে ফুটছেন, স্ত্রী মার্গারেটও। এত বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম শেষ পর্যন্ত সফল- ঘুরন্ত ব্যারেলটায় তখন গিজগিজিয়ে বেড়ে চলেছে প্রাণ, কিছু জীবন্ত সার্ভিক্সের কোষ যার মালিক পায়ে লাল রঙ মেখে এখন মাটির নীচে ঘুমোচ্ছে।

আরও পড়ুন, কিচিরমিচিরের ভাষান্তর

২.

আলআবামা, ১৯৩২ সাল। ইউ.এস পাব্লিক হেলথ সার্ভিস শুরু করল তাদের কুখ্যাত টাস্কিজি সিফিলিস এক্সপেরিমেন্ট যেখানে ছ'শো জন অ্যাফ্রিকান-অ্যামেরিকান মানুষকে বেছে নেওয়া হয়েছিল সিফিলিস রোগের বিস্তার নিয়ে গবেষণার জন্যে। হিসেব সহজ, তাদের খেতে পরতে দেওয়া হবে, বিনিময়ে বিভিন্ন ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলবে শরীরে। নিগ্রো তো, বেচারারা মেনেও নিয়েছিল সবকিছু। এরপর সময় এগোয়, ১৯৪৭ সালে বেরিয়ে যায় সিফিলিসের ওষুধ পেনিসিলিন। এক্সপেরিমেন্টটা কতদিন চলেছিল জানেন? ১৯৭২ সালে। মানুষের টনক নড়ার পরে কেঁচো খোঁড়া শুরু হলে জানা যায় যে ওই ছ'শো জন পেশেন্টদের ওষুধের নামে দিনের পর দিন স্রেফ প্লাসিবো দেওয়া হত যাতে বৈজ্ঞানিকরা দেখতে পারেন সিফিলিস ঠিক কতটা ক্ষতি করতে পারে মানবদেহের! অবাক হচ্ছেন? রাগে গা জ্বলছে? তবে আরো শুনুন, নিরীক্ষা আরও এগোলে জানা যায় ওই ছ'শোজন নিগ্রোর মধ্যে অজস্র সুস্থ মানুষের দেহে জোর করে সিফিলিসের ব্যাক্টেরিয়া ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল গবেষণার নামে। কেন দেবে না? ওরা তো নিগ্রো, ওদের চামড়ায় যে মেলানিন বেশি সেটার খেসারত দিতে হবে না! তা না হলে সাদা চামড়া আর সুপিরিয়র রেস হল কই?

হেনি এসব জানত না। টাস্কিজি সিফিলিস এক্সপেরিমেন্ট শুরু হয় যখন হেনরিয়েটা ল্যাক্স চোদ্দ বছরের এক বাচ্চা এবং অন্তঃসত্ত্বা। ভার্জিনিয়ার কান্ট্রিসাইডের ছোট্ট একটা বাড়ি, ওপরতলায় থাকেন দাদু টমি ল্যাক্স এবং নিচে ভাগ্নে ডেভিড যার সঙ্গে পরবর্তীকালে হেনির বিয়ে হয়েছিল। দিন কেটে যেত নিজের মত, সারাদিন তামাকের চাষ, তার প্যাকিং, ট্রান্সপোর্টেশন আর রাত হলে ছাঁট তামাক থেকে সিগারেট বানানো। আলো পড়তেই পাড়ার সমস্ত মেয়েরা মিলে চলে যেত চিলেকোঠায়, ধোঁয়া আর গালগল্পে মেতে উঠত চারদিক। ছোট্ট হেনি তার ছেলে লরেন্স আর কন্যা এলসিকে কোলে নিয়ে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকত সবার দিকে। মাঝেমাঝে ভেসে আসত কটূক্তি, মেয়ে এলসি বোবা-কালা বলে, মাঝেমাঝে ঝরে পড়ত মদ্যপ ডেভিডের অত্যাচার। তাও, হেনি টিঁকে গিয়েছিল। মুশকিল হল পঞ্চম সন্তানের জন্ম দেওয়ার সময়। ততদিনে হেনির সেই তামাকের ফার্ম গেছে, বন্ধুবান্ধব গেছে, মেয়ে লেসি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে ধীরে ধীরে। হেনি লক্ষ্য করল তার যোনি থেকে মাত্রাতিরিক্ত রক্তপাত হচ্ছে, সঙ্গে তলপেটে অসম্ভব যন্ত্রণা- অন্তঃসত্ত্বা হলে তো এমন হওয়ার কথা হয় না! আত্মীয়রা বলল ডাক্তার দেখাতে, কিন্তু দেখাবে কোথায়? নিগ্রোমহলে ততদিনে কানাঘুষো শুরু হয়ে গেছে টাস্কিজি সিফিলিস এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে, আমেরিকার সমস্ত হসপিটালে প্রবেশ কালো চামড়াদের জন্যে নিষিদ্ধ, জন হপকিনস বাদে। অগত্যা...

১৯৫১ সালের ২৯শে জানুয়ারি। ঠান্ডায় কাঁপুনি ধরে যায়, সর্বাঙ্গ শিরশির করে। হেনিকে পথ দেখিয়ে নার্সটি সমানে এগিয়েই চলেছে। হেনরিয়েটা হাঁটতে পারছে না, কষ্টে প্রাণ বেরিয়ে আসছে কিন্তু থামা যাবেনা- এটা সাদাদের জায়গা। তাকে স্থান দেওয়া হয়েছে হাসপাতালের একদম প্রান্তে যেখানে আফ্রিকান রোগীদের চিকিৎসা করা হয়। "হ্যালো, আমি ড. হওয়ার্ড জোনস, তোমার ডাক্তার। আর এঁরা হলেন ড. জর্জ অটো গে আর মেরি ক্যুবিচেক। তুমি আমার অধীনে থাকবে। আপাতত বিশ্রাম নাও, কাল থেকে তোমার ট্রিটমেন্ট শুরু।"

৩.

হেনরিয়েটা ল্যাক্স মারা যায় ১৯৫১ সালের ৮ই অগাস্ট ক্যান্সার মেটাস্ট্যাসিসে। তার মৃতদেহ পুঁতে দেওয়া হয় আনমার্কড কোনো এক কবরে। থেকে যায় তার সার্ভিক্সের কোষ। তলপেটের যন্ত্রণাটা আসলে সার্ভাইক্যাল ক্যান্সারের জন্যে হত, যাকে শুরুতে ভুল ডায়গোনস করেছিলেন ড. জোনস। ম্যারি ক্যুবিচেক তার ইন্টারভিউতে বলেছিলেন হেনির মনের জোরের কথা। কীভাবে দিনের পর দিন অমানবিক যন্ত্রণা সহ্য করে যেত মেয়েটা। ড. গে'র ল্যাবরেটরিতে তখন ক্রমাগত চলছে টিউমর জমানোর কাজ, উদ্দেশ্য- অমরত্বের জন্ম। ততদিনে বিজ্ঞানীরা বুঝে গেছেন ক্যান্সারে যে আসলে কোষের মৃত্যু হয়না, উলটে তারা বছরের পর বছর বাড়তেই থাকে। তবে বিজ্ঞানের একটা মজা আছে- আপনি লজিকালি যতই কারেক্ট হননা কেন বাস্তব আপনাকে ঘোল খাওয়াতে বিন্দুমাত্র হেজিটেট করবে না। হাজার হাজার কোষ, হাজার হাজার সেট আপ, দানবীয় ব্যারেলে ঘুরতে থাকা হাজার হাজার মিডিয়া (যার মধ্যে আর্টিফিশিয়ালি কোষগুলো বাঁচত) নিয়ে চেষ্টা করতে করতে অবশেষে ভাগ্য খুলেছিল জর্জ গে'র। সাথে কোটি কোটি বৈজ্ঞানিকের, ডাক্তারের, পেশেন্টের। মানবদেহের বাইরে কোষকে বাঁচিয়ে রাখা মানে ভাবতে পারছেন? যে কোনও রোগ নিয়ে কাটাছেঁড়া করার মোক্ষম পথ- স্রেফ কোষগুলোতে ঢুকিয়ে দাও মারণ ব্যাধি আর তারপর একের পর এক চেষ্টা করতে থাকো বিভিন্ন ড্রাগ। সত্যি বলতে হেনরিয়েটা ল্যাক্সের অমর কোষদের জন্যে আজ পৃথিবীতে অগণিত রোগের ট্রিটমেন্ট আবিষ্কার হয়েছে, মলিক্যুলার বায়োলজির অসংখ্য ধাঁধার সমাধান হয়েছে, আরেকটা টাস্কিজি সিফিলিস প্রোজেক্ট হয়নি... ১৯৫১ সালের পর থেকে বিজ্ঞান গবেষণার ভোল পালটে যায়, পৃথিবী জুড়ে ছেয়ে যায় রিউমর যে ড. জর্জ গে ফ্র‍্যাঙ্কেনস্টাইন তৈরি করেছেন, হেনির কোষ ছড়াতে থাকে ল্যাবরেটরি থেকে ল্যাবরেটরিতে। হেনরিয়েটার কেসের দেখাদেখি শুরু হতে থাকে স্তন, গলা, ফুসফুস, যকৃৎ সমস্ত অঙ্গের ইম্মর্টালাইজেশন যাদের আজ সেল লাইন বলে।

মজার কথা, হেনরিয়েটা ল্যাক্সের জীবন নিয়ে বই লেখার জন্যে রিসার্চ করতে গিয়ে রেবেকা সক্লুট জানতে পারেন 'হে লা' (হেনরিয়েটা ল্যাক্সের সংক্ষেপ) কোষের জন্যে হেনির পরিবার এক পয়সাও পায়নি, পরিচিতি পায়নি, এমনকি তার সার্ভিক্স থেকে মাংসের টুকরো খুঁচিয়ে বের করে নেওয়ার সময় ড. জোনস অনুমতিটুকু নেননি হেনির! কেনই বা নেবেন? সে যে নিগ্রো...তবে প্রতিশোধ নিয়েছে হেনরিয়েটা ল্যাক্স- বেঁচে থাকতে তার পরিচিতি না ছড়ালেও মৃত্যুর এত্ত বছর পরে হেনি তারই দেখানো পথকে প্রায় তছনছ করে ফেলেছে। দু'হাজার দশ সালের সময় থেকে মোটামুটি বৈজ্ঞানিকরা দেখতে পান সেল লাইনেরা মাঝেমাঝেই সেই নির্দিষ্ট অঙ্গের মত বিহেভ করছে না- কখনো লিভারের কোষ থেকে সার্ভিক্সের সিগন্যাল আসছে তো কখনো ভোকাল কর্ডের সেল লাইনে পাওয়া যাচ্ছে সার্ভাইক্যাল ক্যান্সারের কোষ। বৈজ্ঞানিকেরা টাইম ট্রাভেল করে পিছিয়ে গেলেন ১৯৫১ তে এবং জানতে পারলেন সেই সময় প্রিজার্ভেশন সিস্টেম আজকের মত অত উন্নত না হওয়ায় হে লা সেল লাইন যত ল্যাবরেটরিতে গেছে, তাদের প্রত্যেক গবেষণাগারে বানানো নতুন নতুন সেল লাইনদের মধ্যে নিজেই মিশে গিয়েছে ছোঁয়াচে রোগের মত। আজ, ২০১৭ তে এসে 'হে লা কন্টামিনেশনের' জন্যে অধিকাংশ সেল লাইন নিয়ে গবেষণাকে আর গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে ধরা হয়না। মধুর প্রতিশোধ! কী বলেন?

science
Advertisment