ওপরের ছবিগুলো পিটুনিয়া ফুলের, আজকাল প্রায় সকলেরই চেনা এই ফুল। মনের মধ্যে কোথাও আছে এই ঝলমলে রঙিন ফুলেদের সঙ্গে জড়ানো একখানা কবিতার বইয়ের কথা।
বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, আইন অনুযায়ী দাসপ্রথা এবং কালো মানুষদের প্রতি সামাজিক অসাম্য রদ হয়ে গেলেও, তখনকার আমেরিকায় ছিল, পরের অন্য অনেক ঠ্যাঙাড়েবাহিনীর মতই, এক কুখ্যাত ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী- কু ক্লুক্স ক্লান। খুন লুটতরাজ আগুন লাগানো ও ধর্ষণ ছিল এদের ব্যসন। আমেরিকার দরিদ্র, অসুবিধায় থাকা মানুষদের, বিশেষত কালোমানুষদের কাছে ওই নাম ছিল ভয়ংকর আতঙ্কের সমার্থক। ওইসব কুকীর্তির জন্য তারা কখনো সাজা পেত না, কাজেই অপ্রতিহত ছিল তাদের প্রতাপ। যে কোন শান্ত-জীবনের একটি ছোট গ্রাম বা জনপদকে একঘন্টার মধ্যে তারা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারত, এবং সেটা তারা করতও।
এরকম দিনকালে চল্লিশের দশকে একদিন রাত্রে নিজেদের ছোট ঘোড়ার গাড়িটি চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন উইলি ওয়াকার আর তাঁর স্ত্রী মিনি ল্যু গ্রান্ট। পথে পড়ল একটি ছোট গ্রাম। আকাশের বিরাট চাঁদের নিচে সেই গ্রামটি ছিল একেবারে জনশূন্য। একটা কুকুরও ছিল না পথে।
এদিক-ওদিকে পড়ে থাকা দুচারটি মৃতদেহ আর বাতাসে ভারী হয়ে থাকা ঘরপোড়া গন্ধ সাক্ষ্য দিচ্ছিল কী ঘটেছে জনপদটির ভাগ্যে। সেই মর্মান্তিক ছবির মধ্যে মিনির চোখ পড়ে পড়ে-থাকা বড় একটা ফুলগাছের টবের ওপর। কাত হয়ে পড়ে আছে পিটুনিয়া ফুলে ভরা টবটা, চাঁদের আলোর নিচে। শুকিয়ে উঠেছে জলহীন ফুলগুলো। ব্যথায় বুক ভেঙে যাওয়া মিনি ল্যু স্বামীকে বলেন গাড়ি থামাতে। দুজনে মিলে ধরাধরি করে তুলে নিয়ে আসেন সেই কার-যেন-যত্নের-সংসারের মৃতপ্রায় টবটি, যেন ওইটেই তাঁদের ধ্বংসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ- যে কোন মূল্যে জীবনকে রক্ষা করা।
কালেকালে সযত্নরক্ষায় মস্ত হয়ে ওঠে সেই পিটুনিয়ার ঝাড়। মিনি ল্যু কোনদিন ভোলেন নি তাদের ইতিহাস। ভুলতে দেন নি নিজের ছেলেমেয়েদেরও। টবে টবে ভাগ করে রাখেন বড় হতে থাকা ফুলের ঝাড়টিকে। তাঁর আটটি সন্তানের মধ্যে কন্যারা বিয়ের পর যে যখন নিজেদের সংসারে যায়, প্রত্যেকের সঙ্গে তিনি যৌতুক দিতেন সেই পিটুনিয়ার একটি করে টব, যেন বা অক্ষয় শিক্ষা, জীবনকে রক্ষা করার আর যে কোন দুর্ভাগ্যের মধ্যেও আপ্রাণ বেঁচে থাকার।
এই দম্পতির কনিষ্ঠতম কন্যাটি হয়ে ওঠে এক বিশ্ববিখ্যাত লেখক, তার নাম- অ্যালিস ওয়াকার। সমস্ত দলিত, পীড়িত মানুষদের বিশেষত মেয়েদের অবস্থান থেকে সমাজকে আর পৃথিবীকেও, দেখার এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গী লিখতে থাকেন অ্যালিস। তাকে নাম দেন উওম্যানিজম- নারীচেতনাবাদ। ভালোবাসায় ভরা তাঁর লেখাগুলোতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে কীভাবে ক্ষমতা নষ্ট করে দেয় ব্যক্তিমানুষের কিংবা সমাজের সুস্থ জীবনযাপন আর ধারণার বোধগুলো।
ইন সার্চ অব আওয়ার মাদার্স গার্ডেন্স, দি কালার পার্পল, মেরিডিয়ান- একের পর এক বইয়ে মানুষের মূল ভাবনা যে পৃথিবীর সমস্ত সুন্দর জিনিসকে ভালোবাসার ভাবনা, সে কথা তুলে ধরতে থাকেন অ্যালিস। প্রথমে ‘অশ্লীলতার দায়ে’ অ্যালিসের লেখাকে নিষিদ্ধ করার কথা ভাবে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কোন কোন রাজ্য, পরে সেই সব লেখা পায় ‘পুলিৎজার পুরস্কার’।পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষ বাঁচার অর্থ নতুন করে বুঝবার জন্য অ্যালিস ওয়াকারের লেখা পড়ে।
এই কন্যাটিকেও বিয়ে হয়ে যাবার সময়ে সেই মরণ-পেরিয়ে-আসা পিটুনিয়া ফুলের একটি টব দিয়েছিলেন তাঁর মা। শিশুকাল থেকেই পরিবারে বারবার শুনে তাঁর জানা ছিল এই গাছগুলোর সঞ্জীবনী এলিস যখন নিজের বাড়ি করলেন, বাগানের একটা অংশ ভরে ছড়িয়ে দিলেন সেই মৃত্যুঞ্জয়ী গুল্মগুলোকে। যে ভালোবাসে, তাকে পছন্দ করতে পারে না সেইসব লোক যারা হিংসার বেসাতি করে। এলিসের লেখাও কিছু ক্ষমতাশালী লোকজনকে স্বস্তি দিচ্ছিল না।
বারে বারে তারা ভয় দেখায়, ধমক দেয়, তাঁর লেখার বিষয় পাল্টানোর জন্য। অ্যালিস লেখেন যা তিনি লিখতে চান। তখন তাঁকে মর্মান্তিক আঘাত দেবার ব্যবস্থা করে সেই লোকেরা। একদিন সকালে উঠে অ্যালিস দেখতে পান তাঁর দিদিমার কবর খুঁড়ে দেহাবশেষ অ্যালিসের বাগানে ছিটিয়ে ফেলে গেছে সেইসব অ-মানুষ লোকেরা। এদিকে ওদিকে পড়ে আছে তাঁর স্নেহময়ী দিদিমার প্রাচীন হাড়ের টুকরো। ওরা ভেবেছিল এবার অ্যালিস থেমে যাবেন, মনে পড়বেন মনের কষ্টে। কী মনে হয়েছিল অ্যালিসের জানি না, ঘটনাটির কথা লিখলেন। আর, পরের কবিতার বইতির নাম দিলেন- ‘অ্যাশেজ অ্যামং দ্য পিটুনিয়াজ’ ফুলবাগা্নে ছাইয়ের কবিতা।
ঠিক যেমন সত্তরের দশকে ইতালির নব্য-নাৎজি শাসকের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে নাটকের নাটক লিখে চলেছিলেন অভিনেত্রী, বিপ্লবী-কর্মী, নাট্যকার ফ্রাংকা রামে। ‘উচিত শিক্ষা’ দেবার জন্য মিলানের গুপ্তপুলিশের নির্দেশে একটি পরিত্যক্ত বাসের মধ্যে তাঁকে গণধর্ষণ করে চার জন। মৃত ভেবে রাস্তার পাশে নালায় ফেলে দিয়ে চলে যায় তারপর। মৃত্যুঞ্জয়ী সেই মেয়ে কিছুটা হামাগুড়ি দিয়ে কিছুটা হেঁটে বাড়ি যান। প্রায় একমাস হাসপাতালে থাকবার পর ফিরে এসে সমস্ত ঘটনাটির অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে লেখেন তাঁর নাটক – মাই ভয়েস ইজ গন। না, কোনমতে স্তব্ধ হয়নি তাঁর উজ্জ্বল কণ্ঠ।
এইসব বইয়ের কথা মনে পড়ল আজ, এই সরস্বতী পুজোর অতিপ্রিয় সকালে। বস্তুত, ইনিও তো আবদ্ধ নন কোন ধর্ম-অনুষ্ঠানে। ‘যিনি সরস করেন’ সেই অর্থে নদীমাতা সরস্বতী এক কৃষিসংস্কৃতির সভ্যতায় নিত্য পূজিতা। আমাদের চিত্তকে সিঞ্চন করুন শুভবোধ আর সাহসের ধারায়।
(জয়া মিত্র পরিবেশবিদ, মতামত ব্যক্তিগত)
এই কলামের সব লেখা একত্রে পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে