Advertisment

চিকিৎসা এবং মানবিকতার মাঝে দাঁড়িয়ে যে দেওয়াল, তার নাম বিজ্ঞান

প্রযুক্তি-নির্ভরতা চিকিৎসাকে নিয়ে গেছে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের নাগালের বাইরে। ক্রমশ মধ্যবিত্তেরও নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে চিকিৎসা।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

রোগ চিরকালই মানুষের দুশ্চিন্তার এক বড় কারণ। খাদ্যের জোগান নিশ্চিত থাকলে যে ক'টা বিষয় মানুষকে গুরুতর চিন্তায় ফেলতে সক্ষম, ব্যাধি (বিশেষত গুরুতর বা দীর্ঘস্থায়ী ব্যাধি) তার অন্যতম। তবে ইদানীংকালে রোগের চিকিৎসাও রোগীর ও তাঁর পরিজনের মাথাব্যথার অন্যতম বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Advertisment

এর বহু কারণ আছে। চিকিৎসার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সুফল লাভের প্রত্যাশা বহুগুণ বেড়েছে। বাজার উন্মুক্ত হওয়ার পর স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারীর সংখ্যা বেড়েছে, বেশিরভাগই বেসরকারি ক্ষেত্রে। তার ফলে উপভোক্তাদের (লক্ষ্য করুন, রোগীরা মুক্ত বাজারে উপভোক্তা হয়ে উঠেছেন) কাছে সেরা পরিষেবা বেছে নেওয়ার সুযোগ যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে ভালো আর মন্দ বুঝে নেওয়ার দায়িত্বও।

এর উপর আছে খরচের দিকটি, যা এই মুহূর্তে এক বিশাল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের বাস্তবতায় যেখানে দেশ তথা বিশ্ব জুড়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা ঘনিয়ে আসছে, ভুল করে প্রকাশ পেয়ে যাওয়া সমীক্ষা অনুসারে সাধারণ ভারতবাসীর ক্রয়ক্ষমতা ক্রমশ তলানিতে ঠেকছে আর খাদ্যবস্তু মোবাইল ফোনের চেয়ে মহার্ঘ্য হওয়ার লক্ষণ দেখাচ্ছে, সেখানে খরচাপাতির 'ক্লিশে' হিসেবনিকেশ বাদ দিয়ে চিকিৎসা পরিষেবার সামাজিক বাস্তবতা সম্বন্ধে কোনো আলোচনাই সম্পূর্ণ হয় না।

আরও পড়ুন, জ্যোতি বোস থেকে দিলীপ ঘোষ: বাংলার রাজনৈতিক সংস্কৃতি

এই বিষয়ের সামগ্রিক আলোচনা কোনো একজনের পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে দেখা প্রয়োজন। যেটুকু বিশ্লেষণ বর্তমান লেখকের পক্ষে সম্ভব, তাও ধাপে ধাপে একাধিক পর্বে করতে হবে। তবে আলোচনার শুরুতেই দুটো অপ্রিয় সত্য স্বীকার করে নেওয়া কর্তব্য।

১) সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল

২) বেসরকারি চিকিৎসা পরিষেবা অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ, এবং এই খরচ ক্রমশ বাড়ছে। বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা ঘিরে বিরাট স্বপ্ন বোনা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এই ব্যবস্থাটি সাধারণ দেশবাসীর চিকিৎসার প্রয়োজন মেটানোর জন্য তৈরি নয়। জোড়াতালি দিয়ে সেরকম একটা পরিস্থিতি, এমনকি তার একটা ছোট সংস্করণ তৈরি করতে গেলেও সমগ্র চিকিৎসা ব্যবস্থাই ধ্বসে পড়ার আশঙ্কা আছে।

আর্থিক দিক থেকে সমস্যাটা বুঝতে গেলেও আগে আধুনিক চিকিৎসার চরিত্র খানিকটা বুঝে নেওয়া জরুরি। আধুনিক অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানভিত্তিক। শুধু তাত্ত্বিকভাবে বিজ্ঞানভিত্তিক নয়, প্রায়োগিক ক্ষেত্রে ঘোরতর প্রমাণ নির্ভর (evidence based). বস্তুত "এভিডেন্স বেসড মেডিসিন" বর্তমানে সঠিক চিকিৎসার মাপকাঠি।

এ বেশ ভালো কথা, চিকিৎসা তো বিজ্ঞানভিত্তিক হওয়াই উচিত। বিজ্ঞান আর প্রমাণ বলতে আমরা কী বুঝি, সেই বোঝার সমস্যা কোথায়, তা নিয়ে পরবর্তী কোনো পর্বে বিশদে আলোচনা করা যাবে। আপাতত এটুকু মেনে নিতেই হচ্ছে যে একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবতায় প্রমাণভিত্তিক বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার যাথার্থ্যকে উড়িয়ে দেওয়া চলে না। এর প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করলে ঝাড়ফুঁক, মাদুলি, জলপড়া বা গোমূত্রকেও চিকিৎসার অঙ্গ হিসেবে মেনে নিতে হবে বিনা তর্কে।

সমস্যা হলো, আধুনিক চিকিৎসার এই রূঢ় বৈজ্ঞানিক সত্তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে চিকিৎসা সংক্রান্ত অর্থনৈতিক বিড়ম্বনার একটি প্রধান শিকড়। অবশ্য অন্য শিকড়গুলির কথা এড়িয়ে যাওয়া চলে না। ভোগবাদ আর লোভ নামক শিকড়দুটি মাটির গভীরে প্রোথিত, তাদের উৎপাটন করাও দুরূহ। তবে লোভ ও ভোগবাদকে ব্যয়বৃদ্ধি ও দুর্নীতির কারণ হিসেবে সহজে চিহ্নিত করা যায় এবং অনেকেই এগুলির উল্লেখ করে সমালোচনা করেন। তাই এগুলোর অস্তিত্ব ও তজ্জনিত বিপদ সম্বন্ধে আমরা সচেতন, এদের প্রতিরোধ করতে সক্ষম না হলেও।

আরও পড়ুন, গাছ-পালা ঝোপ-জঙ্গল

চিকিৎসার ক্ষেত্রে এর প্রায়োগিক দিকটা দেখা যাক। চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্বন্ধে একসময় অনেকে বলতেন, "Medicine is a social science with biological underpinning." আমাদের ছাত্রজীবনেও কথাটা শুনেছি। ব্যাপারটার ভালো এবং মন্দ দিক আছে। বিজ্ঞান ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার তারতম্য অনুযায়ী কথাটিকে ভালো অথবা খারাপ মনে হবে।

বিংশ শতাব্দীর শেষে বা একবিংশ শতকের শুরুতে প্রবল বিজ্ঞানমনস্কতার আবহে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা যখন চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে আসছে নামজাদা মেডিকেল কলেজগুলোতে, তখন তারা দস্তুরমত ইস্পাত-দৃঢ় বিজ্ঞান চাইছে, সমাজবিজ্ঞান নয়। বিজ্ঞান হিসেবে চিকিৎসা বিজ্ঞান রকেট সায়েন্স বা পদার্থবিদ্যার চেয়ে পিছিয়ে, এমন ধারণা সহ্য করা কঠিন তাদের পক্ষে। বস্তুত আমাদের পক্ষেও কঠিন ছিল এই তথাকথিত পশ্চাদপদতাকে মেনে নেওয়া। এই ধারণা ও পরিস্থিতিকে বদলে দেওয়ার তাড়না একসময় আমরাও অনুভব করেছি।

চিকিৎসা বিজ্ঞানকে উচ্চস্তরের বিজ্ঞানে পরিণত করতে চাইলে ঝেড়ে ফেলতে হবে তার অঙ্গের যাবতীয় মেদ। সেই প্রচেষ্টারই অঙ্গ হল 'এভিডেন্স বেসড মেডিসিন'-এর সর্বাত্মক চর্চা। চিকিৎসা পরিষেবার মধ্যে শুধু সেটুকুই থাকবে, যার সপক্ষে প্রমাণ আছে। প্রমাণ কাকে বলব? প্রতিষ্ঠিত জার্নালে প্রকাশিত এবং সমালোচনায় উত্তীর্ণ গবেষণাপত্রগুলোতে যা লেখা আছে, সেটুকুই প্রমাণ। যদিও দুটি গবেষণাপত্রে পরস্পরবিরোধী তথ্য ও সিদ্ধান্ত থাকতে পারে, যা আমাদের আরেক জটিলতার সামনে দাঁড় করায়, কিন্তু সেই আলোচনা আপাতত মুলতুবি রাখছি।

চিকিৎসকের প্রশিক্ষণ ক্রমশ বিজ্ঞান ও প্রমাণের আধুনিকতম সংজ্ঞার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে উঠছে সঙ্গত কারণেই। এরকমই তো হওয়া উচিত। শিক্ষিত সাধারণ রোগীদের প্রশ্ন করে দেখেছি, তাঁরাও চান যে তাঁদের চিকিৎসক হবেন আধুনিকতম বিজ্ঞানে প্রশিক্ষিত ("আমেরিকার মতো')। তবে এরকম হয়ে ওঠার পথে কী কী বদলে যাচ্ছে চিকিৎসক ও চিকিৎসার চরিত্রে, সেটাও কিন্তু খেয়াল রাখা প্রয়োজন।

আমাদের আগের প্রজন্ম যখন চিকিৎসাবিজ্ঞানের পাঠ নিচ্ছিলেন, তখনও প্রযুক্তির এহেন উন্নতি হয়নি। তখনও প্রশিক্ষণের মূল অংশ ছিল "ক্লিনিকাল মেডিসিন", অর্থাৎ রোগীর সঙ্গে কথা বলে এবং চোখ দিয়ে, কান দিয়ে, হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে রোগীকে পরীক্ষা করে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার চেষ্টা। অস্বীকার করার উপায় নেই যে এই পদ্ধতিতে বা সেই সময়ের প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে সব রোগ সঠিকভাবে বোঝা যেত না, এবং অনেক রোগেরই চিকিৎসাও ছিল না। তবে যতদিন এরকম ছিল, ততদিন যেটুকু ছিল, তার অনেকটাই সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে ছিল। মানুষ ও চিকিৎসার মাঝের ফাটলটা ছিল ছোট। একটা কাঠের পাটাতনকে সাঁকো বানিয়েই তা পেরোনো যেত এবং ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় একজন চিকিৎসক বা একটি ছোট সেবামূলক সংস্থা তা পারত।

আমরা যখন এই পূর্বজদের ছাত্র ছিলাম, তখনও আমরা এই ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের প্রশিক্ষণটুকু পেয়েছি। তবে তার মধ্যেই শুরু হয়ে গেছে প্রযুক্তির দূরন্ত অগ্রগতি, এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের দ্রুত বদলে যাওয়া। বিজ্ঞান বলতে তখন কোষ, জিন, প্রোটিন, রিসেপ্টর, ট্রান্সমিটার স্তরের যে খুঁটিনাটিকে বুঝতে শুরু করলাম তখন থেকে, তাতে আমাদের শেখা ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের খামতিগুলো ক্রমশ বড় করে চোখে পড়তে শুরু করল। উন্নততর চিকিৎসা ক্রমশ সমার্থক হয়ে উঠল বিবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নতুনতর ওষুধ বা যন্ত্রপাতির সঙ্গে। তার ফলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যখন আমাদের কাছে চিকিৎসার পাঠ নিতে এসেছে, তখন অভ্যাসবশত ক্লিনিক্যাল মেডিসিন শেখালেও তার প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখার কথা আমরা ততটা জোর দিয়ে বলতে পারিনি।

এই প্রযুক্তি-নির্ভরতা চিকিৎসাকে নিয়ে গেছে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের নাগালের বাইরে। ক্রমশ মধ্যবিত্তেরও নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে চিকিৎসা। চওড়া আর গভীর হতে হতে ফাটলটি খাদে পরিণত হয়েছে। আজ যখন শুনি চিকিৎসা করাতে গিয়ে বিরাট আর্থিক ধাক্কা খাওয়া কোনো রোগী বা রোগীর পরিজন "আমাদের বাবাদের সময়ের ডাক্তারকাকা তো নাড়ি টিপেই ওষুধ লিখে দিতেন" বলে হাহাকার করছেন, তখন একইসঙ্গে কষ্ট এবং অসহায়তা অনুভব করি।

চিকিৎসার বর্তমান বন্দোবস্তের মধ্যে প্রযুক্তির কিছু অত্যাশ্চর্য কাজ করে ফেলতে পারার বা খুঁটিনাটি বুঝে ফেলতে পারার আনন্দ মাঝেমধ্যে অনুভব করি। পাশাপাশি চিকিৎসা যেহেতু আদতে শুধুমাত্র বিজ্ঞান নয়, সীমিত ক্ষমতার মরণশীল মানুষের সঙ্গে প্রাত্যহিক আদান-প্রদানও বটে, তাই ক্লেশ ও হাহাকারও (অন্তত অন্যের হাহাকারের অনুরণন) বড় কম নয় চিকিৎসকদের মধ্যে। এরকম পরিস্থিতি হয়ে ওঠার বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক দিক সম্বন্ধে ক্রমশ আলোচনা করব, এবার সংক্ষেপে উল্লেখ করা গেল আধুনিক চিকিৎসার "মানবিক" হয়ে ওঠার পথে সবচেয়ে কম আলোচিত কিন্তু অন্যতম প্রধান প্রতিপক্ষের কথা। সেই প্রতিপক্ষটি অতি সুদর্শন, কর্মদক্ষ, প্রায়শ অভ্রান্ত, অগ্রগামী এবং বিবিধ স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। তার নাম "বিজ্ঞান"।

(কৌশিক দত্ত আমরি হাসপাতালের চিকিৎসক, মতামত ব্যক্তিগত)

Jon O Swasthyo
Advertisment