ছোটবেলা থেকেই একটা জিনিস বুঝতাম, বাড়ি থেকে যে মুহূর্তে বেরোলাম সেই মুহূর্ত থেকেই আমার ঘোরা শুরু হয়ে যেত। গন্তব্যে পৌঁছনোটা আমার কাছে কোনোদিনই মুখ্য ছিল না। যদি কোনোমতে গন্তব্য পৌঁছাতে পারি তো সেটা উপরি পাওনা। বন্ধুবান্ধব এবং চেনাপরিচিতদের মুখে মুখে আমার এই নর্মদা নদীতট ধরে অ্যাডভেঞ্চার ট্রেকিংয়ের কথা অনেকটাই ছড়িয়ে পড়ল, খানিকটা প্রচার পেয়েছিল বলা চলে। দুএকটি সংবাদপত্রেও প্রকাশ হয়ে গেল আমার এই অভিযানের কথা। ২ জুন, ২০১৮ কলকাতা গোর্কি সদনে আমাদের অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের সংগঠন সোনারপুর আরোহী এবং ইন্ডিয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ফাউন্ডেশনের তরফ থেকে ফ্ল্যাগ অফ করলেন রিটায়ার্ড এয়ার ভাইস মার্শাল অপূর্ব কুমার ভট্টাচার্য। হাতে তুলে দিলেন ভারতবর্ষের জাতীয় পতাকা এবং সোনারপুর আরোহীর পতাকা। উপস্থিত ছিলেন তিনশতাধিক মানুষ। এইবার আর না বেরিয়ে উপায় নেই। ঘাপটি মেরে আর বাড়ি বসে থাকলে চলবে না।
অভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটি শুরু হয়ে গেল। দুমাস বা তার বেশি সময়ের অভিযান, শুধু তো অভিযান নয়, সঙ্গে রয়েছে এক্সপ্লোরেশন। সাধারণ মানুষের জীবনধারণে যা যা লাগে সবই বয়ে নিয়ে যেতে হবে। মোটামুটিভাবে মালপত্রের লিস্ট দাঁড়াল:
১. একটি স্যাক (পিঠে নেওয়ার বড় ব্যাগ)।
২. কম্বল।
৩. মশারি।
৪. ছোট স্টোভ।
৫. বিউটেন গ্যাসের ক্যান (৪টি)।
৬. গ্লাস এবং মেসটিন।
৭. ইমারজেন্সি ফুল মেডিকেল কিট।
৮. জুতো এবং চপ্পল।
৯. হাঁটার জন্য দুজোড়া এবং ঘরে পরার দুজোড়া জামাকাপড়, প্রয়োজনীয় অন্তর্বাস, রুমাল, টাওয়েল।
১০. রেইনকোট।
১১. অতিরিক্ত চশমা এবং সানগ্লাস।
১২. প্রয়োজনীয় ড্রাইফ্রুট, ড্রাইফুড (ম্যাগি, পাস্তা) এবং প্রচুর চকোলেট।
১৩. ইমার্জেন্সি ফুড কিট (ফ্রুটজুস, কাজুবাদাম, চকলেট, জল - ৫০০ এমএল), খুব বিপদ ছাড়া খাওয়া যাবে না।
১৪. ক্যাম্পিংয়ের প্রয়োজনীয় জিনিস (টেন্টলাইট, টর্চ, সুইস নাইফ, অতিরিক্ত ব্যাটারি)।
আরও পড়ুন, Travelogue of Narmada: পায়ে হেঁটে, ইচ্ছেমত নর্মদা (প্রথম চরণ)
এ ছাড়াও কলকাতা পুলিশের সাউথইস্ট ডিভিশনের ডেপুটি কমিশনার শ্রী কল্যাণ মুখার্জি, যিনি ব্যক্তিগতভাবে আমার শুভানুধ্যায়ী, একটি শুভেচ্ছাপত্র দিলেন। যেটি প্রয়োজনে বা বিপদে পড়লে কোন সরকারি আধিকারিককে দেখালে সাহায্য পেতে পারি। সোনারপুর আরোহীর সাধারণ সম্পাদক শ্রী রুদ্রপ্রসাদ হালদার সর্বসাধারণের জন্য অনুরূপ একটি আবেদনপত্র লিখে দিলেন।
রওনা দেব ঠিক করলাম ১০ জুলাই ২০১৮। ১২৯০৬ হাওড়া-পোরবন্দর এক্সপ্রেস, রাত ১০:৫০, শেষ মুহূর্তে তৎকালে টিকিট কাটা হল। যাওয়ার দিন বাড়িতে দেখা করতে এলেন ইন্দ্রনীল এবং অরুণ চক্রবর্তী। খানিকটা এগিয়ে দিলেন আমার মা, শ্রীমতী প্রতিভা বিশ্বাস। সরাসরি হাওড়া স্টেশনে যেতে পারলাম না। যাওয়ার রাস্তায় দেখা করে যেতে হল মধুমন্তী এবং লিপিকাদি (লিপিকা বিশ্বাস, সাইক্লিস্ট এবং পর্বতারোহী)-র সঙ্গে। তারপর গেলাম কলকাতা পুলিশের সদর দফতর লালবাজারে। সাইবার ক্রাইম বিভাগের মুখ্য আধিকারিক এবং পর্বতারোহী শান্তনুদার (শান্তনু চ্যাটার্জি) কাছে। উনিই পৌঁছে দেবেন হাওড়া স্টেশন। হাওড়া স্টেশনে ট্রেনে তুলে দিতে এলেন মলয় মুখার্জি এবং কুন্তল কাড়ার (দুজনেই পর্বতারোহী এবং পর্যায়ক্রমে ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে মাউন্ট এভারেস্ট সামিট করেছেন)। এবং পরিশেষে দেখা করতে এসেছিলেন দীর্ঘদিনের অনুপ্রেরণা, বন্ধু, দাদা এবং রক ক্লাইম্বিংয়ের শিক্ষক সুমন চক্রবর্তী। স্বল্প কিছু মানুষের মধ্যে একজন যাঁকে দেখেই আমার অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের প্রথম পদক্ষেপ।
অবশেষে ট্রেন ছাড়ল রাত এগারোটায়। যে কোন অভিযানে বেরোনোর সময় সামান্য হলেও বুকটা কাঁপে। এত মানুষের শুভেচ্ছা এবং ভালোবাসা নিয়ে রাস্তায় নেমেছি। অভিযান সফলভাবে শেষ করতে পারব তো? যদি না পারি? জানি কেউ কিছুই বলবেন না। তবুও!
ট্রেনে কেটে গেল গোটা একটা দিন। ট্রেনে ঘটার মত কোন ঘটনা ছিলও না। অভিযানের জন্য শুভানুধ্যায়ীদের বার্তাগুলি আসছিল, যা কিনা প্রবল উৎসাহ যোগায়। পরদিন ১২ই জুলাই ২০১৮ ট্রেন যখন ভারুচ শহরের কাছাকাছি তখন প্রথম নর্মদার দর্শন পেলাম। বর্ষার জলে ঘোলা নর্মদাকে দেখে একটুও প্রেম আসেনি। এই নদীটার তীর ধরে দুমাস হাঁটব বলে কোন বাড়তি রোমান্টিসিজমও ছিল না। সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক অনুভূতি।
অভিযানের রুট নর্মদার মোহনা গুজরাটের ‘দহেজ’ থেকে মধ্যপ্রদেশের ‘অমরকণ্টক’ হলেও প্রথম গন্তব্য ‘বরোদা’ শহর। বরোদায় থাকেন আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু দেবাশীষ গুহনিয়োগী। কর্মসূত্রে উনি দীর্ঘ ১২ বছর বরোদার বাসিন্দা। ওনার বাড়িটাই হল আমার অভিযানের বেসক্যাম্প। রোদ্দুর নামেই উনি বন্ধুবৃত্তে পরিচিত। বরোদা পৌঁছলাম সকাল নটায় এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রোদ্দুরের দায়িত্বে চলে গেলাম। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পৃষ্ঠপোষক রোদ্দুরের বাড়িতে থাকলাম একটা দিন। বৃক্ষপ্রেমী রোদ্দুরের একটি সাংঘাতিক অভ্যেস হল চেনাপরিচিত সবার নামে গাছ লাগানো, আমার নামে রোদ্দুরের বাড়িতে লাগানো রয়েছে দুটি গাছ - একটি আগের, আর একটি এখনকার।
ঘুরে দেখলাম বরোদা শহর। এই প্রথমবার বরোদায় এসেছি, গুজরাট রাজ্যেও প্রথমবার। খুব বেশী ধারণা ছিল না শহরটি সম্পর্কে, আর আমি বেশি পড়াশুনা করে ঘুরতে পছন্দ করি না। মহারাজা তৃতীয় সায়াজীরাও গায়কোয়াড়ের রাজত্ব অনেকটাই অবাক করে দিল। বাইরে থেকে দেখে নিলাম রাজপ্রাসাদ, যদিও বর্তমানে একটি রিসোর্ট এবং গল্ফ কোর্স। জানতাম না এশিয়ার প্রথম সঙ্গীত মহাবিদ্যালয় বরোদায় গায়কোয়াড় মহারাজা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শিক্ষার্থীদের তালিম দেওয়ানোর জন্য সারা ভারতবর্ষের তাবড় তাবড় গুণিজনদের অনুরোধ করেছিলেন। তাঁর অনুরোধেই সেইসময় বরোদা আসেন উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ সাহেব, সৈয়দ মুজতবা আলীর (যাকে আমিও গুরুদেব বলেই মানি) মত মানুষ। ঋষি অরবিন্দকে নিয়োগ করেন ইংরেজির প্রফেসর হিসেবে, পরে ভাইস প্রিন্সিপাল হয়েছিলেন।
সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের সামনে একটি সরোবর, যা কিনা ‘সুর সাগর’ নামে পরিচিত। একটু দূরেই রয়েছে বিচারালয়, মাত্র ছয়মাস আগেও সেটি ছিল বরোদা হাইকোর্ট, নাম ‘ন্যায় মন্দির’। মহারাজার শুধুমাত্র সঙ্গীত নয় সাহিত্য রসবোধও প্রশংসনীয়। ঋষি অরবিন্দর বাসস্থানটিই বর্তমানে বরোদা অরবিন্দ আশ্রম। ঢুঁ মারলাম সেখানেও।
বরোদার শিল্পসংস্কৃতির ঐতিহ্য বর্তমানেও বিরাজমান। বরোদা পৌরসভার একসময়ের কমিশনার বিনোদ রাও শহরের যত পুরোনো খারাপ মেশিনারি অর্থাৎ স্ক্র্যাপ মেটাল দিয়ে অদ্ভুত সব ভাস্কর্য তৈরির সংকল্প নিয়েছিলেন। তাই আজ রাস্তার মোড়ে মোড়ে দেখা যায় স্ক্র্যাপ মেটাল দিয়ে তৈরি গণ্ডার, কাঠবিড়ালি বা গিটার হাতে রকস্টার। ঐতিহাসিক স্থান দর্শনের থেকে এই অভিনব ভাস্কর্য আরো বেশী আকর্ষণীয় লাগল।
ঠিক করেছিলাম পরদিন ১৩ জুলাই ২০১৮ ভোরবেলা বরোদা থেকে দহেজের (নর্মদার মোহনা) উদ্দেশে রওনা দেব গাড়ীতে। সেইখান থেকেই ট্রেকিং শুরু। দূরত্ব কম নয়, প্রায় ১১০ কিলোমিটার। গাড়ীতে সময় লাগবে প্রায় দুঘণ্টা। ঘুমিয়ে পড়লাম একটু তাড়াতাড়ি। কোনও উত্তেজনা ছিল না, দারুণ শান্তির ঘুম ঘুমালাম।