Advertisment

জোরে ঢাক বাজানোয় জরিমানা হয়েছিল রানি রাসমণির! দুর্গাপুজোর এমন কাহিনী চমকে দেবে

কত টাকা জরিমানা হয়েছিল জানেন?

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
kolkata police

অতীত থেকে দুর্গাপুজোর সঙ্গে কলকাতা পুলিশের যে নিবিড় সম্পর্ক তা কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না।

প্রতিবছর দুর্গাপুজো একরাশ আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। বিষাদ মেশানো 'বিসর্জন' পর্ব দিয়ে শেষ হয়েছে প্রতি বছরের মত এবারের দুর্গাপুজো। তবে কার্নিভ্যাল নিঃসন্দেহে রাজ্যবাসীর কাছে বড় পাওনা। কলকাতা পুলিশ যেভাবে পথে নেমে দুর্গাপুজো ও কার্নিভ্যাল সামলেছে তা অবশ্য'ই প্রশংসার দাবি রাখে। এনিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় কলকাতা ট্রাফিক পুলিশের ভূয়সী প্রশংসায় মুখ খুলেছেন নেটাগরিকরা। পুজো শেষ হয়েছে বটে তবে বাঙ্গালির কাছে পুজোর রেশ তো রয়েই গেছে।

Advertisment

দুর্গাপুজো শেষে পুজোর ইতিহাস নিয়েই সোশ্যাল মিডিয়ায় স্বদেশী আন্দোলনে পুজোর প্রভাব শীর্ষক এক কাহিনী তুলে ধরেছে কলকাতা পুলিশ। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই পোস্ট হাজার হাজার মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছে। উল্লেখ্য ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং বাঙালির প্রাণের দুর্গাপুজোর মধ্যে ছিল এক নিবিড় সম্পর্ক।

প্রথম দিকে পরিস্থিতি বেশ অনুকূল থাকলেও পরবর্তীতে পুজোর সঙ্গে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির সম্পর্ক বেশ তলানিতে ঠেকে। ১৮ শতকের অনেকটা অংশ জুড়ে, এবং ১৯ শতকের গোড়ার দিকে কলকাতার ধনকুবেরদের আয়োজিত বিলাসবহুল পুজোয় উৎসাহের সঙ্গেই অংশ নিতেন কোম্পানির আধিকারিকরা। তবে শুধু তাই নয় তাঁদের পরিবারও সেই পুজোয় সামিল থাকতেন। এমনকি ১৮ শতকের শেষভাগে বীরভূমের সুরুলে নিজস্ব দুর্গাপুজো চালু করেন নীলকুঠির মালিক তথা ব্যবসায়ী জন চিপস, যাঁর নামের সঠিক উচ্চারণ না করতে পেরে ‘চিক বাহাদুর’ বলে ডাকতেন স্থানীয়রা।

তবে ১৯ শতক যত এগোতে থাকে, ততই বাড়তে থাকে বঙ্গসমাজের সিংহভাগের সঙ্গে ‘জন কোম্পানির’ দূরত্ব। দু’তরফেরই রক্ষণশীল সদস্যদের চোখে দুর্গাপুজোর মতন একটি একান্ত দেশীয় উৎসবে ব্রিটিশদের অংশগ্রহণ হয়ে দাঁড়ায় অশোভন, অগ্রহণযোগ্য। অবশেষে ১৮৪০ নাগাদ ফরমান জারি হয়, পুজো বা সে সংক্রান্ত কোনও অনুষ্ঠানে আর যোগদান করবেন না কোম্পানির আধিকারিকরা।

ইতিহাস ঘেঁটে জানা গিয়েছে জানবাজারের পৈতৃক বাড়িতে ১৮৩০ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর পুজোর ভার নিজের হাতে তুলে নেন রানী রাসমণি। জানবাজারের এক ইউরোপীয় বাসিন্দা অভিযোগ করেন, পুজোর ঢাকের আওয়াজে তাঁর অসুবিধে হচ্ছে। কিন্তু সেই অভিযোগ কানে তোলেন নি রাণী রাসমণি। পুজোর আয়োজনে তো কোন ভাটা পড়লই না, বরং রাসমণির নির্দেশে চতুর্গুণ আওয়াজ করে বেরোল পুজোর শোভাযাত্রা। সেই অপরাধে তাঁর জরিমানা ধার্য হলো ৫০ টাকা, যা সেই যুগে বেশ বড় অঙ্ক। এরপরই জানবাজারের প্রধান রাজপথ বন্ধ করে দিলেন রানী রাসমণি। জানালেন, তাঁর স্বামীর অর্থে এবং উদ্যোগে নির্মিত রাস্তা তাঁর অনুমতি বিনা ব্যবহার করা যাবে না। অতঃপর নিজেদের অবস্থান থেকে সরে গিয়ে সবিনয়ে রাসমণিকে ফিরিয়ে দিলেন জরিমানার টাকা।

১৯ শতকে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রভাব। অনুশীলন সমিতির উদ্যোগে ১৯০৬ সালে শহরে আয়োজিত হয় এক অন্য দুর্গাপুজো। বিধান সরণির কাছে সদর দফতরে অনুষ্ঠিত ওই পুজোয় কোনও মাটির দুর্গাপ্রতিমা ছিল না, ছিল একরাশ অস্ত্রের সম্ভার – ছোরা, ছুরি, তলোয়ার, লাঠি, ইত্যাদি। এক কথায় অস্ত্রপুজো। অভূতপূর্ব এই পুজোয় শরিক হন শ্রী অরবিন্দ, বাঘা যতীনের মতো বিল্পবীরা।

বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই ‘বারোয়ারি’ পুজো ক্রমশ পরিণত হচ্ছিল ‘সার্বজনীন’ পুজোয়, যার পরিধি ছিল আরও অনেকটাই বিস্তৃত। ইতিহাস বলছে কলকাতার প্রথম সার্বজনীন পুজো ১৯১০ সালে আয়োজিত হয় ভবানীপুর এলাকার বলরাম বসু ঘাট রোডের পুজো। ১৯১৯ সালে বাগবাজার স্ট্রিটে আয়োজিত হয় নেবুবাগান বারোয়ারি পুজো, যা পরবর্তীকালে বিখ্যাত হয় বাগবাজার সার্বজনীন নামে।

দুই পুজোরই পৃষ্ঠপোষক হিসেবে উল্লেখ ছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নাম। বস্তুত, কথিত আছে যে কুমোরটুলির একচালা প্রতিমার ধাঁচ পালটে যাওয়ায় রাগে অগ্নিশর্মা পুরোহিতরা যখন পুজো করবেন না বলে গোঁ ধরেন তখন মধ্যস্থতায় নামেন নেতাজি স্বয়ং

গল্পটা হয়তো সকলেরই জানা। ১৯৩৫ সালে পুজোর কর্মকর্তারা তখনকার সুবিখ্যাত ভাস্কর গোপেশ্বর পালের কাছে অনুরোধ জানান, সে বছর প্রতিমা তৈরির তত্ত্বাবধান যেন তিনিই করেন। সদ্য ইতালি থেকে ভাস্কর্যের কোর্স করে আসা গোপেশ্বর ঠিক করেন, প্রতিমার কাঠামোই বদলে দেবেন তিনি। এই বৈপ্লবিক চিন্তাধারায় রীতিমত ঘাবড়ে যান প্রতিমাশিল্পী জগদীশ পাল। এতটাই, যে পুজোর আয়োজকদের জানান, শরীর বিশেষ অসুস্থ হওয়ায় প্রতিমা নির্মাণের কাজ সে বছর আর করতে পারছেন না, তাঁর ‘পদত্যাগ’ যেন স্বীকার করা হয়।

তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে না গোপেশ্বর নিজেই প্রতিমা নির্মাণের কাজে হাত দেন। তাঁর হাতে দুর্গা হয়ে ওঠেন দুরন্ত এক যোদ্ধা, বর্শার আঘাতে বিদ্ধ করছেন পেশীবহুল মহিষাসুরকে। এই ভঙ্গি আমাদের কাছে অতি পরিচিত হলেও সেসময় একরকম অদেখাই ছিল। শুধু তাই নয়, একচালা কাঠামো ত্যাগ করে দুর্গা এবং তাঁর সন্তানদের আলাদা আলাদা মূর্তি গড়েন গোপেশ্বর। এবং পুরোহিতরা যতই আপত্তি জানান, দুর্গার এই নতুন প্রতিবাদী রূপ যেন আয়না হয়ে দাঁড়ায় তৎকালীন জনমতের, যাতে ইন্ধন যোগায় নেতাজির সংসর্গ।

শুধু শৈল্পিক ভাবনা দিয়েই নয়, দুর্গাপুজোয় নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমেও দেশপ্রেম বিস্তারে অন্যতম ভূমিকা নেয় কুমোরটুলি। অষ্টমীর দিন আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে ধর্মীয় আচারের অঙ্গ হিসেবে স্থানীয় যুবকরা নানা ধরনের মার্শাল আর্ট, বক্সিং, কুস্তি, এবং লাঠিখেলার প্রদর্শন করতেন। এই প্রদর্শনীর নিহিত অর্থ বুঝেও না বোঝার ভান করতে বাধ্য হতো ব্রিটিশ প্রশাসন।

সিমলা ব্যায়াম সমিতির জাতীয়তাবাদী ভাবনাচিন্তা অবশ্য আরও দ্ব্যর্থহীন। প্রথম থেকেই স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি এই পুজো উৎসর্গ করেন প্রতিষ্ঠাতা অতীন্দ্রনাথ বসু। নেতাজি ছাড়াও এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাঁর দাদা শরৎচন্দ্র বসু, স্বামী বিবেকানন্দের ছোট ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কিরণ মুখোপাধ্যায়ের মতো স্বাধীনতা সংগ্রামীরা।

পুজোর সময় স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন ‘থিম’ নিয়ে প্রকাশ্যেই ট্যাবলো বের হতো সমিতি থেকে। প্রশাসন চুপ করে বসে থাকেনি, ১৯৩২ থেকে ’৩৫ পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয় পুজো। তবে সেই নির্দেশিকা তুলে নেওয়া মাত্রই ফের পূর্বাবস্থাতেই ফিরে যান উদ্যোক্তারা। এমনকি ১৯৩৯ সালে সেসময় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নেতাজির হাতেই উদ্বোধন ঘটে পুজোর।

তাছাড়া ১৯৩৮-৩৯ সালে কুমোরটুলি এবং বাগবাজার, দুই পুজো কমিটিরও সভাপতি ছিলেন নেতাজি। ১৯২০-র অসহযোগ আন্দোলনের সময় থেকেই ভারতমাতার যে ছবি দেশের আপামর জনসাধারণের মনে আঁকা হয়ে ছিল, তার প্রকাশ ঘটে বাংলা জুড়ে একাধিক দুর্গাপ্রতিমার বিন্যাসেও।

কিছু কারাগারও অবশ্য হয়ে উঠেছিল দুর্গাপুজোর আঙিনা। বাংলাদেশের রাজশাহী জেল, যা কুখ্যাত ছিল বন্দীদের প্রতি অকথ্য অত্যাচারের জন্য, বা হিজলি ডিটেনশন ক্যাম্প, যা আজকের আইআইটি খড়্গপুর ক্যাম্পাসের শহীদ ভবন। দুই কারাগারেই প্যান্ডেল নির্মাণ করে পুজোর অনুমতি পান বন্দীরা, আগমন হয় বাইরের বেশ কিছু অতিথিরও। হিজলিতে পুজোর আয়োজনের দায়িত্ব নেন শান্তি দাস, বনলতা দাশগুপ্ত, বীণা দাসের মতো স্বাধীনতা সংগ্রামীরা।

এর অনেক পুজোতেই দক্ষতার সঙ্গে দায়ভার কাঁধে তুলে নিয়েছেন কলকাতা পুলিশ। সেই অতীত থেকে দুর্গাপুজোর সঙ্গে কলকাতা পুলিশের যে নিবিড় সম্পর্ক তা কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না।

তথ্যসূত্র: কলকাতা পুলিশ

Durgapuja kolkata police
Advertisment