জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন শনিবার পাঁচদিন পেরিয়ে গেল। ইগো বলুন বা সেন্টিমেন্ট, দুইই কীভাবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিতে পারে, গত পাঁচদিনে তার নমুনা দেখলেন রাজ্যের বাসিন্দারা। শনিবার এনআরএস হাসপাতালে আন্দোলনরত চিকিৎসকরা ধর্না অবস্থানে ছিলেন। অন্যদিকে মুখ্যমন্ত্রী তখন নবান্নে। এদিনও দু'পক্ষের মধ্যে কোন বৈঠক হয়নি।
দিনভর আন্দোলনরত চিকিৎসকরা দাবি জানিয়ে আসছিলেন, ঘটনাস্থলে আসতে হবে মুখ্যমন্ত্রীকে, এবং তাঁর মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। ওদিকে মুখ্যমন্ত্রীও জানিয়ে দিয়েছিলেন, "আমরা কিন্তু এসমা প্রয়োগ করি নি। আমরাও চাইছি তাদের সঙ্গে কথা বলতে।" রাজ্য প্রশাসন বা চিকিৎসক, কেউই নিজেদের অবস্থান বদলান নি। তবে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের পর জুনিয়র চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তাঁরাও আলোচনা চান। শীঘ্রই তাঁরা চিকিৎসার কাজে ফিরতে চাইছেন।
এদিকে চিকিৎসক ও মুখ্যমন্ত্রীর জেদাজেদিতে রাজ্যের সামগ্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা এতটাই ভেঙ্গে পড়েছে যে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে রোগীমৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। দু'পক্ষই হয়তো এরপর নরম হবে। সেই আভাস এদিন মুখ্যমন্ত্রী যেমন দিয়েছেন, তেমনি জুনিয়র ডাক্তাররাও তাঁদের কথাবার্তায় তা স্পষ্ট করেছেন। তাহলে এই কটা দিন যেভাবে সাধারণ মানুষ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হলেন, তার দায় কে নেবে, সেই প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহলে।
শনিবার জুনিয়র চিকিৎসকরা সাংবাদিক বৈঠকে জানান, তাঁরা হাসপাতালের অচলাবস্থা কাটাতে চান। ফিরতে চান চিকিৎসা পরিষেবায়। জুনিয়র চিকিৎসকরা বলেন, "মুখ্যমন্ত্রী নবান্নে বৈঠকে ডেকেছেন। কিন্তু আমরা ক্লোজড ডোর মিটিংয়ে যেতে পারব না। আমরা সবসময় কথা বলতে রাজি। কথা বলতে চাই। আমরা জিবি মিটিংয়ে ঠিক করব। হাসপাতালগুলোতে এই অচলাবস্থা কাটুক, মীমাংসা চাইছি আমরাও। এই অবস্থা যেন আর কোনোদিন না দেখতে হয়।"
এনআরএস হাসপাতালে জরুরী বিভাগ খোলা হয়েছে, চিকিৎসাও নাকি চালু, কিন্তু রোগী ভর্তির প্রক্রিয়া ছিল একই তিমিরে। বহির্বিভাগ বন্ধ গড়পড়তা কলকাতাসহ রাজ্যের সমস্ত সরকারি হাসপাতালে। শনিবার বিকেলেও জুনিয়র ডাক্তার মেহবুব ইসলাম, শুভমিত মন্ডল, বিভাস রায়, প্রত্যেকে জানিয়ে দেন, তাঁরা তাঁদের স্ট্যান্ডপয়েন্ট থেকে এক চুলও নড়বেন না। অন্যদিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও জানিয়ে দেন, "প্রয়োজনে এসমা প্রয়োগ করতে পারতাম কিন্তু করি নি।" একদিকে জুনিয়র ডাক্তার, অন্যদিকে রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের লড়াইয়ের জেরে রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে এ নিয়ে সন্দেহ নেই। আন্দোলনকারীরা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে রাজি হন নি। কিন্তু তাঁরা যে বৈঠক করতে চান, তা এদিন রাতে জানিয়ে দিয়েছেন।
মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় "মান-অভিমান" দূরে সরিয়ে জুনিয়র ডাক্তারদের কাজ শুরু করার আবেদন জানিয়েছেন। আবেদন জানিয়েছেন মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ও। শুক্রবার জুনিয়র ডাক্তারদের সমর্থনে কয়েকশো সিনিয়র ডাক্তার গন ইস্তফা দেন। শনিবার বিকেল পর্যন্ত জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি ছিল, এনআরএস-এ আসতে হবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। পুরো ঘটনার জন্য তাঁকে ক্ষমা চাইতে হবে। কিন্তু রাতের দিকে কিঞ্চিত সুর নরম করেন তাঁরা।
এদিকে শনিবার আরজি কর হাসপাতালে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন বা আইএমএ-র সভাপতি শান্তনু সেনকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখান জুনিয়র ডাক্তাররা। ইতিমধ্যে রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী শুক্রবার রাতে আহত ডাক্তার পরিবহ মুখোপাধ্যায়কে দেখতে যান ইনস্টিটিউট অফ নিউরোসায়েন্সেস কলকাতায়। শনিবারও মেদিনীপুর হাসপাতালে সম্ভবত চিকিৎসার অভাবে এক রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এই অভিযোগে তোলপাড় হয়ে যায় হাসপাতাল চত্বর। রাজ্য জুড়ে রোগী মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে বলেও অভিযোগ উঠছে। এরই মধ্যে মুর্শিদাবাদে রোগীমৃত্যুর কথাও বিভিন্ন সূত্রে জানা গিয়েছে।
শনিবার একদিকে এন আর এস চত্বরে জুনিয়র চিকিৎসকরা, অন্যদিকে নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, দু'পক্ষই অপেক্ষা করেছেন, কে কার কাছে আসবে। দু'পক্ষই নার্ভের খেলায় মেতেছেন বলে অভিজ্ঞ মহলের বক্তব্য। তবে মানুষের হয়রানি বাড়ছে, কাজেই শীঘ্রই সমস্যার সমাধান হতে বাধ্য বলে মনে করছে অভিজ্ঞ মহল। জুনিয়ার ডাক্তাররা শনিবার রাতে সুর নরম করে জানিয়ে দেন, কাজে যোগ দিতে চান তাঁরা। "পাঁচদিন ধরে বন্ধ, এটা আমরা চাই না। আমরা দুঃখিত। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ইগোর লড়াই, কিন্তু আমাদের কাছে বাঁচার লড়াই," বলেন এক ডাক্তার। তাঁদের প্রশ্ন, "আমাদের কোনো প্রতিনিধি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যান নি। কী করে তিনি দাবি মেনে নিলেন?" বক্তব্য, "মুখ্যমন্ত্রী পরিবহকে দেখতে যান, এটা আমাদের একটা শর্ত ছিল। তিনি বলছেন, পরিবহ ভালো আছে। কিন্তু তার দৃষ্টি সমস্যা হচ্ছে। শর্ট টার্ম মেমোরি লস হচ্ছে। পরিবহ কোনোদিনই সার্জেন হতে পারবে না হয়তো।"
এদিন জুনিয়র ডাক্তাররা মুখ্যমন্ত্রীর বিকেলের সাংবাদিক বৈঠকের প্রতিটি বক্তব্য খন্ডন করার চেষ্টা করেছেন। সেদিন ঘটনার পরেও ২৩০টি আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে ডাক্তারদের ওপর, দাবি জুনিয়র ডাক্তারদের। দাবি, পাল্টা দাবি, ইগো, প্রেস্টিজ, সেন্টিমেন্ট, বিপ্লব, এসবের কোনও দাম কিন্তু নেই গরী-গুর্বো রেগির পরিবারের কাছে। তাঁরা চিকিৎসা চান।