দীর্ঘ দুই দশক ধরে ধীরে ধীরে তালিবানমুক্ত করেছিলেন তাঁরা। পরিবার-পরিজন ভুলে দীর্ঘদিন আফগান রুক্ষ জমিতে পড়েছিলেন। হঠাৎ ৯/১১ বিমান হামলার বিংশতম বর্ষপূর্তিতে প্রেসিডেন্ড জো বাইডেন ঘোষণা করলেন, আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই সম্পূর্ণ করবে আমেরিকা। ইতি টানবে মার্কিন ইতিহাসের দীর্ঘতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের। খুশির হাওয়া যেমন ছিল, তেমনই প্রমাদও গুনছিলেন বহু মার্কিন সেনা। তালিবান ফের মাথাচাড়া দিতে পারে। সেই আশঙ্কাই সত্যি করে ১০০ দিনের মধ্যে কাবুল-সহ গোটা আফগানিস্তান দখল করে ফেলল তারা।
আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার আদৌ কি বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত? সেই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত খোদ মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর। সদর কার্যালয় পেন্টাগলে এখন নানা মুনি নানা মত। কুড়ি বছর পর ফের তালিবান আফগানিস্তানের দখল নিয়ে নিল, যা দেখে মন ভেঙেছে বহু মার্কিন সেনার। এর জন্যই কি এত রক্তক্ষয় হল, এটাই কি প্রাপ্য ছিল? প্রশ্ন ঘুরছে পেন্টাগনের অন্দরেই। পেন্টাগনের দোতলায় একটা ছোট ম্যাপে এখনও চিহ্নিত করা, কীভাবে আমেরিকান এয়ারলাইন্সের বিমান হাইজ্যাক করে ২০০১ সালে ১১ সেপ্টেম্বর পেন্টাগনে ধাক্কা মারা হয়েছিল।
এখনও পেন্টাগনের ইতি-উতি দেওয়ালে সাঁটানো আফগানিস্তানে ধূমপানরত মার্কিন সেনার ছবি। আফগানিস্তান হারানো যাবে না, এই মূল মন্ত্র নিয়ে বছরের পর বছর সেখানে কাটিয়েছেন ভয়ঙ্কর শক্তিশালী ইউএস মেরিন কর্পস। পেন্টাগনে অন্তত ২০ হাজার প্রতিরক্ষা আধিকারিকের অফিস, প্রচুর প্রতিরক্ষা কর্মচারী কাজ করেন। তাঁদের মুখেও এখন আফগানিস্তান ছাড়া আর কোনও কথা নেই। এক শীর্ষ সেনা আধিকারিকের প্রশ্ন, এটাই কি প্রাপ্য ছিল! দীর্ঘদিন ধরে প্রশিক্ষণ পাওয়ার পরও তালিবানের কাছে চোখের নিমেষে গুঁড়িয়ে গেল আফগান সেনার প্রতিরোধ।
আরও পড়ুন ‘প্রেসিডেন্ট দেশ ছাড়তেই বুঝেছিলাম সব আশা শেষ’, বললেন আফগান সাংসদ আনারকলি
জেনারেল ডেভিড বার্গার, মেরিন কর্পসের কম্যান্ডান্ট বলছেন, "আমরা ভিডিও ছবি দেখছি, সব খবর পড়ছি আর পুরনো কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। খুবই আবেগপ্রবণ লাগছে। সেই যন্ত্রণা এখনও আহত করে। শেষটা এমন হওয়া সত্যিই মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।" এতদিন সেখানে কাটানোর পর কেমন যেন মায়া পড়ে গিয়েছে মার্কিন মেরিন কর্পসের।
তবে আফগানিস্তান নিয়েই মার্কিন সেনার হতাশা বাসা বাঁধেনি। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ঘোষণা করেছিলেন, সিরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহার করা হবে তখনও প্রমাদ গুনেছিলেন মার্কিন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা। ২ হাজার সেনা সিরিয়ায় মোতায়েন ছিল। আইএস-এর সঙ্গে তখনও জোরকদমে যুদ্ধ চলছে। সেই সিদ্ধান্তও অফিসাররা সমালোচনা করেছিলেন। আইএস-এর কুর্দিশ জোটকে একলা ফেলে রেখে চলে আসে মার্কিন বাহিনী। রাশিয়া-ইরানের প্রভাব বিস্তারের পথ প্রশস্ত করে দেয় আমেরিকা।
আরও পড়ুন কাবুলে ‘চুরি’ আস্ত বিমান! অপহরণ করে ইউক্রেনের বিমানকে ইরানে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ
এত বছর ধরে ৮ লক্ষ মার্কিন সেনা আফগানিস্তানে মোতায়েন ছিলেন। মিশন ছিল, তালিবানমুক্ত করার পর নয়া আফগানিস্তান নির্মাণ। অন্তত ২,৪০০ সেনা শহিদ হন, আহত হন ২০ হাজারেরও বেশি। মার্কিন এয়ারস্ট্রাইকে বহু নিরীহ মহিলা-শিশুর মৃত্যু নিয়ে কম হইচই হয়নি। মার্কিন সেনার তীব্র নিন্দা হয় আন্তর্জাতিক মহলে। কাবুল দখলের দুই সপ্তাহ আগেই তালিবানের শক্তিবৃদ্ধির খবর পেয়েছিল পেন্টাগন। তাও প্রতিরোধ করতে পারল কই আফগান সেনা!
মোট কথা, আফগানিস্তান যেন আমেরিকার কাছে দ্বিতীয় সাইগন হয়ে গেল। বাইডেনের এই সিদ্ধান্ত ইতিহাসের সবচেয়ে নিন্দিত বিশ্বনায়ক করতে পারে। ইতিমধ্যেই তাঁর প্রশাসনের ঢোঁক গেলার মতো অবস্থা। কিন্তু মার্কিন সেনা! যাঁরা কুড়ি বছর ধরে সবকিছু ছেড়ে তালিবানের সঙ্গে লড়াই করলেন, সতীর্থদের হারালেন, তাঁদের সঙ্গে যেন বড় অন্যায় করল সরকার। তাঁদের এতদিনের পরিশ্রম চোখের সামনে ধুলিসাৎ হয়ে গেল।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন