সারা পৃথিবীতে করোনাভাইরাসের জন্য জারি করা লকডাউন তুলে নেওয়া হচ্ছে। তবে একই সঙ্গে জনমানসে যে আতঙ্ক তাড়া করে ফিরছে, তা হল দ্বিতীয় প্রবাহ। উদ্বেগের বিষয় হল একবার চাপা পড়ার পর এই অতিমারী ফের নতুন শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে, যার জেরে সংক্রমণ বাড়বে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর চাপ পড়বে, ফের লকডাউন হবে। এশিয়ার বিভিন্ন পকেট ও আমেরিকায় নতুন করে সংক্রমণ দেখা দেওয়ায় এই আশঙ্কা বাড়ছে।
দ্বিতীয় প্রবাহ কী?
এর কোনও নির্দিষ্ট ছক নেই কারণ এটি কোনও বৈজ্ঞানিক টার্ম নয়। একটি নির্দিষ্ট এলাকায় সংক্রমণের প্রথম ধাক্কা চলে যাওয়ার পর আবার নতুন করে যে স্রোত আসে, তাকেই দ্বিতীয় প্রবাহ বলে উল্লেখ করা হয়। যেসব প্যাথোজেনের বিরুদ্ধে মানুষের শরীরে কোনও প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই তার কারণেই অতিমারী সৃষ্টি হয়। এর ফলে তা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।
অতিমারী অস্বাভাবিক, তবে ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রায়শই দেখা যায়। প্রায়ই ফ্লু ভাইরাসের নতুন এক ধরন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে এবং ফের তা কমে যায়। কয়েক মাস পর তা ফের ফিরে আসে এবং সারা পৃথিবীতে বা পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন, ভারতে কোভিড-১৯ পরীক্ষা
কোভিড-১৯-এর ভবিষ্যৎ কী?
প্রায় সব দেশই চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা জারির মাধ্যমে অতিমারীর মোকাবিলা করেছে, যার ফলে ভাইরাস ছড়ানো কমেছে কিন্তু একই সঙ্গে ফের বাইরে বেরোলে মানুষের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েই গিয়েছে। টেক্সাস, ক্যালিফোর্নিয়া ও ফ্লোরিডার মত আমেরিকার কিছু জায়গায় লকডাউন তুলে নেওয়ার পর স্থানীয়ভাবে রোগের প্রকোপ দেখা গিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা এর কারণ বলতে পারছেন না, আর্থিক কাজকর্ম ফের শুরু হওয়ার ফলেই এরকম হল কিনা তা স্পষ্ট নয়। এশিয়া জুড়ে আতঙ্ক রয়েছে। চিনের জিলিন প্রদেশে ১০০ মিলিয়নের বেশি মানুষের উপর চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। রাশিয়ার সীমান্তে অবস্থিত এই স্থানে মে মাসে, উহানের লকডাউন ওটার এক মাস পরে এক ডজনের বেশি সংক্রমণ দেখা যায়। জুনের শুরুতে রোগ নিয়ন্ত্রণে আসে এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু হয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় সোশাল ডিসট্যান্সিং শিথিল হয় এপ্রিল মাসে তারা জুন মাসে আরও শিথিল করার সিদ্ধান্ত মুলতুবি রাখে নতুন সংক্রমণ ধরা পড়ার পর।
প্রথম প্রবাহ কমবে কী করে?
ইনফ্লুয়েঞ্জা অতিমারী মরশুমি বদলের সঙ্গে সাময়িক ভাবে পিছু হঠতে পারে, উত্তর গোলার্ধে যখন গ্রীষ্ম তখন দক্ষিণ গোলার্ধে চলে যেতে পারে, এবং উল্টোটা। এই ভাইরাস অধিকাংশ এলাকার মানুষদের বড় অংশে সংক্রমণ ঘটিয়ে তাদের দেহে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে পারে, এবং তথাকথিত গোষ্ঠী প্রতিরোধও ঘটাতে পারে। কোভিড-১৯-এর ক্ষেত্রে প্রায় সমস্ত দেশ অভূতপূর্বভাবে চলাচলে বিধিনিষেধ ও সামাজিক দূরত্ববিধির মাধ্যমে মানুষকে একে অন্যের থেকে শারীরিকভাবে দূরে রেখেছিল, যাতে ভাইরাস না ছড়াতে পারে।
তাহলে ভাইরাস ফেরে কী করে?
কনটেনমেন্ট পদক্ষেপ দ্রুত প্রত্যাহার করার কারণে নতুন সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। অন্য কিছু বিষয়ও দ্রুত বৃদ্ধির কারণ হতে পারে যাকে দ্বিতীয় প্রবাহ বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে। ইনফ্লুয়েঞ্জার ক্ষেত্রে ঠান্ডা আবহাওয়া একটা কারণ, যা করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও হতে পারে।
আরও পড়ুন, বর্ষাকালে করোনাভাইরাসের আচরণ
১৯১৮ সালের দ্বিতীয়ার্ধে ঐতিহাসিক ইনফ্লুয়েঞ্জার দ্বিতীয় প্রবাহ দেখা গিয়েছিল যা এই অতিমারীতে অধিকাংশ মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে। কিছু গবেষক মনে করেন, ভাইরাস নিজেকে এমন ভাবে মিউটেট করেছিল যে অধিকাংশ মানুষের প্রতিরোধ ব্যবস্থা তাকে চিহ্নিতই করতে পারেনি।
একে আটকানো যায় কী করে?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ একবারে লকডাউন না তুলে ধাপে ধাপে শিথিল করা হোক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন লকডাউন ছাড়া সংক্রমণ কমানোর উপায় সকলের টেস্টিং ও কনট্যাক্ট ট্রেসিংয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি।
স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে সংক্রমিত ব্যক্তিদের খুঁজে বার করে তাঁদের আইসোলেট করতে হবে, সাম্প্রতিক সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের পরীক্ষা করতে হবে এবং প্রয়োজনে তাঁদেরও আইসোলেট করতে হবে। যদি অনেক মানুষ এই ভাইরাসের সংস্পর্শে আসেন, তাহলে গোষ্ঠী প্রতিরোধ তৈরি হতে পারে যার ফলে রোগ ছড়ানো বন্ধ হবে বা ভ্যাকসিনের লাইসেন্স মিলবে।
সার্সের দ্বিতীয় প্রবাহ হয়নি কেন?
২০০২-০৩ সালে সার্স এশিয়ায় দেখা দিলেও তা অতিমারী পর্যায়ে পৌঁছয়নি। যদিও করোনাভাইরাসের কারণেই এই রোগ তবে তা কোনওসময়েই কোভিড ১৯-এর মত সংক্রামক ছিল না। হাসপাতাল বা অন্য কোনও ডাক্তারি কেন্দ্রে যেখানে সংক্রমিত ব্যক্তির শরীরের তরলের সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনা ছিল, রোগ সেখানেই ছড়াত। ইবোলা এরকম আরেকটি প্যাথোজেন যা মানুষের কাছে অজানা ছিল। আফ্রিকায় মাঝেমাঝে এর প্রকোপ দেখা দিলেও তা কোনও সময়েই সারা পৃথিবীতে করোনাভাইরাসে মত সংক্রামক হয়নি।