মাধ্যমিক পরীক্ষা এবছরও নিষ্কলুষ হতে পারলো না। লেগে গেল কালিমার দাগ। গতকাল মঙ্গলবার শুরুর দিন বাংলা, এবং আজ বুধবার ইংরেজিরও প্রশ্নপত্র আউট। এবছর নাকি অনেক বেশি কড়াকড়ি। পরীক্ষা হলে ফোন নিয়ে যাবার অনুমতি নেই সংশ্লিষ্ট প্রায় কারোরই। তবু কোন মন্ত্রবলে হোয়াটসঅ্যাপে ঘুরে বেড়ায় প্রশ্নপত্র, কে জানে? নাহ, কেউ তো নিশ্চয়ই জানে। এসব ঘটনা অসাবধানে, অনবধানে ঘটে না। কিছু লোকের সুনির্দিষ্ট স্বার্থ থাকে এতে। নাহলে প্রত্যেকবার এক কাণ্ড কী করে ঘটে? মজা হলো, প্রতিবারেই একটা তদন্ত কমিটি গড়ে ফেলা হয়। তারপর কী হয়, তদন্তের ফলে দোষী শাস্তি পায় কি পায় না, সেসব আর জানা যায় না। প্রশাসন কঠোরতম ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ঘোষণাটুকুই করে।
কিছুদিন মিডিয়া জেগে ওঠে। বাজার গরম করে। তারপর সব চুপ। তাদের দিক থেকেও সচরাচর এইসব তদন্ত শেষে ঠিক কোথায় দাঁড়ালো, সেই সংক্রান্ত আপডেট সাধারণ মানুষকে দেওয়ার কোনও দায়িত্ববোধ চোখে পড়ে না। আজকের দিনে সোশ্যাল মিডিয়া নাকি দারুণ ক্ষমতাশালী। জনসমাজে প্রচুর প্রভাব। সেখানে এই নিয়ে হইচই যে হয় না, তা নয়। কিন্তু সেও তেমন দানা বাঁধতে পারে না। তার একটা কারণ, মূলত আমরা কিছুটা হুজুগ, অনেকটাই আবেগে চলি। ঘটনা যতক্ষণ গরম, ততক্ষণ সেই আগুনে নিজেদের 'সমাজ সচেতন ও প্রতিবাদী আমি' নামের ট্যাগটাকে উজ্জীবিত করতে বেশ লাগে। এর বাইরে আমরা সবাই বেজায় ব্যস্ত। মোদ্দা কথা, কিছু হয় না শেষ পর্যন্ত।
আরও পড়ুন: প্রথম দিনেই মাধ্যমিকের প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ
অথচ বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে এই পরীক্ষার ফলাফলের ওপর। বহু ছেলেমেয়ে এমন আছে, যাদের অভিভাবক হয়তো আক্ষরিক অর্থেই ঘটিবাটি বেচে সন্তানকে স্কুলশিক্ষার ন্যূনতম গন্ডি পার করানোর স্বপ্ন দেখেন। সেই পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে এতটুকু গন্ডগোল ভেঙ্গে দিতে পারে সব স্বপ্ন। হয়রানির চূড়ান্ত ঘটে। একই বিষয়ের পরীক্ষা পুনরায় দেওয়া, নম্বরপ্রাপ্তি নিয়ে সংশয়, ইত্যাদি পারম্পরিক ঘটনাপ্রবাহ কুরে কুরে খায় পরীক্ষার্থী ও তার পরিবারকে। বলা বাহুল্য, চিরকালই ক্ষতিটা তাদেরই হয়।
পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে একেবারে, এমন ঘটনাও ঘটে আকছার। বিশেষত গ্রামে এই সংকট বেশি। সাকুল্যে একটি/দুটি স্কুল। অনেক দূরে গিয়ে স্কুলের পড়া ও শেষে মাধ্যমিক। সেই পরীক্ষাও হয়তো দিতে যেতে হবে অনেক দূর। একবার অকৃতকার্য হলে নতুন করে উদ্যোগ নিয়ে আবার মাধ্যমিকে বসা, এটা পেরে ওঠে না অনেকেই। অর্থাৎ এই জাতীয় গন্ডগোল তাদের জীবনে মহা অভিশাপ হয়ে নেমে আসতে পারে। আক্ষেপের কথা, এই নিয়ে তলিয়ে ভাবার সময় নেই পর্ষদ কর্তাদের।
এক্ষেত্রে বেশিদিন পিছিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। গত বছরই মাধ্যমিকের প্রশ্নপত্র পরীক্ষা শুরুর আগেই আউট হয়ে যায়। মহামান্য কোনও এক শিক্ষক নির্দিষ্ট সময়ের আগেই প্রশ্নপত্রের বান্ডিল খুলে ফেলেন। মধ্যশিক্ষা পর্ষদ সাংবাদিক সম্মেলনে ঘটা করে জানায়, দোষী শাস্তি পাবে। কিন্তু দোষী তো আর একজন নয়! রীতিমতো নেটওয়ার্ক তৈরি না করে এই মহৎ কর্মকান্ডগুলি চালানো যায় না, সেটা একটা বাচ্চাও বোঝে। তো, সেই নেটওয়ার্কের জাল ছেঁড়া ও প্রকৃত দোষীর শাস্তি পাওয়ার খবর, মানে গত বছরের আপডেট আমার কাছে অন্তত খুব প্রাঞ্জলভাবে নেই। এ বছর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। গতকাল পরীক্ষা শুরু হয়েছে। কালই,পরীক্ষা শুরু হওয়ার আধঘণ্টার মধ্যেই প্রশ্ন বেরিয়ে গেছে এদিক সেদিক।
এখানেই শেষ নয়। ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে আজও। কিছু ওপরচালাক লোকজন কাল বলতে শুরু করেছিলেন, পরীক্ষা শুরু হয়ে যাওয়ার পর প্রশ্ন আউট হলে আর সমস্যা কী? বোঝো একবার! আরে বাবা, শুরু হয়েছে, শেষ হয়নি। আর এখানে যে ছকে ঘটনাগুলো ঘটে, তার সবটাই পূর্ব পরিকল্পিত। প্রশ্ন বাইরে যায় ভাড়া করা উত্তরদাতাদের জন্য। তারা সেসব পাঠায় অসাধু উপায়ে, টাকাপয়সা খরচ করে যারা পাশ করবে, তাদেরকে। আর এটা বুঝতে রকেট সায়েন্স পড়তে হয় না। অর্থাৎ একজন সৎ ও পরিশ্রমী পরীক্ষার্থীর সঙ্গে একজন অসৎ পরীক্ষার্থীর - যে প্রশ্নপত্রের উত্তর বাইরের কারও সাহায্য নিয়ে পরীক্ষা শেষে জমা দিচ্ছে - কোনও পার্থক্য থাকবে না। এই একই কারণে পরীক্ষা বাতিল হয়ে নতুনভাবে হলেও ভুগবে সেই সৎ ও পরিশ্রমী পরীক্ষার্থীই। কারণ, তখনও সে কোনও অসাধু পথ অবলম্বন করবে না।
চোর পালানোর পর বুদ্ধি খাটানো এখানকার রীতি। অপরাধ বন্ধের চেষ্টা হয় না। অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার নামে নাটক চালু হয়ে যায়। সস্তা রাজনীতি তো আছেই। এ আমল, সে আমল বিভাজনের চর্বিত চর্বনে সময় নষ্ট করা আমাদের গর্বের সংস্কৃতি এখন। আদতে সবটাই আম জনতার চোখে লঙ্কাগুঁড়ো ছড়িয়ে পালানোর চেষ্টা। শাস্তি কে কাকে দেবে? ভূত তাড়াতে যে ওঝা আসবে, তার ঝোলার মধ্যেই তো ভূত। গেরোটা ফস্কা না করলে অনেকের অসুবিধা। এই অনেক যারা, তাদের এলিতেলি ভাবার কোনও কারণ নেই। প্রতি পাঁচ বছরে ভোট পরীক্ষা উৎরে দেন এঁরাই। যা করতে হবে, তা এঁদের রেখেই।
আরও পড়ুন: মাধ্যমিক চলাকালীন মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না শিক্ষকরা, নির্দেশ পর্ষদের
মধ্যশিক্ষা পর্ষদের হলে কড়াকড়ি নিয়ে এত ঢাক বাজাবার কারণ কি এটাই নয়? প্রশ্নপত্র থাকে যাঁদের জিম্মায়, 'লিক' করার প্রথম চাবি তো তাঁদেরই হাতে। কোনও একটি বিশেষ স্কুল বা একাধিক বিশেষ স্কুল অধিকর্তারা তো তার পরের ধাপে। আর তাঁরাও কি পর্ষদের অন্তর্ভূক্ত নন? পরীক্ষাকেন্দ্রে পাহারা শক্ত করে হবেটা কী? এ যেন লখিন্দরের বাসরঘরের দেওয়ালে সাপ ঢোকার ছিদ্র রেখে দরজায় কড়া প্রহরা! কেন্দ্রে কেন্দ্রে পুলিশের টহল, অথচ হাতে হাতে ঘুরছে প্রশ্ন।
আমাদের স্কুলশেষের কথা মনে পড়ে। পুলিশ পরীক্ষার হলে, ভাবাই যেত না। টোকাটুকি হতো না, তা নয়। তবে সেটা এমন সুচারু ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হতে পারেনি। হ্যাঁ, হতে পারেনি কথাটাই বলবো। প্রশাসন না সমাজ, কাকে কৃতিত্ব দেব জানি না। আসলে অসাধু, আত্মপ্রবঞ্চকরা এমন প্রভূত পরিমানে ক্ষমতার অলিগলিতে ছিল না। সদর দরজায় পাহারা বসিয়ে চোরকে খিড়কি খুলে দেওয়ার দিন ছিল না তখন। প্রতিশ্রুতি কম ছিল। কাজ বেশি হতো। এখানে কোনও বিশেষ দলের অধীনস্থ সরকারের কথা বলছি ভেবে তুলনা টানবেন না দয়া করে। এটা একটা জ্বলন্ত বাস্তব পরিস্থিতি।
যে ছেলেমেয়েরা সৎভাবে পরীক্ষাটা দিচ্ছে, তাদের স্বার্থেও অন্তত সত্য সামনে আনা দরকার। পর্ষদ যদি সত্যিই এই অসাধু প্রক্রিয়া বন্ধ করতে চায়, তাহলে সর্ষের মধ্যে যে ভূতটা আছে, তাকে আগে তাড়ানোর উদ্যোগ নিক। কঠিন কাজ। বহু মানুষের ব্যক্তিস্বার্থ জড়িয়ে এই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে। না পারলে সাংবাদিক সম্মেলনে 'এই করেছি আর এই করবো' হুঙ্কার দিয়ে লাভ নেই।