সত্যজিৎ রায়ের 'মহাপুরুষ' ছবিতে একটি বিখ্যাত সংলাপ ছিল, রসিকতা করে লোকে বলে, বাঘের দুধ, জলহস্তির মাংস চাইলে পাওয়া যাবে নিউ মার্কেটে। কিংবা বলা যেতে পারে নিউ মার্কেটের কলিমুদ্দিন! আরে সেই কলিমুদ্দিন যার ডালমুট কিনা খুবই পছন্দের ছিল ফেলু মিত্তিরের। এমনকি বুদ্ধদেব গুহর বিখ্যাত উপন্যাস ‘হেমন্তবেলায়’ উল্লেখ রয়েছে নিউ মার্কটের। সত্যজিৎ বাবুর ‘নেপোলিয়নের চিঠি’র রহস্যে! সেই বইয়েরও তো কেন্দ্রবিন্দু ছিল নিউ মার্কেটের তিনকড়ি বাবুর পাখির দোকান। এরকম কতশত বই, ছবিতে, লেখায় বারবারই নিউ মার্কেটের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে তা হিসেব করে বলা মুশকিল। কতই না গল্প ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে নিউ মার্কেট জুড়ে। কলকাতার অন্যতম এই প্রবীণ মার্কেটে ছবির সঙ্গে বাস্তবের মিল খুঁজতে গেলে সত্যিই হয়তো পাওয়া যাবে সে সব জিনিস। আলপিন টু এলিফেন্ট খুঁজলে সবই মেলে কলকাতার ১৫০ বছরের বেশি পুরনো ধর্মতলার এই বাজারে। জামা জুতো তো বটেই।
ঐতিহ্য আর নস্ট্যালজিয়া। কলকাতা শহরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। যেমনটা বাঙালির জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পুজো এবং শপিং। আর শপিংয়ের কথা বলতে গেলে সেই চলে আসবে ‘হগসাহেবের বাজার’ কিংবা ‘স্টুয়ার্ট হগ মার্কেটের নাম অর্থাৎ কিনা নিউমার্কেট। পুজোর বাকি আর কয়েক সপ্তাহ। হাতে আর মাত্র কয়েকটা দিন। একটা সময় ছিল যখন পুজোর কেনাকাটা চলত কলকাতার হাতে গোনা কয়েকটা বাজারে। তারই মধ্যে সবার প্রথমে নাম আসত ধর্মতলার এই মার্কেটটির।
নিউ মার্কেট শুধু একটা সাধারণ বাজার নয়, বাঙালির কাছে নস্টালজিয়া, ঐতিহ্য, অহংকারও বটে। বলা যেতে পারে কলকাতার সব থেকে পুরনো শপিং মল। দেশ-বিদেশের পর্যটকরা কলকাতায় এসেছেন, অথচ নিউ মার্কেট ঘুরে দেখেননি, এমন সংখ্যাটা নেহাতই হাতে গোনা। নিউ মার্কেট মানে শুধুই কি শপিং? না। এর বাইরে নিউ মার্কেটর অন্য একটা দিকও আছে যেটা আমাদের অনেকের কাছেই হয়তো অজানা। নিউ মার্কেটের পরতে পরতে রয়েছে ইতিহাস। যদিও সেই ইতিহাস নিয়ে এখন কারও মাথা ব্যথা নেই। সব থেকে পুরনো এই শপিং ডেস্টিনেশনকে টেক্কা দিতে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে তৈরি হয়ে গিয়েছে নানান শপিং মল। কিংবা অনলাইন শপিং। উত্তর থেকে দক্ষিণ ঝাঁ চকচকে, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বেশ কয়েকটি মলগুলোর সঙ্গে পলেস্তারা খসা মার্কেটের দোকানগুলো বড্ড বেমানান।
কলকাতা পৌরসভার তথ্য অনুযায়ী, ১৮৭৪ সালে এই বাজারটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটিই কলকাতার প্রথম মিউনিসিপ্যাল মার্কেট। পরবর্তীতে ১৯০৩ সালে স্যার স্টুয়ার্ট হগের নামানুসারে এই বাজারের নাম রাখা হয় হগ মার্কেট। লোকে বলত হগ সাহেবের বাজার। শহরের আনাচে কানাচে গজিয়ে ওঠা শপিং মল তো হালে হয়েছে। নিউ মার্কেটের সাজানো গোছানো মলগুলি দেখলে বোঝা যায় যে শপিং মলের ধারণা সেই আমলেই ইংরেজরা তৈরি করে গেছে। সত্তর বছরের পুরনো শাড়ি, সালোয়ারের দোকান মহম্মদ সৈয়দের। তাঁর কথায়, নয়ের দশকে পুজোর আগে নিউ মার্কেটে মানুষে মানুষে গিজগিজ করতো। সময়ের সঙ্গে সেই ভিড় এখন কমে গিয়েছে। মার্কেটের থেকে বেশি ভিড় হয় বাইরে। বছর তিন চারেক আগেও পুজোর সময় যা ব্যবসা হত এখন তার কিছুই হয় না।
মার্কেটের মধ্যে পর পর সারিবদ্ধ দোকান। মার্কেটের ভিতর দোকানেরই লোক ছাড়া গ্রাহক হাতে গোনা। পুজোর আগে বাজারের এরকম ছবি দেখে অনেক দোকানীর কপালে ভাঁজ স্পষ্ট। মার্কেটের মধ্যে জামা কাপড়ের দোকানে কাজ করেন চন্দন বাউড়ি। "আমি সেলসম্যানের কাজ করছি পনেরো কুড়ি বছর ধরে। নিউমার্কেটের মধ্যে আগে কলকাতার কাস্টমার বেশি আসত এখন বাইরের কাস্টমার বেশি। বাংলাদেশ থেকে যাঁরা ঘুরতে আসেন তাঁরাই এখানে বেশি কেনাকাটা করেন। করোনার পর থেকে ব্যবসা একদম শেষ। পুজোর বাকি আর কিছুদিন। এখনও সেভাবে বাজার জমেনি "।
বর্তমানে যে হারে কলকাতায় মল এবং অনলাইন শপিং করছে মানুষ তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঠিকে থাকা খুবই মুশকিল! দোকানের মালিকরা নিজেরাই স্বীকার করে নিচ্ছেন নিজেদের করুণ পরিস্থিতির কথা। মার্কেটের বাইরেও যে হারে ভিড় হয় তার এক চতুর্থাংশ মানুষ নেই মার্কেটে। সকাল ৯টা-১০টা থেকে নিউ মার্কেট খোলা থাকে রাত ১০টা পর্যন্ত। নিউমার্কেটে গাড়ি রাখার অসুবিধার জন্যেও অনেকে মুখ ফিরিয়েছেন। একটা সময় ছিল যখন নিউমার্কেটে এলাকায় পর পর অনেকগুলো সিনেমা হল ছিল। যার বেশিরভাগই এখন বন্ধ। সিনেমা দেখতে এসে কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরতেন অনেকেই। এই দৃশ্যে আর দেখা যায় না। হারিয়ে গিয়েছে পুরনো জৌলুস। চাকচিক্যে ভরা কলকাতার নবীন শপিং মলগুলোর মাঝেও নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রতিনিয়ত লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে কলকাতার এই প্রবীণ মার্কেট।