Advertisment

অনাবৃত ৩৭: সন্দেহের তালিকা কীভাবে তৈরি হল?‌

ছুরিতে ইন্টারেস্ট নেই বসন্ত সাহার। তিনি মনে করেন এই হত্যা রহস্যের সঙ্গে ছুরির কোনও সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক রয়েছে বিষের।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Anabrito, Pracheta Gupta Novel

গ্রাফিক্স- অরিত্র দে

সাগ্নিক বলল, ‘‌হতেও তো পারে স্যার।’‌
বসন্ত সাহা বললেন, ‘‌না পারে না। তাহলে বিষ বা বিষের কনটেনার পেতাম। ঘরে সেরকম কিছু পাওয়া যায়নি। লুকিয়ে কোথায় রাখবে?‌ ঘর সার্চ হয়েছে। পারফিউম, লোশন, ক্রিমের শিশি চেক করা হয়েছে।‌ আমি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি বলেছেন। যেভাবে দুটো জিনিস মিশিয়ে এই বিষ তৈরি হয়েছে, তাতে কার কখন অ্যাকশন হবে বলা মুশকিল। কারও সঙ্গে সঙ্গে কারও তিন–‌চার ঘন্টা পরেও হতে পারে। দ্য মিকসচার অব ‌ডি.‌ স্ট্র‌্যামোনিয়াম অ্যান্ড ‌ওপিয়াম ইজ কমপ্লিটলি আনপ্রেডিকটবল্‌। ইট হ্যাজ নো স্পেশিফিক অ্যান্টিডোট অলসো। তুমি তো জানো সাগ্নিক বিভিন্ন ধরনের পয়েজনের বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিডোট থাকে। ক্যারেক্টর, কম্পোজিশন ধরে ধরে তাদের লিস্ট করা আছে। সেভাবে ট্রিটমেন্ট হয়।‌’‌ ‌
সাগ্নিক বলল, ‘‌তাহলে মেহুলকেও সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ রাখতে হয়।’‌
বসন্ত সাহা বলেছিলেন, ‘‌নতুন কোনও ইনফরমেশন না পাওয়া পর্যন্ত। যদি পাওয়া যায় তখন মত বদলাতে হবে। ইনভেস্টিগেশন তো কখনও রিজিড হয় না।’‌

Advertisment

দুজনেই একমত হয়েছে, বাকিদের মধ্যে থেকে একজন বা একাধিকজন এই জোড়া খুনের সঙ্গে জড়িত। ভেবেচিন্তে বিষ তৈরি করা হয়েছে। যাতে মৃত্যু অবধারিত হয়। চট করে এর কোনও অ্যান্টিডোট দিয়ে চিকিৎসা করা না যায়। সেই বিষ কায়দা করে দুজনকে খাওয়ানো হয়েছে। ফলে এদের কথা থেকেই বুঝতে হবে। সন্দেহ হলে চেপে ধরতে হবে।

জিজ্ঞাসাবাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো মাথায় গেঁথে নিয়েছেন বসন্ত সাহা। আজ সারাদিন ধরে অফিসে বারবার পড়েছেন। মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। এখন আবার পুরোটা মনে করবার চেষ্টা করছেন। যেটুকু মনে পড়ছে না, সেটুকু নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না। নিশ্চয় সেটা তত গুরুত্বপূর্ণ নয়, হলে মনে থাকত। এদের কথার ফাঁকে ফোকরে কোথাও কি কোনও কাঁটা রয়েছে?‌ যে কাঁটা মাথার ভিতর খচ্‌খচ্‌ করবে?‌

বসন্ত সাহা ইজি চেয়ার ছেড়ে স্টাডিতে গেলেন। টেবিলে বসে অফিসের কাগজপত্র ঘাঁটতে শুরু করলেন। ইন্টারগশেনের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো আবার পড়তে হবে। কাঁটা নিশ্চয় কোথাও লুকিয়ে আছে।

আরও পড়ুন, নোবেল লরিয়েট অভিজিত বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে দেবেশ রায়ের কথা

হঠাৎই তাঁর মনে পড়ে গেল এমন একটা কথা, যার সঙ্গে এই হত্যাকাণ্ডের কোনও সম্পর্ক নেই। শিল্পী অগুস্ত র‌্যনোয়ার বলেছিলেন, ‘‌আমি তো নতুন কিছু করিনি, আমার পূর্বসূরীরা যে কাজ করেছেন তারই পুনরাবৃত্তি করেছি।’‌

এই কথা এই সময় মনে হওয়ার কারণ কী!‌ বসন্ত সাহা নিজের ওপর বিরক্ত হলেন। তিনি একজন দায়িত্ব সম্পন্ন পুলিশ অফিসার। সঙ্গীত, শিল্পকলা ধরনের বিষয়ে মন দিয়ে ফোকাস নষ্ট করে ফেলছেন না তো?‌ তিনি পিঠ সোজা করে বসে কাগজপত্র টেনে নিলেন। তখনও তিনি জানেন না, জোড়া হত্যার রহস্য উদ্‌ঘাটনে শিল্পী র‌্যানোয়ার এই কথা কত কাজে লাগবে। তিনি জিজ্ঞাসাবাদের প্রথম পাতা খুললেন।

কঙ্কণা—মুকুরদি আর সুনন্দদার সম্পর্ক খুব ট্রান্সপারেন্ট নয়। মুকুরদিকে কেউ বেশি পছন্দ করুক সুনন্দদা মেনে নিতে পারত না। আমার হাজব্যান্ড পলাশ ওয়াজ লিটল সফট অ্যাবাউট মুকুরদি। সুনন্দদা আমাকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে সে কথা জানিয়ে দিয়েছিল।

আরও পড়ুন, সন্মাত্রানন্দের কলাম ধুলামাটির বাউল

পলাশ—আমার সুনন্দকে কোনওদিনই পছন্দ নয়। মুকুরদিকে আমার ভাল লাগে। তবে সম্পর্ক করবার মতো কিছু নয়। আলাদা করে যোগাযোগ নেই। আমি ইনড্রাস্টিয়াল কেমিক্যালসের বিজনেস করি। বিভিন্ন কারখানায় সাপ্লাই দিই। স্পেশালি রাবার ফ্যাক্টরিতে। বাবার মোল্ড করতে লাগে। যদিও আমার স্ত্রী বলে, আমি নাকি বিষের ব্যবসা করি। সুনন্দদার স্টমাকে যে বিষ পাওয়া গিয়েছে তার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই।

উজ্জ্বল- ছেলেবেলায় মুকুরের প্রতি আমার একটা ক্রাশ হয়েছিল। এমন ঘটনা সবার জীবনেই আছে। বাট এখন সে সব থেকে আমি অনেক দূরে। আর হ্যাঁ, এই বিষয়টা নিয়ে আমি সেদিনও মুকুরের সঙ্গে মজা করেছি। বলেছিলাম, তোর বরের জন্য বিষ নিয়ে যাব। জানি না, সে পুলিশের কাছে একথা বলেছে কিনা। আমি বলে রাখলাম। ইট ওয়াজ আ ফান। একেবারে নির্ভেজাল মজা। আপনার নিশ্চয় বুঝবেন। এত বছর পর ঘোষণা করে কাউকে খুন করবার মতো মানুষ আমি নই।

নয়নিকা— আমার বর এমনই একজন পুরুষ, যার সঙ্গে মেয়েদের প্রেম করতে চাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।‌‌‌ তবে সে আমার প্রতি হান্ড্রেড পার্সেন্ট কেয়ারিং এণ্ড রেসপনসিবল্‌। মুকুরদির প্রতি জেলাস হলে সুনন্দদাকে নিশ্চয় খুন করতে যাব না।

‌প্রতীক— আমি জানি, আমার ওপর আপনাদের সন্দেহ সবথেকে বেশি। সেটাই স্বাভাবিক। আমি পুলিশ হলে, আমিও সেই সন্দেহ করতাম। কারণ দু–‌দুটো মৃত্যুর বিষ ছিল খাবারের মধ্যে। যদিও সামান্য কটা টাকা ধার পাইনি বলে খাবারে বিষ মিশিয়ে দুটো মানু্ষকে মেরে ফেলব এমন উন্মাদ বলে কি আমাকে আপনাদের মনে হচ্ছে?‌ টাকার পরিমাণটা শুনলে আপনারা অবাক হবেন। মাত্র দু’‌ লক্ষ। দু’‌ লক্ষ টাকার জন্য সারাজীবন জেলে পচব?‌ আর একটা তথ্য আপানাদের জানি রাখি। আপনারা হয়তো মনে করছেন, পার্টি ভেস্তে যাওয়ার পর আমি খাবারগুলো সরিয়ে ফেলি এবং ফেলে দিই যাতে কেউ বুঝতে না পারে যে ওতে বিষ মেশানো ছিল। এই তথ্য ঠিক নয়। খাবারগুলো আমাদের স্টাফেরা ভাগাভাগি করে নিয়ে যায়। তারা বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খেয়েওছে। কারও শরীর খারাপ হয়নি। বদহজমটুকু পর্যন্ত নয়। আপনার খোঁজ নিন। স্যার, সামান্য কিছু স্টার্টার ছাড়া আমাদের সার্ভ করা কোনও খাবার তো কেউ খায়নি। পনির পকোড়া আর চিকেন ড্রামস্টিকে কি আমার নুনের বদলে বিষ ছড়িয়ে দিয়েছিলাম?‌ জানি ম্যাডাম আমাদের নামে কনপ্লেন করেছেন। ওর এখনও মাথার ঠিক নেই।

এখানে এসে থমকালেন বসন্ত সাহা। এই লোককে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে ঠিক কাজই হয়েছে।
এই জিজ্ঞাসাবাদের আগে মুকুরেরে সিক্রেট ডায়েরি এবং সাগ্নিকের হোমওয়ার্কে কাজে দিয়েছে। তবে এখন সবথেকে জরুরি কাজটা চলছে। সাগ্নিক সকলের মোবাইল নম্বর থেকে তাদের কললিস্ট জোগাড় করছে। নম্বর গেছে মুকুরের কাছ থেকে। গেস্টদের মধ্যে কেউ কি কারও সঙ্গে কথা বলে?‌ সেটা দেখাই মূল উদ্দেশ্য। এই লিস্ট থেকে বোঝা যাবে হত্যার কাজটা কারও একার নাকি?‌ সঙ্গে আরও কেউ ছিল। এটা জানতে পারলে রহস্য অনেকটা সহজ হয়ে যাবে। তবে কল লিস্ট বানাতে গিয়ে সবথেকে বড় সমস্যা হল কারও যদি দুটো বা তার বেশি সিম থাকে। ফোন করে জানতে চাওয়া হয়েছিল। কেউ দিয়েছে তার আরেকটা নম্বর দিয়েছে, কেউ বলেছে নেই। কেউ গোপন করল সেটা ধরবার জন্য সাইবার ক্রাইম ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা মোবাইল নেট ওয়ার্কের সার্ভিস প্রোভাইডারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। দু একদিনের মধ্যে বলে দেবে। সেই কারণেই সময় লাগছে। যে গোপন করেছে তাকে নতুন করে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।

বসন্ত সাহা সাগ্নিকের সঙ্গে কথা বলে ইতিমধ্যে দুটো লিস্ট বানিয়ে ফেলেছেন। সন্দেহ আর সন্দেহের বাইরের লিস্ট। পাশে প্র‌য়োজন মতো কারণও লেখা হয়েছে। খানিকটা কল্পনা দিয়ে, খানিকটা যুক্তি দিয়ে। জেরা আর খোঁজ খবরের ভিত্তিও রয়েছে। ফোনের কল লিস্ট পেলে এই দুটো তালিকাই চুড়ান্ত হবে।

ছন্দা ঘরে এলেন।
‘‌একটা জিনিস দেখবে?‌’
বসন্ত সাহা চোখ খুলে বললেন, ‘‌কী ‌জিনিস?‌’‌
ছন্দা চেয়ারের কাছে এগিয়ে এলেন। স্বামীর কাঁধের পাশ দিয়ে হাতের মোবাইলটা এগিয়ে ধরলেন।
‘‌এই ছবিটা দেখো। সেদিন মুকুরের পার্টিতে তুলেছিলাম। টেবিলের ওপর এই যে লাল সেডের বাঁশের টেবিল ল্যাম্পটা জ্বলছে, ওটা আমার দেওয়া। হস্তশিল্প মেলা থেকে কেনা। কী সুন্দর না!‌ বাঁকুড়ার একটি মেয়েটি তৈরি করছিল।’‌
বসন্ত সাহা অস্ফুটে বললেন, ‘বাঃ।’‌‌
ছন্দা বলল, ‘‌ছবিটা হঠাৎ চোখে পড়ল। মনটা খারাপ হয়ে গেল। মুকুর সেদিনই আলোটা জ্বালিয়ে দিয়েছিল। ইস ওর জীবনের আসল আলোটাই নিভে গেল।’

আরও পড়ুন, মি টু নিয়ে কী বললেন নান্দীকারের সোহিনী সেনগুপ্ত

বসন্ত সাহা মোবাইলটা হাতে নিলেন। ভারি স্বরে বললেন, ‘তখনও কেক কাটা হয়নি। এই যে ট্রের ওপর সাজানো রয়েছে। ওপরে লেখাটাও পড়া যাচ্ছে। হ্যাপি বার্থ ডে। পাশে ওটা কী দেখা যাচ্ছে?‌ কাঠের মতো.‌.‌.কেকের ট্রে থেকে উঁকি দিচ্ছে.‌.‌.‌ ‌‌’‌
ছন্দাও মোবাইল হাতে নিয়ে ভাল করে বললেন, ‘আরে ওটা তো ছুরি‌‌র হাতল। বাট। কাঠের সুন্দর কাজ করা।‌ সেদিনই খেয়াল করেছিলাম। এটা দিয়েই তো কেক কাটা হল। হৈমন্তী মেয়েটা কাটল।’‌

বসন্ত সাহা বললেন,‌ ‘‌ও।’‌

ছুরিতে তাঁর ইন্টারেস্ট নেই। এই হত্যা রহস্যের সঙ্গে ছুরির কোনও সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক রয়েছে বিষের।
——————

এই ধারাবাহিকের সব পর্ব একসঙ্গে পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে

Anabrito
Advertisment