Advertisment

অন্য পক্ষ: বিজেপিতে কি জায়গা ফাঁকা আছে?

সময় বুঝে একবার বিজেপি হয়ে যেতে পারলে তখন কিন্তু ডারউইনের কথা সারসত্য বলে মেনে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিপ্লব স্পন্দিত বুকে আপনিই লিখতে পারেন নতুন তত্ত্ব।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
BJP, Editorial

গ্রাফিক্স- অভিজিত বিশ্বাস

ডানপন্থীরা যখন এগোয় তখন তাদের থামানো শক্ত। বিশ্ব-ইতিহাসে যতই বামপন্থীদের নিয়ে সর্বহারার শৃঙ্খল মোচনের উপন্যাস লেখা হোক না কেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দাপট ডানপন্থীদের। সভ্যতার শুরু থেকেই দাপিয়ে বেঁচে থাকার তত্ত্ব চালু। ডারউইন সাহেব তো বুঝলেন অনেক দেরিতে, ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে। তার অনেক আগে থেকেই মারধর শুরু। যে শক্তিশালী সে দুর্বলকে ঠেঙাবে। পৃথিবীতে দুটো শ্রেণী, একদল কোঁৎকা মারবে, একদল খাবে। এটাই নিয়ম। শক্তিশালী বাঁচবে, দুর্বল অক্কা পাবে।

Advertisment

তবে দুর্বলেরও বাঁচার উপায় আছে, তা হল কোনও শক্তিশালীর লেজ ধরে থাকা, পরজীবীত্ব। এভাবেই জগৎ এবং মানবসভ্যতা এগোয়। আজকের দিনেও রাস্তায় কোন অসুস্থ নিম্নবিত্ত মানুষ চিৎপাত হয়ে পড়ে থাকলে নিজে থেকে বাঁচতে পারে না। তাকে বাঁচানোর জন্যে শক্তিশালী মানুষদের দাক্ষিণ্য প্রয়োজন। তাঁরাই নিশ্চয়তা দেন নিশ্চয়-যান পাঠানোর। সভ্যতা যে দুর্বলকে রক্ষা করার কথা বলে তা আসলে লোকদেখানো। আদতে সভ্যতার সংজ্ঞায়ন করেন ক্ষমতাশালী মানুষ। আর দুর্বলকে যেটুকু ইচ্ছা সেভাবেই বাঁচান, অথবা বলা ভালো বাঁচার সুযোগ দেন। সেই ছাগলেরাই বেঁচে থাকে, মানুষ যাদের বাঁচিয়ে রাখে। বাকিরা কাবাব, কিংবা পেঁপে দিয়ে রবির দুপুরে হাল্কা ঝোল।

আরও পড়ুন, আধারের আঁধারে আলোর হদিশ

বামপন্থীদের তত্ত্বে এসবের জায়গা নেই, সেখানে পুরোটাই সাম্যবাদ। তবে সেটা তত্ত্বে। তাঁরাও যখন ক্ষমতায় আসেন, তাদের বাছা নেতৃত্ব আসলে যে শাসনব্যবস্থা চালান, তার সঙ্গে ডানপন্থার কোন পার্থক্য নেই। এ প্রসঙ্গে বলে নেওয়া প্রয়োজন যে সভ্যতার অগ্রগতিতে একটাই বড় পরিবর্তন ঘটেছে পুরাতন বা নতুন প্রস্তর যুগের তুলনায়। তা হলো আজকাল শক্তি বলতে শুধু পেশির জোর বোঝায় না, ঘিলুরও সেখানে কিছু অবদান আছে। উত্তম গুণাগুণ সম্পন্ন অস্ত্র বলতে এইসময় শুধু গায়ের জোরে শান দেওয়া কাস্তে বোঝায় না। সেখানে প্রযুক্তির কৃপায় বোতাম টিপে নিউ ইয়র্ক থেকে সিরিয়ার নিরপরাধ অবোধ শিশুর মুণ্ডু চটকে দেওয়া যায়।

ফলে আজকের পৃথিবীতে মানুষের বুদ্ধির ডানপন্থা সম্পূর্ণ দখল নিয়েছে জীবজগতের। সবার মঙ্গল তাই অসম্ভব। তবে শক্তিশালী হলে বা সেই শ্রেণির আশেপাশে থাকলে মঙ্গললাভের সম্ভাবনা এবং সুযোগ বেশি। সেই কারণেই বাঁচতে গেলে আপাতত ডানপন্থীদের দলে যোগ দেওয়া ভাল, এবং বুদ্ধি থাকলে "জয় শ্রীরাম" স্লোগান দিয়ে সেটাই করা উচিৎ দলে দলে। সেই হিসেবে ভিড়ভাট্টায় কলকাতায় বিজেপি অফিসে যোগ দিতে অসুবিধে হলে উড়োজাহাজে দিল্লি গিয়েও যোগদান জরুরি। ডারউইনের তত্ত্বের সারকথা হলো, ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় থাকা। জীবনবিজ্ঞান এবং পদার্থবিদ্যা সেখানেই মিলেছে খাপে খাপ। আর সেটা বুঝতে পারলেই ভালভাবে বাঁচা সহজ।

সময় বুঝে একবার বিজেপি হয়ে যেতে পারলে তখন কিন্তু ডারউইনের কথা সারসত্য বলে মেনে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিপ্লব স্পন্দিত বুকে আপনিই লিখতে পারেন নতুন তত্ত্ব। যেমন বিজেপির সাংসদ সত্যপাল সিংহ একবার নয়, বারবার ডারউইনের তত্ত্বের বিরোধিতা করেছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল তাই আসার অপেক্ষায়। এইসব বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞান বোঝার জন্যে গভীর বিশ্লেষণের প্রয়োজন। তাঁর বক্তব্য সার্বিকভাবে সবলের (‘সবল’-এর মাঝের অক্ষরে আঁকড়া ঝুলিয়ে ‘সকল’ ভাববেন না) বেঁচে থাকা নিয়ে নয়। বরং ডারউইনের বিবর্তন সংক্রান্ত তত্ত্বের একটি ছোট অংশের। তা হলো, মানুষ কোথা থেকে এসেছে? সাম্প্রতিক সময়ে সিংহ মহাশয়ের বক্তব্য, মানুষ বাঁদর থেকে আসে নি, জন্মেছে ঋষিদের থেকে। মানবাধিকার সম্পর্কে ভারতীয়দের অতীত সংস্কৃতি আলোচনায় তিনি এই কথা টেনে এনেছেন।

আরও পড়ুন, রাজনীতিনামা: বাংলায় বিজেপি উত্থান

এই যে মানবাধিকারের সঙ্গে মুনি-ঋষিদের চটজলদি যোগসূত্র, এর মধ্যে চিরাচরিত ডানপন্থার প্রতিটি বৈশিষ্ট্য বর্তমান। যেখানে সত্যি-মিথ্যে আলাদা করার প্রয়োজনীয়তাই নেই। জুলে ভার্ন আশি দিনে বিশ্ব পারাপারের গল্প লিখলে চেটেপুটে পড়ব, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি উড়োজাহাজের নকশা আঁকলে হাততালি দেব, আর আকাশপথে সীতা উড়লে রাবণকে কৃতিত্ব দেব না? কৌরবদের শত ভাই তো আর আমাদের সৎ ভাই নয়। ভীষণভাবে আমাগো পূর্বপুরুষ। জীববিজ্ঞানে অনেকটা না এগিয়ে গেলে কি আর একাই একশো হওয়া যায়? সে গর্ব ভুলে অপবিজ্ঞান বলে চেঁচালে বিবর্তন বন্ধ। বিজেপির সদস্যপদ দেওয়া হবে না আর। সেক্ষেত্রে অস্তিত্ব সংকট।

বিজ্ঞান তো হলো, এবার সমাজতত্ত্বে ফেরা যাক। প্রশ্ন উঠবে, ডান-বাম ঠিক করে দিল কোন অর্বাচীন? বিজেপিকে বামপন্থী বলতে অসুবিধে কোথায়? ডানহাতকে বাঁহাত কিংবা উল্টোটা বললে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়? আসলে গোলমালটা শুরু হয়েছে দুশো বছরেরও আগে। ফরাসী বিপ্লবের সময় (১৭৮৯-৯৯) থেকে এই ডান-বাঁ ব্যাপারটা চালু। রাজার দলের লোক বসত ডানদিকে আর প্রতিবাদীরা বাঁদিকে। সেই থেকে পন্থার দিকনির্দেশ। বিংশ শতাব্দীর আগে খুব একটা বাজারি হয় নি এই নামকরণ। তারপরই তো ডান-বামের কাজিয়া জোরকদমে শুরু। গত শতকে এই নিয়ে আলোচনা এত হয়েছে যে খাতার মাঝখানে লম্বা দাগ টেনে পার্থক্য লিখলে খুব সহজেই সেই পাতাগুলো সাজিয়ে কলকাতা থেকে প্যারিস পৌঁছে যাওয়া যাবে।

প্রথম আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অবশ্য পুরো যুদ্ধ ডানে-ডানে, শুধু সোভিয়েতের নামে বাম ছাপ মারা ছাড়া। তবে এত যুক্তি না সাজিয়ে একেবারে সোজা বাংলায় শাসককে ডান আর শোষিতকে বাম বলে দিলে আপাতত সমস্যার সহজ সমাধান হয়। আর সেই হিসেবে বিজেপিই বলুন আর সিপিএম, ক্ষমতায় থাকলে সবাই ডান আর সেখান থেকে দূরে সরতে শুরু করলে বামপন্থার রমরমা। এমনটাই সংজ্ঞা ছিল এতকাল। তবে এবার বিজেপির দ্বিতীয় ইনিংসে সংজ্ঞা বদলের সময় এসেছে।

আরও পড়ুন, গণতন্ত্রের স্বার্থে এবার দ্রুত ঘর গোছাক কংগ্রেস

তাই ২০১৯-এর জলকষ্টে ভোগা বর্ষায় আপাতত সবাই বিজেপিমুখী - শাসক (শোষক নয় মোটে) এবং শোষিত। ওপরের দিকে বিজেপিতে যোগ দিলে টেলিভিশনে ভীষণ খবর, নীচের দিকে পতাকা হাতে মিছিলে হাঁটলে ফুটনোটে অনুগামী হিসেবে যোগদান, আর মনে মনে বিজেপি হলে কোন বখেড়াই নেই। বিশ্বাসে মিলায় বিজেপি, তর্কে বহুদূর। একটা প্রশ্ন থাকবে, বিজেপিতে জায়গা কত? পিরামিডের নিয়মে ওপরের দিকে জায়গা কম, কিন্তু তৃণমূল স্তরের সমর্থক হলে তো কোন অসুবিধেই নেই। দলের গোড়া শক্ত হবে। শেষমেশ সবাই বিজেপি হয়ে গেলে ডান বাম সব এক। ভারতে আসবে একদলীয় জনগণতান্ত্রিক সংসদীয় ব্যবস্থা। ভোটযন্ত্রের বোতাম সংলগ্ন একাধিক প্রার্থী থাকলে সবার পাশে পদ্মফুল।

তবে উপসংহারে প্রশ্ন আসবে যে বিজেপির চিন্তনদল কি তা চাইবে? বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রে দায়িত্ব কম, ক্ষমতা বেশি। বিরোধী থাকলে তাদের দিকেও আঙুল তোলা যায় সময় বিশেষে। কিন্তু সবটাই একদল হয়ে গেলে তখন তো আঙুলের মহাবিপদ। তাই বুদ্ধিমান বিজেপি হয়ত এবার ওপরের দিকের লোক নেবে বেছে বেছে। আর অন্যদলের বাকি নেতারা গেরুয়া হতে চাইলে সন্তর্পণে তাদের অনুরোধ করবে বিরোধী সেজে থাকার। কেন্দ্র আর প্রায় সব রাজ্যের সরকার তো দখল হয়ে গেছেই - ভোট পদ্ধতিতে কিংবা দল ভাঙিয়ে। নতুন নেতাদের জন্যে তাই বিজেপিতে ফাঁকা জায়গা কমছে। রিসর্টের আমোদ ছেড়ে একটু পা চালিয়ে ভাই…

(শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)

Anyo Paksha
Advertisment