/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/rajnitinama-1308-759.jpg)
ছবি- ইন্ডিয়ানএক্সপ্রেস গ্রাফিক্স- অভিজিত বিশ্বাস
৪ মার্চ ২০০৫। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেডিয়ামে ভেনেজুয়েলার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি, প্রয়াত হুগো শাভেজ বক্তব্য রাখছেন। চারদিকে ছাত্র-ছাত্রী স্লোগান দিচ্ছে ‘শাভেজ, কাস্ত্রো, হোচিমিন, উই শ্যাল ফাইট, উই শ্যাল উইন’ (শাভেজ, কাস্ত্রো, হোচিমিন, আমরা লড়ব, আমরা জিতব)। কেউ আবার স্প্যানিশ ভাষায় স্লোগান তুলছে: ‘এল পুয়েব্লো ইউনিদো জামাস সেরা ভেনসিদো’ (ঐক্যবদ্ধ জনগণকে কেউ হারাতে পারে না)। স্টেডিয়ামের সিড়িতে এক বামপন্থী ছাত্র নেতাকে জিজ্ঞেস করলাম ‘আচ্ছা, শাভেজের দলের নাম কী?’ সেই নেতা হতভম্ব হয়ে বললো ‘তা তো জানি না’। আজ থেকে প্রায় দেড় দশক আগে মোবাইল ফোনে যে গুগল সার্চ করে উত্তর জানব তারও কোনো উপায় নেই। তবে আজকেও বহু রাজনৈতিক পণ্ডিত এক বাক্যে শাভেজের রাজনৈতিক দলের নাম করতে পারবেন না। তার কারণ শাভেজকে অনেকে চিনলেও তাঁর দলের নাম (ইউনাইটেড সোশ্যালিস্ট পার্টি অফ ভেনেজুয়েলা) হয় কোনোদিন শোনেননি বা তাঁর দল সম্পর্কে অবহিত নন। কিন্তু বামপন্থী রাজনীতিতে তো ব্যক্তির থেকে দলের গুরুত্ব ও পরিচিতি অনেক বড় হবার কথা। এক্ষেত্রে নেতার খ্যাতি দলের থেকে বেশি হল কী করে? এটা কি শুধুমাত্র একটা বিচ্যুতি? নাকি একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা?
আরও পড়ুন, সকলকে সঙ্গে নিয়ে চলেন বলেই ভারতরত্ন প্রণব
যদি দেশ-বিদেশের রাজনীতির দিকে তাকানো যায় তাহলে আরও পরিষ্কার হবে যে দলের থেকে ক্ষমতাশালী নেতা-নেত্রীর জয়গান ইদানিং বেশ চোখে পড়ছে এবং তা ডান-বাম সমস্ত রাজনীতির ক্ষেত্রেই হচ্ছে। ধরা যাক গত পাঁচ বছরে আমাদের দেশের দক্ষিণপন্থী মতাদর্শের ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি-র) কথা। ২০১৪ সালে বিজেপি নির্বাচনী স্লোগান তুলেছিল ‘অবকি বার মোদী সরকার’ (এবার মোদী সরকার) এবং ‘হর হর মোদী, ঘর ঘর মোদী’। ২০১৪ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত পাঁচ বছর সাধারণ মানুষ থেকে সংবাদমাধ্যম, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কে মূলত ‘মোদী সরকার’ নামেই ডাকল। বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার বলে নয়। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি স্লোগান দিল ‘ফির একবার মোদী সরকার’ (আরেকবার মোদী সরকার)। ২০১৯ লোকসভার পর ভারতের বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারকে দ্বিতীয় মোদী সরকার বলে অভিহিত করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে বলছেন পদ্ম চিহ্নে ভোট দিলে সেই ভোট সোজা মোদীর খাতায় যাবে। সমসাময়িক রাজনীতির ময়দানে এহেন ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রচার ভারত আগে দেখেনি। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ১৯৯৬, ১৯৯৮ এবং ১৯৯৯ লোকসভা নির্বাচনে তোলা বিজেপির ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্লোগান—‘সবকো দেখা বারি বারি, অবকি বারি অটল বিহারি’ অথবা ‘বারি বারি সবকি বারি, অবকি বারি অটল বিহারী’র তুলনায় মোদী কেন্দ্রিক স্লোগান অনেক বেশি সফল। বিজেপির মতো একটি ক্যাডার ভিত্তিক ও যৌথ নেতৃত্বে বিশ্বাসী দলে কিভাবে সেই ব্যাক্তিকেন্দ্রিকতা স্থান পায়? আমাদের দেশে ইন্দিরা গান্ধীর রাজত্বকালে ব্যক্তিপুজোর প্রবণতা দেখা দিয়েছিল। পরবর্তীকালে বিভিন্ন আঞ্চলিক দল যা অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিকেন্দ্রিক দল হিসেবে চলে এই ব্যক্তিপূজার নিদর্শন রেখেছে। যেমন এম.জি. রামচন্দ্রণ ও জয়ললিতার সময়ের এআইএডিএমকে, মুলায়ম সিং যাদবের সমাজবাদী পার্টি, নবীন পট্টনায়েকের বিজু জনতা দল, লালুপ্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দল, মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল, অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি, জগন মোহন রেড্ডির ওয়াইএসআর কংগ্রেস, কে. চন্দ্রশেখর রাও নেতৃত্বাধীন টিআরএস এবং বাল ঠাকরের সময়কালে শিব সেনার নাম করা যেতে পারে।
আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ, শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার ব্যক্তিকেন্দ্রিক কাল্টকে পুঁজি করে রাজনীতি করে। ব্রেক্সিট ভোটের পরে কনসারভেটিভ পার্টির অভ্যন্তরীণ কলহের তুলনায় ব্যক্তি ডেভিড ক্যামেরনের বড় ভুল ও ব্যর্থতা নিয়ে রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকাররা সমালোচনা করেছিলেন। উল্টোদিকে ইংল্যান্ডে লেবার পার্টির তুলনায় আজ জেরেমি করবিনকে নিয়ে অনেক বেশি মাতামাতি হয় আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকান পার্টির তুলনায় লোকে ট্রাম্প কি বলছে তাই নিয়ে বেশি চিন্তিত। জার্মানিতে মার্কেল, রাশিয়াতে পুতিন এবং তুরস্কে এর্দোগান একই ধারা বজায় রাখছেন যেখানে শক্তিধর নেতা-নেত্রী তাঁদের দলের থেকে বড় হয়ে উঠেছে। শক্তিশালী নেতা-নেত্রীর কথাই একমাত্র দলের বিধান এই প্রবণতা আমরা বলিভিয়ার ইভো মোরালেস এবং ইকুওয়াডোরে কররিয়ার ক্ষেত্রে দেখতে পাই। সাম্প্রতিককালে চিনের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাসে রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং যে মাত্রার ব্যক্তিকেন্দ্রিক কাল্টে পরিণত হয়েছেন তা মাওয়ের সময়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অর্থাৎ ডান-বাম এমনকি ক্যাডার ভিত্তিক কমিউনিস্ট পার্টি ও অন্যান্য বামপন্থী পার্টি বা আমাদের দেশের ক্যাডারভিত্তিক দক্ষিণপন্থী বিজেপি সবাই প্রায় ব্যক্তিকেন্দ্রিকতায় মজেছে।
আরও পড়ুন, তৃণমূলে পিকের ‘কর্পোরেট’ দাওয়াই, ভাল-মন্দের দায় নিতে নারাজ নেতারা
এই ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক প্রচার ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক কাল্টের উন্মাদনার প্রেক্ষাপটে বাংলায় ‘দিদিকে বলো’ প্রচারাভিযানকে বুঝতে হবে। এই প্রচারের একটা দিক যেমন বাংলার সাধারণ মানুষ তার সমস্যা নিয়ে সোজা মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারে পৌঁছতে পারে তেমন আরেকটা দিক হল বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর ভাবমূর্তির পুনর্গঠন। তিনি কেবল দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রশাসক নন যিনি বিভিন্ন সরকারি ও প্রশাসনিক বৈঠকে আমলা, পুলিশ, মন্ত্রী, এলাকার বিধায়ক ও সাংসদের কাছে কাজের হিসেব চান, বকুনি দেন যদি এলাকার উন্নয়ন না হয়ে থাকে (এহেন ছবি দূরদর্শনের পর্দায় বার বার দেখা গেছে) বরং তিনি এমন একজন যিনি ঠিক পরিবারের বড় দিদির মতো যাঁকে কোনো সমস্যার কথা সরাসরি বলা যায়। একইসঙ্গে জনসংসযোগ ও জনভাবমূর্তি গড়ার কৌশল হল এই ‘দিদিকে বলো’ প্রচারাভিযান। রাজনৈতিক পণ্ডিতেরা মনে করেন যে টেলিভিশন মিডিয়া ও সামাজিক মাধ্যমের প্রবল প্রভাব সরাসরি নির্বাচনী গণতন্ত্রের উপর পড়ছে এবং দলের প্রচারের থেকে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী একেবারে ভোটারের ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেছে। ভোটারের সঙ্গে নেতা-নেত্রীর আর বিশেষ দূরত্ব নেই। নেতা-নেত্রী সরাসরি টেলিভিশন এবং সমাজ মাধ্যমকে ব্যবহার করে ভোটারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে পারে। নেতা-নেত্রীর বিশেষ কাজ, নীতি এবং নীতি পরিবর্তন সম্পর্কে ভোটার প্রতিনিয়ত জানতে পারে ওই টেলিভিশন ও সামাজিক মাধ্যমের সাহায্যে।
২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল একটি নজরকাড়া স্লোগান দিয়েছিল: ‘জনগণের ক্ষমতা তাই বাংলায় চাই মমতা’। মুখ্যমন্ত্রী ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে বলেছিলেন যে ২৯৪টি আসনে তিনি আসলে প্রার্থী। তাই ভোটাররা যেন তাঁকে দেখে ভোট দেন। অনেকটা ২০১৪ ও ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে মোদী কেন্দ্রিক প্রায় একটা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনী প্রচারের ছকে। যারা নির্বাচনী সমীক্ষা করেন তাদের তো অনেক ভোটার পরিষ্কার বলে যে ‘বিজেপি-তৃণমূল বুঝি না আমরা মোদী-মমতা জানি’। ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি একবিংশ শতাব্দীর নির্বাচনী রাজনীতির একটা অঙ্গ হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে সাধারণ ভোটার থেকে পুঁজির ব্যাপারি সবাই আর দলীয় কোন্দল, দলের মধ্যে বিভিন্ন উপদল ও গোষ্ঠীর কাছে সুরাহা না খুঁজে কেবলমাত্র একজন নেতা বা নেত্রীর কাছে তাদের আশা-আকাঙ্খা বা সমস্যা সমাধানের কথা বলতে পারেন। অনেকটা প্রশাসনিক স্তরে সিঙ্গল উইন্ডো সিস্টেমের মতো। ভারতে গত এক দশকে বামপন্থীদের নির্বাচনী বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানে তাদের রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত বিচ্যুতি নিয়ে যে যথার্থ সমালোচনা হয় তার তুলনায় তাদের মধ্যে ক্ষমতাবান ও নির্ণায়ক রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী না থাকা নিয়ে কিন্তু তেমন আলোচনা হয় না। নেতা-নেত্রীর সঙ্গে ভোটার যদি নিজেকে একীকরণ করতে না পারে, নেতৃত্বের মধ্যে কোনো ইতিবাচক সমীকরণ ও সাযুজ্য না খুঁজে পায় এবং সর্বোপরি, ভোটার যদি না মনে করে যে অমুক নেতা বা নেত্রী আসলে ‘আমার লোক’ তাহলে সেই নেতা-নেত্রী নির্বাচনী রাজনীতিতে আজ সফল হতে পারে না যতই তার দলের নীতি ও নির্বাচনী ইস্তেহার ভাল হোক না কেন।
২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস দলের নির্বাচনী ইস্তেহার আর কংগ্রেসের নির্বাচনী ফল এই কথা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে নেতা-নেত্রী দেখেই লোকে ভোট দেন, দলীয় ইস্তেহার পড়ে নয়। এহেন রাজনৈতিক সংস্কৃতির ফল একদিকে যেমন কর্তৃত্ববাদ ও ফ্যাসিবাদ কে জন্ম দিতে পারে তেমন পপুলিস্ট ঘরানার বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থী জনপ্রিয়তাবাদের রাজনীতিকেও বৈধতা দিতে পারে। কিন্তু আপাতত প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় ও বাস্তবতা হল আজকের ভোটারের কাছে দল ও তার নীতি গৌণ, কে নেতা সেটাই মুখ্য বিবেচ্য বিষয়।
(লেখক সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস কলকাতায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক। মতামত ব্যক্তিগত)