Advertisment

দেবেশ রায়ের নিরাজনীতি (পর্ব ১৮)

  এ-কথা কি সি-পি-আই(এম) অঙ্কের হিশেবে বিশ্বাস করে যে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল-বিরোধী প্রচার বিজেপির পক্ষে যাবে না? তা হলে সিপিআই(এম) বলুন যে তাঁদের হিশেব অনুযায়ী—তৃণমূল বিরোধী, বিজেপিবিরোধী, কংগ্রেসবিরোধী ভোট কোথায় যাবে?

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

অলংকরণ- অরিত্র দে

অক্টোবরের প্রথম দিকে সি-পি-আই(এম)-এর কেন্দ্রীয় কমিটি ও পোলিটব্যুরোর সভা ছিল। তার যে-বিবরণ পার্টির বাংলা মুখপাত্র ‘গণশক্তি’তে বেরিয়েছে ও অন্যান্য সর্বভারতীয় কাগজেও, তার ভিতর খুব কিছু পার্থক্য নেই। সাধারণত পার্টির মুখপত্রে অনেক বেশি খবর থাকে। বরং অন্যান্য কাগজে খবরটা এমন ভাবে ছিল যেন সি-পি-আই(এম) কিছু নতুন কথা বলেছে তাদের রাজনীতি নিয়ে। ওঁদের পার্টির মুখপত্রে তেমন কোনো দাবি নেই।

Advertisment

তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন—বিজেপিকে সাধারণ নির্বাচনে হারাতে হবে; সেই উদ্দেশ্যে সমস্ত গণতান্ত্রিক ও বামপন্থী পার্টির সঙ্গে মতৈক্য তৈরি করতে হবে; সরকার যে-সব জনবিরোধী নীতি নিচ্ছে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে; পেট্রল-ডিজেলের দাম বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে; কৃষিপণ্যের ন্যূনতম দাম বাড়িয়ে বাঁধতে হবে; পশ্চিমবঙ্গে পার্টির স্লোগান হবে ‘দেশ বাঁচাতে বিজেপি হঠাও, রাজ্য বাঁচাতে তৃণমূল হঠাও’।

একটু আশা করেছিলাম যে এতগুলি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন ও তারপরই লোকসভার নির্বাচন যখন প্রায় এসে পড়েছে, তখন সি-পি-আই(এম) আর-একটু প্রত্যক্ষ ও বাস্তব রাজনীতির ভিত্তিতে কথা বলবে। মহারাষ্ট্রে কৃষকজাঠা সংগঠনে, নয়াদিল্লিতে কৃষকজাঠা নিয়ে আসায় ভারত বন্ধ্‌ ডাকায়, দেশব্যাপী বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভকে সংগঠিত রাজনৈতিক আকার দেয়ায়—গত প্রায় ছ-মাস সি-পি-আই(এম) জনমূলে কাজ করছে ও একটা অন্য ধরণের ঐক্যের রাজনীতি তৈরিতে নিজেদের ব্যস্ত রাখছে কিন্তু এই প্রস্তাবগুলিই যদি শুধু আলোচিত হয়ে থাকে, তা হলে সন্দেহ ঠেকিয়ে রাখা যায় না যে—বিজেপিকে হারাতে হবে—এটাই তাঁদের প্রধান কাজ হিসেবে ধার্য করাকেই তাঁদের এই মুহূর্তের স্পষ্টতা বলে মানতে হয়, কারণ, পার্টি কংগ্রেস-বিজেপি সমদূরত্বের কথা বলছিলেন। সিপিআই(এম) তাঁদের এই প্রস্তাবকেও বিজেপিকে কেন হারাতেই হবে কারণগুলির মধ্যে একবারের জন্যও বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকারের ফ্যাসিবাদী ঝোঁকের কথা বলেন নি, বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের প্রধান মোহন ভাগবতের আপাত নতুন  তত্ত্ব ‘ইনক্লুসিভ হিন্দুইজম’ এর কথা তোলেন নি। কংগ্রেস-তৃণমূল কংগ্রেস-সমাজবাদী পার্টি-বিজু জনতা পার্টি-অন্ধ্রপ্রদেশের নায়ডু, যে বিজেপি-বিরোধী কর্মসূচী নিয়েছেন, তাকেও তাঁরা উৎসাহিত করেন নি। তেমন উৎসাহ দরকার।

এইখানেই তাঁদের অরাজনৈতিকতা।

আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের নিরাজনীতি (১৭)

খুব আন্তরিকভাবে রাজনীতির কথা ভাবলে সিপিআই(এম)-এর এই রাজনৈতিক প্রস্তাবের সঙ্গে মায়াবতীর রাজনীতির কি খুব পার্থক্য আছে? নিশ্চয়ই সিপিআই(এম)-এর রাজনীতি আর মায়াবতীর রাজনীতিকে এক করে দেখছি না। কিন্তু না-দেখলেও কার্যত এক হয়ে যাচ্ছে। সিপিআই(এম)-এর সাধারণ সম্পাদকও বলেছেন রাজ্যে–রাজ্যে পরিস্থিতি আলাদা, সুতরাং রাজ্যে–রাজ্যে আলাদা–আলাদা ধরনের বিজেপি বিরোধী জোট হবে। এটা যদি সত্যও হয় ও সর্বভারতীয় পরিসরে কথাটা তো সত্যও বটে, কিন্তু সেই সত্য-ভাষণের কি এটাই নির্ধারিত বাস্তব মুহূর্ত! বিজেপিও তো এ-কথাই বলছে আর এও বলছে যে—দেখো, ওরা বিজেপির বিরুদ্ধে কোনো জাতীয় ঐক্য তৈরি করতে পারছে না।

এ-কথা কি সি-পি-আই(এম) অঙ্কের হিশেবে বিশ্বাস করে যে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল-বিরোধী প্রচার বিজেপির পক্ষে যাবে না? তা হলে সিপিআই(এম) বলুন যে তাঁদের হিশেব অনুযায়ী—তৃণমূল বিরোধী, বিজেপিবিরোধী, কংগ্রেসবিরোধী ভোট কোথায় যাবে? এমন কোনো সম্ভাবনা কি দিগন্তে দেখা যাচ্ছে সেই ভোট বামপন্থীরা পাবেন? কিন্তু এমন সম্ভাবনা নিশ্চয়ই অত্যন্ত বাস্তব যে সেই বামপন্থী ভোট যদি বিজেপি-বিরোধী সর্বদলীয় জোটে যায় তা হলে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ থেকে একটিও লোকসভা আসন পাবে না। বিজেপির সঙ্গে লড়াইয়ে তৃণমূলের সঙ্গে বিরোধ সত্ত্বেও একটা নির্বাচনী ঐক্য তৈরি করলে বিজেপিকে লোকসভা ভোটে শূন্যতে নামিয়ে আনা সম্ভব। বাস্তবেই সম্ভব। তৃণমূলকে হারাও--এই শ্লোগান তো বিজেপির শ্লোগান। সেই শ্লোগান যদি সি-পি-আই(এম) দেয় তা হলেই কি এই শ্লোগানের সব দোষ কেটে যাবে, গঙ্গাজলে ধোয়া হয়ে যাবে? ‘রাজ্য বাঁচাতে তৃণমূল হঠাও’ এই শ্লোগান পশ্চিম বাংলার বিধানসভা ভোট পর্যন্ত স্থগিত রাখা যায় না? যদি তা না-রাখা যায়, তাহলে সেটা কমিউনিস্ট রাজনীতি তো নয়ই, পার্লামেন্টারি রাজনীতিও নয়, এমন কি পশ্চিমি দুনিয়ার ভোট সর্বস্ব সোস্যাল ডেমোক্রাট রাজনীতিও নয়।

শুধু একটা ছোট ঐতিহাসিক ঘটনা মনে করিয়ে দি। অনেকেই জানেন। কিন্তু সব সময়ে তো মনে থাকে না।

১৯৩৩, ২৭ ফেরুয়ারি, সোমবার।

ঐতিহাসিকরা বলেন, জার্মানির উইমার রিপাবলিকের শেষ রাত্রি। জার্মান গণতন্ত্রের শেষ রাত্রি।

অ্যাডলফ হিটলার মাত্র চার সপ্তাহ হল ভোটে জিতে জার্মানির পার্লামেন্টের চ্যান্সেলর হয়েছেন।

যদি সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি ও কমিউনিস্ট পার্টি জোট বাঁধত তা হলে হিটলার নিশ্চিত হেরে যেত।

ঐ দিন রাত নটা নাগাদ পার্লামেন্ট হাউসে (রাইখস্টাগ) আগুন লাগল। আগুন যখন জ্বলছে তখনই নাৎসি পার্টির সরকারি নেতারা তাদের যথাযথ পোশাকে ও গাড়িতে ঘটনাস্থলে এলেন—প্রথমে গোয়েরিং, তারপর হিটলারকে নিয়ে তাঁর প্রচারমন্ত্রী গোয়েবলস। প্যাপেন। হিটলার যেন জানতেন—কারা আগুন লাগিয়েছে। আগুন জ্বলছে। আগুনের শিখা হিটলারের মুখে। হিটলার ঘোষণা করলেন—‘কোনো ক্ষমা নেই। প্রত্যেকটি কমিউনিস্ট অফিসারদের গুলি করে মারা হবে। যেখানেই তাকে পাওয়া যাক। কমিউনিস্ট ডেপুটিদের আজ রাতেই ফাঁসিতে লটকানো হবে’।

তাই শুরু হল।

তাই বলছি—মমতা জানুয়ারিতে ব্রিগেডে মোদি হঠাও, শ্লোগানে সর্ব ভারতীয় নেতাদের যে সমবেশ আহ্বান করেন, সেই সমাবেশে সি-পি-আই(এম) যাবেন।

দেশের সামনে সেই ঐক্য দেখানো দরকার।

ফ্যাসিবাদ-বিরোধী জমায়েত যত বেশি হয়, ততই ভাল।

editorial Nirajniti Debes Ray
Advertisment