ছবি: কিশোর কুমার জুনিয়র
অভিনয়: প্রসেনজিৎ, অপরাজিতা আঢ্য, লামা, রাজেশ শর্মা
পরিচালনা: কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়
রেটিং: ৩/৫
Kishore Kumar Junior Movie Review: তিনদিক খোলা মঞ্চ, হাজার হাজার দর্শকের সেই তারস্বর...মাইক হাতে যেই গেয়ে উঠলেন, 'আহা...উউউ..হে হে হে...উমমম', অমনি হাজার হাজার হাততালিতে ফেটে পড়ল চারপাশ। চোখ বন্ধ করে শুনলে মনে হবে, স্বয়ং কিশোর কুমার গাইছেন। চোখ মেলে তাকালেই সেই ভ্রান্তি নিমেষে দূর হবে। তিনি কিশোরকন্ঠী। এক চেনা শিল্পীর সত্ত্বাকে ভর করে আরেকজনের শিল্পী হয়ে ওঠা। এ যে মোটেও চাট্টিখানি কথা নয়, তার আভাস দিয়েছেন পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, সৌজন্যে 'কিশোর কুমার জুনিয়র'।
রোজ রাতে বিচিত্রানুষ্ঠান মাত করে মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফেরেন কিশোর কুমার জুনিয়র। বাবার এহেন শিল্পীসত্ত্বা নিয়ে 'লজ্জা' পায় ছেলে। "মাচা করে না, কোনও রাজকার্য করো নি তুমি!, এরকম গুচ্ছের লোক গান গাইছে," কিংবা "আমার বাবা কোথায়? যে একটা জলজ্যান্ত কিশোরকুমার ভূত!" অন্য কেউ নয়, নিজের ছেলের মুখে এ কথা শুনে সেই কিশোরকন্ঠীর ভিতরের জ্বালা তাঁকে কুরে কুরে খায়। হাজার হাজার মানুষ তাঁর কিশোর কণ্ঠের ভক্ত। অথচ নিজের ছেলের কাছেই তাঁর শিল্পীসত্ত্বার কোনও স্বীকৃতি নেই। এ যে কী যন্ত্রণা, তা একমাত্র সেই শিল্পীই বোঝেন। স্বামী গায়ক, মাঝরাতে মাতাল হয়ে ঘরে ফিরছেন রোজ। পাঁচটা লোকে পাঁচকথা বলছে। ঘরে ছেলে রয়েছে। একার সংসার সামলে রেখেছেন শিল্পীর স্ত্রী। তাই তিনি বলেন, "শিল্পী হতে গেলে ট্যালেন্ট লাগে, আর শিল্পীর বউ হতে গেলে সাহস লাগে।"
এক কিশোরকণ্ঠীর শিল্পীসত্ত্বা, তাঁর ব্যক্তিজীবনের দ্বন্দ্ব, ঘাত-প্রতিঘাত নিয়েই একটা দারুণ ছবি হতে পারত হয়তো। কিন্তু বাধসাধল জয়সলমীর ট্রিপ। যা ছবির প্রাণকে যেন গলা টিপে খুন করল। ইন্দো-পাক সীমান্তে অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেয়ে স্ত্রী ও গানের সঙ্গীদের নিয়ে কলকাতা থেকে জয়সলমীর পাড়ি দেন কিশোর কুমার জুনিয়র। তারপর 'আতঙ্কবাদীদের' খপ্পরে পড়েন তাঁরা। সেখান থেকে কীভাবে তাঁরা রেহাই পাবেন? এ নিয়েই এগিয়েছে 'কিশোর কুমার জুনিয়র'-এর চিত্রনাট্য।
আরও পড়ুন, Byomkesh Gowtro Movie Review: অরিন্দম শীলের এই ছবির প্রথমার্ধ শ্লথ, তবে বাঁধন শক্ত
ছবির খামতি কোথায়? শুরুটা ভাল হলেও, যত এগিয়েছে, ততই চিত্রনাট্যের ঢিলেঢালা চেহারা সামনে এসেছে। 'আতঙ্কবাদীদের' খপ্পর থেকে রেহাই পাওয়ার কৌশল বুদ্ধিমান দর্শক খুব সহজেই ধরে ফেলবেন। ফলে যে টুইস্ট দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন পরিচালক, তা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। ছবির চিত্রনাট্য অনেক টানটান হতে পারত। দর্শক যখন সাসপেন্সের আশায় নড়েচড়ে বসলেন, তখনই হঠাৎ করে নাটকীয়ভাবে শেষ হল ছবি। যা ছবির ভিতকে এক নিমেষে টলিয়ে দেয়।
চিত্রনাট্য ডুবিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সবকিছু মেক-আপ করার তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছেন। তিনি মানে ছবির নায়ক। মরুশহরে বালির উপর কিশোর কুমার জুনিয়র গান ধরেছেন, 'শিং নেই তবু নাম তাঁর সিংহ'। কিশোর কুমারের সেই কালজয়ী গানের সঙ্গে সাদা বুট পরে বালির উপর সেই চেনা ভঙ্গিতে নাচছেন নায়ক। যা দেখে দর্শকদের মধ্যে থেকে ভেসে এল, "আরে, গুরু ফুল ফর্মে তো!" আরেকজন বললেন, "বহুদিন পর"। প্রায় এক যুগ পর প্রসেনজিতের সেই নায়কী মেজাজ দেখে খুশিতে ডগমগ হয়ে বাজল সিটি। হাততালির শব্দে গমগম করল চারদিক। আর এখানেই অনেকটাই জিতে গেল টিম 'কিশোর কুমার জুনিয়র'। ছবির প্রথম থেকে শেষ, তিনিই একাই একশো।
আরও পড়ুন, ‘কৌশিক এই ছবিটার জন্য আমায় ভাবল কী করে জানি না’
প্রসেনজিৎকে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছেন অপরাজিতা আঢ্য। তাঁর বাংলা-হিন্দি মিলিয়ে সংলাপে দর্শক হাসবেন। পাশাপাশি, খোকনের চরিত্রে লামা কিংবা ফিরোজের বেশে রাজেশ শর্মা বেশ ভাল। কিশোর কুমার জুনিয়রের ছেলের চরিত্রে ঋতব্রতকেও বেশ মানিয়েছে। বহুদিন বাদে আবারও বাংলা ছবির প্লে ব্যাকে কুমার শানু। শুধু তাই নয়, আবারও প্রসেনজিৎ-কুমার শানু জুটি, এক কথায় আবারও হিট। বেশ কিছু গানের সঙ্গে একাধিক দৃশ্যকে যেভাবে একসঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে, তা বেশ লেগেছে। ছবিতে মহম্মদ রফি ও কিশোর কুমারকে নিয়ে লড়াই মন্দ লাগেনি। তবে ছবির চিত্রনাট্যের নিরিখে অপ্রয়োজনীয়।
শেষ পাতে বলি, এ ছবি কেন দেখবেন? প্রথমত, প্রথমবার কণ্ঠশিল্পীদের নিয়ে ছবি বানানো হল, যা অবশ্যই সাধুবাদ প্রাপ্য। দ্বিতীয়ত, কিশোর কুমারের এতগুলো গান একসঙ্গে, যেন পুজোর বাজারে পর্দায় সত্যি সত্যি বিচিত্রানুষ্ঠান দেখবেন দর্শকরা। তৃতীয়ত এবং শেষ পর্যন্ত, প্রসেনজিতের সেই চেনা ক্যারিশ্মা আর টান টান অভিনয়, যাতে আপনি মজবেনই। এই তিনটে জিনিসই এ ছবির সম্পদ। ও হ্যাঁ, যাঁরা কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের পরিচালনার ফ্যান, তাঁরা বেশ হতাশ হবেন।