সম্প্রতি ভারত তাদের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (FDI) নীতি পরিবর্তন করেছে। তাদের লক্ষ্য কোভিড ১০ লকডাউনের প্রভাবে যেসব সংস্থা বিপন্ন, সেগুলি যেন এই সুযোগে কেউ অধিগ্রহণ না করতে পারে। এই পদক্ষেপ চিনকে তাতিয়ে দিয়েছে, তারা একে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যনীতির পরিপন্থী বলে উল্লেখ করেছে। এই পদক্ষেপ কী এবং এর সম্ভাব্য ফলাফলই বা কী হতে পারে দেখে নেওয়া যাক।
সংশোধনীতে কী রয়েছে?
শনিবার সরকার জানিয়েছে যেসব প্রতিবেশী দেশ ভারতীয় সংস্থায় বিনিয়োগ করতে চায় তাদের আগে অনুমতি নিতে হবে। যেসব দেশের সঙ্গে ভারতের সড়ক সীমান্ত রয়েছে তারা কেবলমাত্র সরকারি পথেই এবার থেকে কোনও সংস্থায় বিনিয়োগ করতে পারবে।
কোভিড ১৯ সংকটের মধ্যে আমেরিকায় অভিবাসন মুলতুবি রাখার সিদ্ধান্তের কারণ কী?
এই প্রক্রিয়া লাগু হবে এমন ব্যক্তিদের জন্যও, যাঁদের সংস্থা তেমন দেশে নয়, কিন্তু তাঁরা ওই দেশের নাগরিক বা বাসিন্দা।
এই নোটে কোনও দেশের নামোল্লেখ না করা হলেও বিশ্লেষকরা বলছেন সম্ভাব্য চিনা লগ্নি আটকাতেই এই পদক্ষেপ। পিপলস ব্যাঙ্ক অফ চায়না কয়েকদিন আগেই এইচডিএফসি ব্যাঙ্কে তাদের শেয়ার এক শতাংশ বাড়িয়েছে। এইচডিএফসি ভাইস চেয়ারম্যান তথা সিইও কেকি মিস্ত্রি বলেছেন পিপলস ব্যাঙ্ক অফ চায়না আগে থেকেই শেয়ারহোল্ডার ছিল, ২০১৯ সালের মার্চে তাদের শেয়ারের পরিমাণ ছিল ০.৮ শতাংশ।
২০১৪ সাল থেকে চিনের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ ২০১৯-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচগুণ বেড়েছে, এখন এর অর্থমূল্য ৮ বিলিয়ন ডলার- ভারতের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে এমন যে কোনও দেশের থেকে অনেকগুণ বেশি- একথা জানিয়েছে চিনা সরকারই। ব্রুকিংস ইন্ডিয়ার এক গবেষণায় বলা হয়েছে ভারতে বর্তমান ও পরিকল্পিত চিনা বিনিয়োগের পরিমাণ ২৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
চিনের প্রতিক্রিয়া কী?
চিন ভারতের এই বৈষম্যমূলক ব্যবহার পরিবর্তন করার ডাক দিয়ে সমস্ত দেশের লগ্নি সমচক্ষে দেখতে বলেছে। ভারতে চিনা দূতাবাসের মুখপাত্র জি রং বলেছেন, “ভারতের তরফ থেকে নির্দিষ্ট দেশের লগ্নি সম্পর্কে যে নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করা হয়েছে তা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অবৈষম্যের নীতি বিরোধী এবং বাণিজ্য ও লগ্নির যে মুক্ত নীতি তার পরিপন্থী। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, জি ২০ নেতা ও বাণিজ্যমন্ত্রীদের মুক্ত, বৈষম্যহীন, স্বচ্ছ, স্থিতিশীল বাণিজ্য ও লগ্নির ব্যাপারে যে সহমত তার সঙ্গেও এ নীতি খাপ খায় না।”
করোনার জন্য কি ভারতীয় অর্থনীতি মার খাচ্ছে?
ভারতের যুক্তি কী?
ভারতের তরফ থেকে বলা হয়েছে এ নীতি কোনও একটি দেশকে উদ্দেশ্য করে নয়, বেশ কিছু ভারতীয় সংস্থা যখন বিপাকে পড়েছে, তখন তার সুযোগসন্ধানী অধিগ্রহণ আটকাতেই এই পদক্ষেপ।
সরকারের এক বরিষ্ঠ আধিকারিক বলেছেন, “এই সংশোধনী লগ্নিবিরোধী নয়। আমরা শুধু লগ্নির অনুমোদনের পথটা বদলেছি। ভারতে অনেক ক্ষেত্রেই এই পথেই এখনও লগ্নি করতে হয়।” তিনি একই সঙ্গে বলেন, আরও অনেক দেশ এই নীতি গ্রহণ করেছে।
অন্য দেশ কী পদক্ষেপ করেছে?
ভারতের আগে ইউরোপিয় ইউনিয়ন এবং অস্ট্রেলিয়া একই পদক্ষেপ করেছে। এগুলিও চিনা গল্নি আটকাবার পন্থা হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
২৫ মার্চ ইউরোপিয় কমিশন “কঠোর ইউরোপিয় ইউনিয়ন ভিত্তিক” দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে গাইডলাইন জারি করে, যার মাধ্যমে এরকম সময়ে বিদেশি লগ্নি পরীক্ষা করে দেখা হবে। লক্ষ্য হল ইউরোপিয় ইউনিয়নের সংস্থাগুলি এবং স্বাস্থ্য, চিকিৎসা গবেষণা, বায়োটেকনোলজি এবং নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো রক্ষা করা। তবে বিদেশি লগ্নি নিয়ে ইউরোপিয় ইউনিয়নের যে খোলামেলা দৃষ্টিভঙ্গি তা ক্ষুণ্ণ না করেই এই পদক্ষেপ করা হবে।
৩০ মার্চ অস্ট্রেলিয়া অস্থায়ীভাবে তাদের সম্পত্তি কম দামে বিক্রি হয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কায় বিদেশি অধিগ্রহণের ব্যাপারে কড়াকড়ি করেছে। উড়ান, পণ্য ও স্বাস্থ্যক্ষেত্র বিশেষ করে চিনের সরকারি সংস্থা কিনে নিতে পারে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে। সমস্ত বিদেশি অধিগ্রহণ এবং লগ্নির প্রস্তাব এখন থেকে অস্ট্রেলিয়ার বিদেশি লগ্নি পর্যালোচনা বোর্ড খতিয়ে দেখবে। স্পেন, ইতালি ও আমেরিকাও একই পথে হেঁটেছে।
তেল কিনলে ডলার মিলছে, এমন ঐতিহাসিক পরিস্থিতি হল কী করে?
ভারতের এই পদক্ষেপকে বৈষম্যমূলক বলা যেতে পারে কি?
কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন এই সংশোধনী কেবলমাত্র সীমান্ত দেশের জন্য। নাম গোপন রাখার শর্তে এক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ বলেছেন, “এবার থেকে কোন দেশের সংস্থা বিনিয়োগ করছে, তার উপর দাঁড়িয়ে পদ্ধতি প্রকরণ পৃথক হবে। এখান থেকেই বৈষম্যের কথাটা উঠছে। ভারত দেশিয় লগ্নির উদ্দেশ্যে এ বৈষম্য করতেই পারে, কিন্তু নিরাপত্তার অভাব হেতু কিছু দেশের জন্য কড়াকড়ি আন্তর্জাতিক মহলে ভাল চোখে নাও দেখা হতে পারে।”
পরিষেবা ক্ষেত্রও যদি এই বিধিনিষেধের আওতায় পড়ে তাহলে তা আরেকভাবে বৈষম্যের অন্তর্ভুক্ত হবে বলে মনে করছেন ওই বিশেষজ্ঞ। “অন্য সব দেশই যখন তাদের লগ্নি নীতিতে একইভাবে কড়াকড়ি করছে, তার অর্থ সকল দেশেই তা লাগু হবে।”
এর আগে কি ভারত এরকম পদক্ষেপ করেছে?
নির্দিষ্ট কিছু দেশের ক্ষেত্রে এরকম আগে হয়নি। এতদিন পর্যন্ত কিছু ক্ষেত্রে লগ্নির বিষয়ে কড়াকড়ি ছিল।
যেমন ২০১১ সাল পর্যন্ত ফার্মাসিউটিক্যালে সরাসরি বিদেশি লগ্নি করা যেত, সে বছরের নভেম্বরে ওই ক্ষেত্রে অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। সরকারকে ওই সময়ে সতর্ক করা হয় যে কিছু বিদেশি সংস্থা লগ্নি বাড়িয়ে ভারতী ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থা অধিগ্রহণ করে নিতে চাইছে তখনই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল জাতীয় স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে। ২০১৪ সালে নতুন সরকার আসার পর ওই নীতি মুক্ত করে দেওয়া হয় তবে এখনও ওই ক্ষেত্রে ৭৪ শতাংশের বেশি লগ্নি স্বাভাবিক পথে করা যায় না।
২০১০ সালে সরকার সিগারেট তৈরিতে সরাসরি বিদেশি লগ্নি বন্ধ করে দেয়। তার ঠিক আগেই জাপান টোবাকো ঘোষণা করেছিল তারা ভারতে তাদের লগ্নির পরিমাণ ৫০ থেকে বাড়িয়ে ৭৪ শতাংশ করবে।
এর আগে চিনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতির সময়ে কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি বিদেশি লগ্নি বন্ধ করে দিয়েছিল ভারত।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন