দ্বিতীয় নরেন্দ্র মোদী মন্ত্রিসভা নিয়ে জল্পনার অন্ত নেই। তার আগে একবার দেখে নেওয়া যাক, কীভাবে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়ে থাকে।
ভারতের মত দেশে মন্ত্রিসভা গঠনের প্রক্রিয়াটি অতীব জটিল। প্রধানমন্ত্রীকে নিশ্চিত করতে হবে যে তিনি যে টিম তৈরি করছেন তাতে একই সঙ্গে যেমন প্রতিভা ও অভিজ্ঞতার সমন্বয় থাকবে, তেমনই থাকবে সব রাজ্য ও সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব। বহুদলীয় সরকার হলে এ কাজ আরও কঠিন হয়ে পড়ে।
৫৪২টি আসনের মধ্যে ৩০৩ আসন পেয়ে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও মোদী এনডিএ-র অন্য প্রতিনিধিদেরও মন্ত্রিসভায় রাখতে চাইছেন।
অটল বিহারী বাজপেয়ী ও তাঁর মিত্রশক্তি
কেন্দ্রে এনডিএ কোয়ালিশন সরকার সফল ভাবে চালানোর প্রথম কৃতিত্ব বর্তায় অটল বিহারী বাজপেয়ীর উপর। তাঁর আগের দুটি এ ধরনের প্রচেষ্টা বিফল হয়েছিল। ১৯৯৯ সালে বেশ কিছু সহযোগীদের নিয়ে নি্রবাচন জয়ের পর বিজেপি কোয়ালিশন সরকার চালানোর আত্মবিশ্বাস অর্জন করে।
১৯৯৯ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত বাজপেয়ী সরকার নিজস্ব স্বার্থসমন্বিত বিভিন্ন পার্টি এবং সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে চলতে শুরু করেন। এই সহযোগীদের মধ্যে ছিল জেডিইউ, তৃণমূল কংগ্রেস, অকালি দল এবং শিব সেনা।
সরকারে একেবারে কেন্দ্রে সেবার রাখা হয়েছিল বর্ষীয়ান বিজেপি নেতাদের। এল কে আদবানি পয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্র, যশোবন্ত সিং পেয়েছিলেন অর্থ, মুরলী মনোহর জোশী মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক, শান্তা কুমার ক্রেতা সুরক্ষা মন্ত্রক, প্রমোদ মহাজন টেলিকম, সুষমা স্বরাজ স্বাস্থ্য, এম বেঙ্কাইয়া নাইডু গ্রামোন্নয়ন, রাজনাথ সিং কৃষি।
সমতা পার্টি (পরবর্তী কালে জেডি ইউ-য়ের সঙ্গে এই দল মিশে যায়) নেতা জর্জ ফার্নান্ডেজ সেকুলার ব্লকের প্রথম নেতা যিনি বিজেপির সঙ্গে জোটে যান। তাঁকে প্রতিরক্ষামন্ত্রকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এছাড়া সমাজবাদী মুখ হিসেবে পরিচিত নীতীশ কুমার এবং শরদ যাদবকে দেওয়া হয় যথাক্রমে রেল ও শ্রমমন্ত্রকের দায়িত্ব।
শিবসেনার মনোহর জোশীকে লোকসভার অধ্যক্ষ করা হয়েছিল। শিবসেনারই সুরেশ প্রভুকে দেওয়া হয়েছিল শক্তিমন্ত্রকের দায়িত্ব। লোক জনশক্তি পার্টির সুরেশ প্রভুকে দেওয়া হয়েছিলে যোগাযোগ মন্ত্রকের দায়িত্ব। বিজেডির নবীন পট্টনায়ক পেয়ছিলেন খনি মন্ত্রক। ডিএমকে-র মুরাসোলি মারান এবং টি আর বালুকে দেওয়া হয়েছিল যথাক্রমে বাণিজ্য় ও শিল্প মন্ত্রক এবং পরিবেশ ও বনমন্ত্রকের দায়িত্ব। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেওয়া হয়েছিল রেলমন্ত্রক। পরে অবশ্য তিনি সরকার ছেড়ে যান।
এলাকা ও সম্প্রদায়
উত্তর প্রদেশের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য খোদ বাজপেয়ী তো ছিলেনই, ছিলেন মুরলী মনোহর জোশী, সন্তোষ গাংওয়ার, মানেকা গান্ধী এবং আরও অনেকে। গুজরাট ছেতে ছিলেন আদবানি, রাজস্থান থেকে যশোবন্ত সিং,। বিহার থেকে ছিলেন জশওয়ান্ত সিনহা, নীতীশ, শত্রুঘ্ন সিনহা, শাহনওয়াজ হুসেন, রবিশংকর প্রসাদ, সঞ্জয় পাসওয়ান, রাজীব প্রতাপ রুডি। মধ্যপ্রদেশ থেকে ছিলেন সুরেন্দ্র লাল পাটওয়া, সত্যনারায়ণ জাটিয়া, উমা ভারতী, সুমিত্রা মহাজন এবং প্রহ্লাদ প্যাটেল। কারিয়া মুণ্ডা এবং বাবুলাল মারাণ্ডি এই দুই আদিবাসী মন্ত্রীই ছিলেন ঝাড়খণ্ডের মুখ।
শিবসেনার নেতারা ছাড়া মহারাষ্ট্র থেকে বড় নাম এসেছিল রাম নায়েক, প্রমোদ মহাজন, বালাসাহেব ভিখে পাটিল, আন্নাসাহেব পাটিল এবং বেদ প্রকাশ গয়াল ও জয়ন্তীবেন মেহতা।
অন্ধ্র প্রদেশ থেকে বেশি সাংসদ না হলেও কিন্তু সরকারে তাঁদের প্রতিনিধির সংখ্য়া কম ছিল না। ছিলেন এম বেঙ্কাইয়া নাইডু, বঙ্গারু লক্ষ্মণ, এবং বিদ্যাসাগর রাও। তামিল নাড়ু থেকে মন্ত্রী হয়েছিলেন কুমারমঙ্গলম, জনা কৃষ্ণমূর্তি, পন রাধাকৃষ্ণণ এবং তিরুনাভুক্করাসর।
জম্মু কাশ্মীর থেকে ছিলেন ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা ওমর আবদুল্লা এবং বিজেপি সাংসদ চমন লাল গুপ্তা। কেরালার নেতা ও রাজাগোপালকে রাজ্য সভায় নিয়ে এসে রাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয়।
বাজপেয়ী, জোশী, সুষমা, মহাজন, শান্তা কুমার, অনন্ত কুমাররা ছিলেন ব্রাহ্মণ এবং জশওয়ান্ত সিং, রাজনাথ সিং এবং রুডি ছিলেন রাজপুত। আদবানি ও রাম জেঠমালানি ছিলেন সিন্ধি সম্প্রদায়ভুক্ত। দলিত প্রতিনিধি ছিলেন পাসওয়ান, জাটিয়া, কৈলাস মেঘওয়াল ও সঞ্জয় পাসওয়ান। উমা বারতী এবং প্রহ্লাদ প্যাটেল ছিলেন লোধ রাজপুত। সুন্দরলাল পাটওয়া এবং বেদপ্রকাশ গয়াল ছিলেন বৈশ্য। সাহিব সিং ভার্মা এসেছিলেন জাঠ সম্প্রদায় থেকে, দুই সিনহা এবং প্রসাদ কায়স্থ। নীতীশ, শরদ যাদব এবং নাগমণি ছিলেন ওবিসি সম্প্রদায়ভুক্ত।
পিসি টমাস একই সঙ্গে কেরালা ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।
ফার্নান্ডেজ বিহারের সঙ্গে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি ছিলেন। মমতা ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধি। নীতীশ কুর্মি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।
মনমোহনের মন্ত্রিসভা
কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক দলের নেতাদের সঙ্গে সাধারণ নির্বাচনের পর দেখা করেন। বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে না চাওয়ায় লোকসভার অধ্যক্ষ পদ দেওয়া হয় সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে। সপা এবং বসপা মন্ত্রিসভার বাইরে ছিল।
২০০৯ সালের ভোটে ইউপিএ ২৬২টি আসন পেয়েছিল, কংগ্রেস একা পেয়েছিল ২০৬টি।
সোনিয়া-মনমোহন পূর্বসূরি এনডিএ মডেল অনুসরণ করেই কোয়ালিশন সরকার চালান। গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এনসিপি-র শরদ পাওয়ার (কৃষি ও উপভোক্তা এবং খাদ্য), ডিএমকে-র টি আর বালু (সড়ক ও পরিবহণ), আরজেডি-র লালু প্রসাদ (রেল)।
এ আর আন্তুলে, সইফউদ্দিন সোজ, তসলিমউদ্দিন ছিলেন মুসলিম মুখ ও একে অ্যান্টনি এবং অস্কার ফার্নান্ডেজ ছিলেন খ্রিষ্টানদের প্রতিনিধি। সুশীল শিন্ডে, মীরা কুমার, মহাবীর প্রসাদরা ছিলেন দলিতদের প্রতিনিধি। উত্তর পূর্বাঞ্চল থেকে এসেছিলেন সন্তোষমোহন দেব, বিকে হান্ডিক এবং পিআর কিন্ডিয়ারা।
নরেন্দ্র মোদীর প্রথম মন্ত্রিসভা
২০১৪ সালে বিজেপি পুরো সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে। মোদীর এই মন্ত্রিসভায় আগের কোয়ালিশনের মত সহযোগী শক্তিদের তত জায়গা দেওয়া হয়নি। এলজেপির পাসওয়ান, শিবসেনার অনন্ত গীতি এবং অকালি দলের হরসিমত কৌর বাদল সরকারে জায়গা পেলেও তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।
শিবসেনার সঙ্গে বিজেপির সম্পর্ক বারবার চড়াই উতরাইয়ের মধ্যে দিয়ে গেছে। তবে রাজ্যে সরকার গঠনের কালে এবং ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে তারা বোঝাপড়া করে নেয়। জেডিইউয়ের সঙ্গেও বিজেপির সম্পর্কও এখন ভাল হয়েছে।
এবারের লোকসভায় বিজেপির পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। তাহলে কি সহযোগীদের জায়গা দেওয়ার আর দরকার রয়েছে? রাজ্য়সভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যে আঞ্চলিক দলগুলিকে পাশে পাওয়ার জন্য এর উত্তর ইতিবাচকই হওয়া উচিত।
Read the Full Story in English