সাতাশে ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই ফাঁকিস্তানের গল্প। আসলে সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম বলছিল 'ফেকিস্তান', তবে বাংলায় ‘ফাঁকি’-টাই শোনায় ভালো। ইংরিজির খারাপ কথা নয় মোটে, বরং পড়শি দেশের চাঁদিতে চন্দ্রবিন্দু লাগানোর উৎসাহে ’ক’ অক্ষর গোমাংস হতে যতটুকু সময় লাগে তার তুলনায় ‘প’ পেরিয়ে ‘ফ’-তে পৌঁছতে দেরি হয় নি। ফাঁকিস্তান তো সত্যি কথা বলে না, তাই তারা যখন বলল যে একগাদা পাইলট পাকড়েছে তখন বুঝতেই পারছিলাম যে মার খেয়ে ভুল বকছে ব্যাটারা। আমাদের দেশের বিমান কী, একটা চামচিকের শ্লীলতাহানি করার ক্ষমতা নেই পশ্চিমের পড়শির।
সন্ধেবেলা যখন শেষমেশ আমার দেশের সরকার বলল যে আমাদের একটা বিমান ভেঙেছে, আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না পাইলটকে, তখন আমি বাধ্য হয়ে দীর্ঘশ্বাস সহযোগে বিশ্বাস করলাম সে কথা। নিজের দেশ বললে ঠিক আছে, কিন্তু ফাঁকিস্তানকে বিশ্বাস নেই। চোখের পলকে এককে একশো করে দেয়। অন্যদিকে স্বদেশের সংবাদমাধ্যমের প্রতি আমার অগাধ বিশ্বাস। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে 'সত্য'-র লাশ পড়ে বারবার, তবে তা আমার দেশে নয়। তাই ঝাউবাংলোর পাইনগাছে বোমা পড়েছে বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের অপপ্রচার মানছি না।
আরও পড়ুন: ভারত-পাক উত্তেজনা প্রশমনে আন্তর্জাতিক কূটনীতি
ভাগ্যিস সেদিন সকাল থেকে ইমরানের বকবকানি বিশ্বাস করি নি। পাকিস্তানের ইমরান - এই মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী পদাধিকারী বিরুদ্ধ সমাস। কলকাতায় যখন খেলতে আসত তখন সঠিক শিক্ষা দিতে পারলে আজকে আর এত মিথ্যে বলতে পারত না। আমাদের রাজনৈতিক চেতনায় ভর করে সততার প্রতীক হয়ে দেশে ফিরত। সদ্য প্রধানমন্ত্রী হয়ে লম্বা চওড়া ভাষণ দিতে শিখেছে। বলে কিনা যুদ্ধ শুরু করা সহজ, কিন্তু শেষ করা শক্ত। শুনলাম উদাহরণ দিয়েছে প্রথম আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। ভিয়েতনামের লড়াই নিয়েও নাকি পর্যালোচনা করেছে। একবার যদি এ শহরে আসে তাহলে বসিয়ে দেব সাঁঝবেলার বাংলা টেলিভিশনে যুক্তি-তর্ক-গল্প করতে। দেখব তখন আন্তর্জাতিক ইতিহাস নিয়ে কত জ্ঞান। বেশি বাড়াবাড়ি করলে দেব আমাদের দাদার সামনে ফেলে, বুঝবে কিভাবে বাপিকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হয়।
পাঠান নেতা এখন কূটনৈতিক চাপে শুধু অফ স্টাম্পের বাইরে বল করছে। তাই শান্তির সাদা পায়রা উড়িয়ে ঘন্টাকয়েক ঘ্যাঁতানোর পর পয়লা মার্চ টেলিভিশনের প্রাইম টাইমে অভিনন্দন বর্তমানকে ফেরত দিল। জেনিভা কনভেনশনকে তোয়াক্কা না করা কি এতই সহজ? ফ্রান্সে বসবাসকারী পাকিস্তানি সাংবাদিক তোহা সিদ্দিকি যথার্থ প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁদের প্রধানমন্ত্রী কি মাসুদ আজহার, হাফিজ সঈদ কিংবা দাউদ ইব্রাহিমকেও ভারতের হাতে ফেরত দেবেন? এতই যখন সদিচ্ছা! শান্তিতে নোবেল দেওয়ার জন্যে কেউ কেউ নাকি তাঁর নাম করছে। এরকম হলে আর্ধেকটা ভাগ আমাদেরও পাওনা হয়।
তবে ইমরান এবং তার মাথার ওপর বসে থাকা সামরিক বাহিনীকে ধন্যবাদ যে আমাদের একটা যুদ্ধ করার সুযোগ করে দিয়েছে। কার্গিলের পর প্রায় বিশ বছর আলুনি চলছিল। হবেই তো, এর মধ্যে দশ বছর কংগ্রেস ক্ষমতায় আর তার বেশিরভাগটাই বাম সমর্থনে। বাম ব্যাপারটাই এসেছে যুদ্ধ করে, আর তারাই আজকাল বলে "যুদ্ধ নয় শান্তি চাই"। এই সুযোগে কম্যুনিস্টদের একপ্রস্থ গালি দেওয়ার সুযোগ পাওয়া গেছে। এখন যা বাজার, তাতে 'শান্তি' উচ্চারণ করলেই সে ব্যাটা সিপিএম, কিংবা মার্ক্সের পরে লেনিনের 'এল', আরও অক্ষর বাড়ালে মাওবাদী। বুকে হাত দিয়ে বলুক তো, রাশিয়ার কি সৈন্য ছিল না? পুতিন তো ধমকেই সত্তর শতাংশের ওপর ভোট দখল করছে এক যুগের বেশি সময় ধরে। চিনের সেনারা তো সবসময়েই যুদ্ধের অপেক্ষায়। চিনের চেয়ারম্যান তোমাদের চেয়ারম্যান, এদিকে যুদ্ধের কথা বললেই হ্যারিকেন হাতে শান্তি মিছিল। ক্ষমতায় না থাকায় এখন বাংলার কমিদের মোমবাতি কেনারও পয়সা নেই। এদিকে তত্ত্বের কথায় এক ফোঁটা জল বাইরে পড়বে না।
গম্ভীর মুখে বলবে, "কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো বলে সর্বহারার একনায়কতন্ত্র স্থাপন করাই হল একমাত্র লক্ষ্য। অন্যদিকে জাতীয়তাবাদ হচ্ছে একধরনের আফিম। ধর্মও তাই। এগুলো গজানো হয়েছে যাতে শ্রমিকশ্রেণি এইসব জিনিসে মত্ত থেকে নিজেদের অধিকারের জন্যে লড়াই করতে ভুলে যায়। সুতরাং প্রতিক্রিয়াশীল জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করা কম্যুনিস্টদের কর্তব্য। যারা একটু মন দিয়ে রবি ঠাকুর আর দল থেকে দেওয়া বই পড়ে, তারা সবাই এটা জানে। অমর্ত্য সেনও বলেন জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা সবসময় দোষের নয়। গৌতম নওলাখার লেখা একটু বেশি বাম বই 'ওয়ার অ্যান্ড পলিটিক্স' পড়লেও তা বোঝা যায়। সেখানে অন্য আদলে আসে যুদ্ধের দর্শন আর যুদ্ধের রাজনীতি।
"তাই তো তত্ত্বগতভাবে কম্যুনিস্ট পার্টি বারবার বলেছে যে 'ইয়ে আজাদী ঝুঠা হ্যায়'। কেননা এই স্বাধীনতা নিতান্তই জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা। সেজন্যেই শ্রমিকশ্রেণি আজও মালিকের কাছে পরাধীন। দেশীয় জাতীয়তাবাদ ব্যাপারটাই একটা ধাপ্পা। দুনিয়ার শ্রমজীবীরা এক হলে তবেই আসবে প্রকৃত স্বাধীনতা। সাধারণ মানুষ এইসব বড় বড় তাত্ত্বিক কথা শুনে যদি মনে করে কম্যুনিস্টরা 'গদ্দার', সেই ভয়ে কি আমরা এই যুদ্ধের বাজারে ম্যানিফেস্টো বদল করব?" দেশের এই জটিল পরিস্থিতিতে এসব দেশদ্রোহী কথা বলার জন্যে তীব্র প্রতিবাদের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তার ফাঁকে সুযোগ পেয়ে বলে কিনা, "একটা যুদ্ধ বিমানের টাকায় কিছু গরীব মানুষ ঠিক করে খেতে পেত, তাদের একটু ভালো ভাবে বাঁচার রসদ মিলত। খুব কি ক্ষতি হতো তাতে? আমি স্বপ্ন দেখি যেন আগামী জন্মে সৎ কম্যুনিস্ট হতে পারি। এ জন্মে কেমন একটা মাঝামাঝি থেকে গেলাম। খুব বড় করে কিছু ভাবতে পারলাম না।"
ওরে বাবা, পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম হয়ে জন্মে শান্তি হয় নি, তার চেয়েও বড় 'আসল' কম্যুনিস্ট হতে চায়, 'ফাঁকি' নয়। বলে কিনা, "আমি আমার মতো ভাবি। নিজের পছন্দের দল করি। অন্ধ অনুকরণ করি না। কিছু ধারণার অনুসরণ করি। রাশিয়া বা চিনের সব বিষয় অনুকরণ করতে হবে এমন তো নয়। যুদ্ধে খরচ না করে পড়শি দেশগুলোতে গরিব মানুষকে খেতে দেওয়া যায়। মাথায় ছাদ দেওয়া যায়। ছেলেমেয়েদের পড়ার বই দেওয়া যায়। ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক অবস্থান সবসময় কিউবা কিংবা নিকারাগুয়ার সঙ্গে মিলবে এমন তো নয়। তবে উৎপাদনের সমবণ্টন করা গেলে অধিকাংশ মানুষ যে উপকৃত হবে এটা সর্বৈব সত্য।"
ইচ্ছা করছিল, মাটিতে চিৎ করে ফেলে বুকের ওপর বসে ধাঁই ধপাধপ তবলা বাজাই, কিন্তু গায়ের জোর কম। তাই বাম ব্যাটা বেঁচে গেল। তবে রাগ না চাপতে পেরে আমি চিৎকার করে উঠলাম, "উৎপাদনের সমবণ্টনের নামই হচ্ছে দারিদ্র্যের সমতাস্থাপন। এবং তৎপরবর্তী পর্যায়ে উৎপাদনের নির্বীর্জকরণ। তখন আমরা সবাই ভুখা আমাদেরই এই ভুখার রাজত্বে।" তার থেকে এই দ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতে যদি ফাঁকিস্তানটা দখল করতে পারি, তাহলে ফসল ফলানোর আর কিছুটা অতিরিক্ত জমি পাওয়া যাবে। যব আর গম চষে ন্যুনতম সহায়ক মূল্যে বিক্রি করে বৃহত্তর ভারতে আর একটা সবুজ বিপ্লব আনব আমরা। পুষ্টিকর ডালিয়ার খিচুড়ির সঙ্গে সিন্ধু নদের মুখরোচক ইলিশ ভাজা।
তাই যতদিন এখন যুদ্ধ চলে ততদিনই উত্তেজনা। ভারত-অস্ট্রেলিয়া দু-কুড়ি ক্রিকেট দেখা ভুলে দাঁত চেপে বসে আছি সোফার ওপর। সামনে গাঁক গাঁক করে যুদ্ধ ঘোষণা করছে সর্বভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল। মাঝে মাঝে ভাবছি নিজেই যুদ্ধে যাব। সকালবেলা ঘরণী বলেছিল চাল বাড়ন্ত। কিন্তু যুদ্ধের ধারাবিবরণী শুনতে শুনতে সারাদিনে একেবারে ভুলে মেরে দিয়েছিলাম সেকথা। মুখঝামটার পুনরাবৃত্তির পর সম্বিত ফিরতে আমি উত্তর দিলাম,
"আমার দিগন্তে যুদ্ধ যুদ্ধ সাজ।
তোমার সীমান্তে কাঁটাতার ছেঁড়া ছেঁড়া।
দেশনায়কেরা করে দেবে ঠিক আজ,
কার কার ঘরে হবে নাকো কাল ফেরা।"
বাড়িতে ফিরে আসার কোনো গ্যারান্টি নেই। রাস্তায় চাল কিনতে বেরিয়ে আমি একছুটে চলে যেতে পারি ওয়াঘা সীমান্তে। আমাকে খুঁজে না পেয়ে তখন তোমাকেই আবার মুদির দোকানে যেতে হবে। আমার খোঁজে নয়, চালের জন্যে। যুদ্ধে অবশ্য ঘরে শুধু নয়, দোকানেও চাল বাড়ন্ত হতে পারে। ভাবছিলাম জবাব আসবে যে সত্ত্বর চাল-ডাল-তেল-নুন সব কিছুই মজুত করতে হবে সংসারে। কিন্তু হঠাৎ দেখি যুদ্ধের আবহে চেনা গিন্নি বদলে গিয়ে আঠারোর অচেনা যুবতী। সম্ভবত সুযোগ বুঝে আমাকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে শহিদ বানাবে। বলে কিনা,
"মায়াজাল কাল দুজনেরই যাবে ছিঁড়ে,
শিরদাঁড়া যদি সোজা হয় অবশেষে।
আজ এসো দেখি দুজন দুপারে ফিরে,
গৃহযুদ্ধটা কেমন ঘনিয়ে আসে!"
না না, বেশি ঝামেলায় গিয়ে কাজ নেই। আমি বরং ঘরের বুড়ো ঘরেই থাকি। কোনোক্রমে বর্তমানে অভিনন্দিত হলেও ভবিষ্যৎ হারানোর যুদ্ধকে আমি ভয় পাই। কাপুরুষ আমি, যুদ্ধবিরোধী আমি, গাদা গাদা লোকের চোখে হেয় আমি, কাঁথা চাপা দিয়ে উত্তাল হিন্দুস্তানে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করি। শত চেষ্টাতেও ঘুম আসে না। সস্তার নেশা করি, ঘুমের ওষুধ খাই। তবু ঘুম পালিয়ে যায় - যুদ্ধের প্রেয়সী হয়ে। বীর সন্তান ওয়াঘা সীমান্তের লৌহকপাট পার হয়ে সুস্থ শরীরে ঘরে ফিরলেও মাঝরাতে জেগে বসে নিজে কিছু লিখতে পারি না। আঙুল কাঁপে, কারণ অশান্তি থামে নি। সীমান্তে গোলা ফাটার শব্দে আধকালা আমি এ লেখার ছত্রে ছত্রে শব্দ ভরাই গলিপথে কান পেতে; অন্তর্জাল ঢুঁড়ে 'মিত্র্যোঁ'-দের উদ্ধৃতি কিংবা পংক্তি ঝেঁপে।
যাঁরা কাজের মানুষ, তাঁরা কিন্তু থেমে থাকেন না। "পুলওয়ামার যুদ্ধ", কিংবা "অভিনন্দন বর্তমান" নামগুলোকে সিনেমায় কাজে লাগানোর জন্যে বলিউডে আগাম হুড়োহুড়ি পড়ে যায় - কোন প্রযোজক আগে দখল করবেন সেই গায়ে কাঁটা দেওয়া শব্দবন্ধ! বিজেপির নেতা লোকসভা আসনের হিসেব কষতে শুরু করেন কর্ণাটকে। ভিন্ন রাজনৈতিক দল তৎপরতার সঙ্গে সরকারের থেকে আলাদা করতে চায় সৈন্যবাহিনীকে - যাতে এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে তাদের বাঁধা ভোট চিলে ছোঁ মেরে না নিয়ে যায়। আসলে যুদ্ধ একটা কাজ, কৃষিকাজের মতই। সেই কাজের মানুষ, কাছের মানুষ 'জাতীয়তাবাদী'-দের যুদ্ধ ছাড়া আর কিছু হারানোর নেই। জয় করার জন্যে আছে গোটা একটা ফাঁকিস্তান।
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)