জামাকাপড় খুলে নেচেকুঁদে পর্দা কাঁপানো, এতদিন এই তো করেছ মামণি। হঠাৎ রাজনীতির মাঠে কেন? এসি গাড়ি ছাড়া এক পা-ও তো চলো নি। পারবে দরজায় দরজায় ঘুরে রোদে পুড়ে ভোট চাইতে? জানি জানি, কোন চ্যানেল ধরে ক্যানেল খুঁড়ে দিদির কাছে গেছ। আরে বাবা, বাবু-টাবু ধরে বেশ তো ছিলে! আবার জনসেবা করার ভূত চাপল কেন মাথায়? এও দেখতে হলো? শেষ পর্যন্ত এদেরও দেখতে হবে পার্লামেন্টে? এককালে কারা সব ছিলেন!
প্রশ্ন করুন কারা ছিলেন আলো করে, নাম বলতে গেলে দশবার হোঁচট খাবে। এর থেকেও বেশি সমস্যায় পড়বে, যদি প্রশ্ন করা যায়, কী কী আলোকিত কাজ করেছেন তাঁরা, যদি বলেন? বলতে পারবে না। এই হলো আমাদের রাজনীতি ও সমাজনীতির জ্ঞান।
আরও পড়ুন: সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রোল হওয়া নিয়ে কী বললেন নুসরত?
তাতে কী? জ্ঞান না থাকুক, চেতনার বিসর্জন হোক, আপডেট তো আছে। কী সেই আপডেট? না, দুজন সিনেমার নায়িকা ভোটে দাঁড়িয়েছেন। পাঠকের জন্য মনে হয় এইটুকু ভূমিকাই যথেষ্ট। কোন প্রেক্ষিতে কাদের নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় গত কয়েক ঘন্টা ধরে কাটাছেঁড়া চলছে সেটা আমরা সবাই জানি। সম্প্রতি তৃণমূল সুপ্রিমো লোকসভা নির্বাচন উপলক্ষে তাঁর দলের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেন। সেখানে বাকি নামগুলির সঙ্গেই ছিল মিমি চক্রবর্তী ও নুসরত জাহানের নাম।
সাংবাদিক সম্মেলন শেষ হওয়া পর্যন্তও তর সইল না। কোনও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ নয়, কোনও চিন্তাসূত্র খোঁজা নয়, বাকি সব নাম রইলো পিছনে পড়ে। দুটি মেয়েকে নিয়ে শুরু হয়ে গেল ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ, শ্লেষ, আক্রমণ। যেন এর আগে এমন কখনও ঘটেনি। যেন দেশে ও বিদেশে এই প্রথম কেউ বিনোদন দুনিয়া থেকে রাজনীতির আঙিনায় পা রাখলেন।
দেশের কথা যদি বলি, দক্ষিণী ছবি থেকে বলিউড, সর্বত্র অজস্র উদাহরণ আছে এর। জয়ললিতা, রজনীকান্ত, এমজিআর থেকে কমল হাসান, জয়া প্রদা, এদিকে সুনীল দত্ত, বিনোদ খান্না, অমিতাভ বচ্চন, হেমা মালিনী, টলিউড থেকেও সন্ধ্যা রায়, শতাব্দী, লকেট, মুনমুন সেন দাঁড়িয়েছেন ভোটে। বিদেশের কথাও যদি বলি, খোদ আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগন এক সময় হলিউড কাঁপিয়েছেন। শুধু সিনেমা কেন, খেলাধূলা, সংগীত, বাণিজ্য, শিক্ষা জগৎ থেকেও রাজনীতির খাতায় নাম লিখিয়েছেন বিশিষ্টরা।
আরও পড়ুন, মিমি-নুসরতকে নিয়ে সোশ্যালে ‘মিম বিলাস’, ঝুলছে কমিশনের খাঁড়া!
তাহলে সমস্যাটা কোথায়? আপত্তির কারণ কী? নাহ, এর উত্তর কোথাও নেই। ফেসবুক খুললেই চোখে পড়ছে একরাশ বিষোদ্গার। অনর্গল, অবিরত। সাধারণ ফেসবুক সদস্য থেকে রাজনৈতিক দলের কর্মী ও সমর্থক। শুধু অবোধ, অশিক্ষিত ও অবিবেচক উৎকট চিৎকার নয়। রীতিমতো সাজিয়ে গুছিয়ে পরিকল্পিত ভাবে টেনে নামানোর প্রক্রিয়া। অর্থাৎ, এটা ভাবার কোনও কারণ নেই, কিছু অজ্ঞ পুরোনোপন্থী মানুষ, দুটি অল্পবয়সী নায়িকার ভোটে দাঁড়ানো নিয়ে 'গেল গেল' রব তুলেছেন। যদিও সেটাও কোনও যুক্তির কথা নয়।
কিন্তু তার থেকেও ঘৃণ্য ও বিপজ্জনক প্রবণতা অন্যত্র। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির কর্মী ও সমর্থকরা যে ভাষায়, যে স্তরে নেমে এক একটি পোস্ট করছেন তা দেখে অবাক ও চমকিত দুইই হতে হয়। এদের মধ্যে অনেকেই শিক্ষিত, বিদগ্ধ, বিবেচক মানুষ হিসেবে স্বীকৃত। এক মিমি আর নুসরতের ভোটে দাঁড়ানোকে কেন্দ্র করে যেন অশিক্ষা, অভদ্রতা, অসভ্যতার সব আগল খুলে গেছে। সত্যি কথা বলতে, 'ট্রোল' শব্দটার এমন আক্ষরিক প্রয়োগ সাম্প্রতিক কালে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
আরও পড়ুন, ভোটের প্রচারের জন্য অনিশ্চিত মিমি-র নতুন ছবির শুটিং
শুরু হয়েছে, এবং থামার নাম নেই। চলছে তো চলছেই। গত কয়েক ঘন্টায় আর কোনও বিষয় এভাবে ফেসবুকে উঠে আসেনি। যেন এটাই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। কাশ্মীর সমস্যা সমাধান, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তোপ দাগা উচিত এক্ষুণি - ইত্যাদি বলে যারা বাজার গরম করছিল, তারাও সব ভুলে মিমি-নুসরত চর্চায় ব্যস্ত। চর্চা এবং কুৎসা। কুৎসার কুৎসিত ভাষা। সোশ্যাল মিডিয়া মানে মত প্রকাশের চূড়ান্ত স্বাধীনতা, এমন একটা ধারণা সবারই আছে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে কোথাও যেন তার অপপ্রয়োগ হচ্ছে। রুচিহীন ভাবনা, সেই মাপেই ভাষার ব্যবহার। একটি পোস্ট, তার সঙ্গে অসংখ্য মন্তব্য। প্রতিবাদের স্বল্পসংখ্যক মুখগুলিকে চেপে ধরার চেষ্টাও চলছে এরই সঙ্গে।
যদি দুটি তরুণীর নিছক গ্ল্যামার দুনিয়া থেকে আসাই এর কারণ হয়, তবে এই পুরো ঘটনার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ অত্যন্ত জরুরি। দরকার আয়নায় নিজেদের মুখগুলি দেখা। একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে ভিন্ন ক্ষেত্রের দুজন নামী মানুষের নির্বাচনে অংশগ্রহণে কোনও অস্বাভাবিকতা নেই, এটা আমাদের সকলের যুক্তিবাদী মনই জানে। কিন্তু মনের ভিতরে যে আরেকটা মন, যেখানে অনেকটা অন্ধকার, কুচিন্তার পোকারা সেখানেই ঘোরাফেরা করে।
নারী এবং তরুণী - তাঁদের টেনে নামানো, তাঁদের সম্পর্কে অশ্লীল মন্তব্য, পোশাক ও শরীরী আবেদনকে উপজীব্য করে আলোচনা, বিতর্ক চালিয়ে যাওয়ার মধ্যে এক ধরণের বিকৃত আনন্দ মেলে। এখানে সেটাই খুঁজছে সবাই। আর যাই হোক, এই পোস্টগুলির কোথাও সেভাবে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার কারণ ভাবনার গোড়াটাই অসুস্থ। বিরোধিতা করা, প্রতিবাদ করা, দোষের নয়। কিন্তু কেন করছি আর কীভাবে করছি, সেটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। দায়িত্বেরও বটে।