Advertisment

ত্রিপুরার পর্তুগিজদের পদবী ছাড়া হারাবার আর কিছু নেই

ত্রিপুরার রাজপরিবারের ইতিবৃত্ত ত্রিপুরা রাজমালায় প্রথম জমিপত্তনের বিস্তারিত বিবরণ থাকার কথা। কিন্তু রাজ পরিবারের ইতিবৃত্তের বহু সংস্করণ।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Tripura Portugese

আগরতলায় মরিয়মনগর গির্জা (ছবি- দেবরাজ দেব)

৪০ বছরের বিপ্লব লাগারডো কলেজ শিক্ষক। ১৫৪০ সালে যেসব পর্তুগিজ সেনারা ত্রিপুরায় বসতি শুরু করেন, তাঁদের অষ্টাদশ প্রজন্ম এই বিপ্লব। মার্চার, লাগারদো, ডিমেলো, ডি সিলভা, ডিসুজা এসব পদবী ত্রিপুরায় বেশ চলে। এসব পর্তুগিজ পদবীওয়ালা পরিবারগুলির পিছনে একটা গল্প আছে। তবে সে গল্প কিছুটা আবছা হয়ে এসেছে বটে। মাণিক্য পরিবারের রাজত্বকালে যেসব ইউরোপিয়রা এখানে বসবাস করতে শুরু করেন, তাঁদেরই বংশলতিকায় আজকের পর্তুগিজদের খুঁজে পাওয়া যাবে। মাণিক্য রাজের সময়কালে যে পাঁচটি পর্তুগিজ পরিবার ত্রিপুরায় বসবাস আরম্ভ করেন, তাঁরা আজ মাত্র কয়েকশ মানুষ।  ১৮ প্রজন্মের বেশি এবং ৫০০ বছরেরও অধিক সময়কাল জুড়ে তাঁরা এখানে রয়েছেন বটে, কিন্তু নাম ছাড়া পর্তুগিজত্বের আর কিছু তাঁদের নেই।

বিপ্লব কমার্স পড়ান। তাঁর অত্যন্ত আগ্রহ চার শতাব্দীর বেশি সময় জুড়ে থাকা পূর্বপ্রজন্মের ইতিহাসে। উত্তর পূর্ব ভারতে যে সব পর্তুগিজ কলোনি শুরু হয়েছিল, তাঁদের এক উত্তরসূরী তিনি।

উত্তর পূর্ব ভারতে পর্তুগিজরা কবে থেকে বসবাস শুরু করেন, সে নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। তবে সকলেই মোটামুটি একমত যে বদরপুর জেলার বন্দাশিল, গোয়ালপাড়া জেলার রাঙামাটি এবং আসামের বরাক উপত্যকা ও ত্রিপুরার মরিয়মনগরে মুঘল শাসনকালে এঁদের বসবাস শুরু হয়েছিল।

Tripura Portugese বিপ্লব লাগারডো নিজের উৎসসন্ধানী (ছবি- দেবরাজ দেব)

ভারতে পর্তুগিজদের ইতিহাস শুরু হয় ১৪৯৮ সালে কালিকটে ভাস্কো ডা গামার বাণিজ্যপোত নোঙর ফেলবার পর। যেসব জায়গায় পর্তুগিজরা বসবাস শুরু করেন, তার মধ্যে রয়েছে গোয়া, ওনোর, বার্সেলর, ম্যাঙ্গালোর, কান্নানোর, ক্রাঙ্গানোর, কোচিন, কুইলনের মত জায়গা। এসব জায়গাতেই সমুদ্রবন্দর রয়েছে এবং সবকটিই বাণিজ্য বন্দর। পূর্ব উপকূলে পর্তুগিজ ঘাঁটি গড়ে উঠতে থাকে হুগলি বন্দর জুড়ে।

উত্তরপূর্বে যাঁরা বসতিস্থাপন করেন তাঁদের মধ্যে ভাড়াটে সৈন্যদেরই ছিল সংখ্যাধিক্য। কেউ কেউ মনে করেন, আসামের পর্তুগিজ সেটলমেন্ট শুরু জন্য লোক এনেছিলেন জার্মান অভিযাত্রী উইলিয়ম রেইন হের। অনেকের মতে আবার উত্তরপূর্বের পর্তুগিজ বসতি শুরুর কারণ ভিন্ন। তৎকালীন পূর্ব বাংলার স্থানীয় রাজারা পর্তুগিজ ভাড়াটে সৈন্যদের লড়াইয়ের জন্য নিয়ে এসেছিলেন বলে মনে করেন তাঁরা।

তাঁদের দাবি ত্রিপুরার রাজপরিবারের ইতিবৃত্ত ত্রিপুরা রাজমালায় ত্রিপুরা রাজমালায় এই বসতি স্থাপনের কথা বলা আছে। তবে সেখানে এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলা নেই এবং এই রাজমালারও বিভিন্ন সংস্করণ রয়েছে। এর ফলে বিভ্রান্তির অবকাশও অনেক বেশি।

Tripura Portugese মরিয়মনগর গির্জার প্রধান ফাদার আব্রাহাম (ছবি- দেবরাজ দেব)

উত্তরপূর্ব ভারতে পর্তুগিজ বসতি নিয়ে গবেষণা করেছেন ডেভিড রিড সিমিলে। তাঁর বয়ান অবশ্য কিছুটা ভিন্ন। তিনি লিখেছেন   তিনি লিখেছেন রাজা অমর মাণিক্য বাহাদুর (১৫৭৭-১৫৮৬) চট্টগ্রাম ও নোয়াখালি (বর্তমান বাংলাদেশ)-তে মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য কিছু ভাড়াটে পর্তুগিজ সেনাকে কাজে লাগান। এঁরাই পরে ত্রিপুরার তৎকালীন রাজধানী রাঙামাটিতে বসবাস শুরু করেন। সেই রাঙামাটির পরে নাম হয় উদয়পুর। পরে ১৭৬০ সালে মহারাজ কৃষ্ণ মাণিক্য আগরতলায় রাজধানী স্থানান্তরিত করলে ওই পর্তুগিজরা সেখানে চলে আসেন।

মহারাজা কৃষ্ণ মাণিক্য তাঁর রাজধানী ১৭৬০ সালে আগরতলায় স্থানান্তরিত করেন। সে সময়ে ওই পর্তুগিজরাও নয়া রাজধানীতে চলে আসেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ রাজার সৈন্যবাহিনীতে বন্দুকবাজ হিসেবে যোগ দেন। বাকিরা কৃষিকাজে যুক্ত হন। তাঁদের এক জায়গায় করমুক্ত জমি দেওয়া হয়েছিল। সে জায়গা পরে মরিয়মনগর বা মেরির ভূমি হিসেবে পরিচিত হয়।

Tripura Portugese হিন্দু আচারবিধির ঠাকুরের আসনে স্থান পেয়েছেন যিশু কোলে মাদার মেরি, মিশ্র সংস্কৃতির প্রভাব পড়েছে মর্মমূলে (ছবি- দেবরাজ দেব)

Advertisment

লেখক ঐতিহাসিক শেখর দত্ত বলেছেন ত্রিপরায় পর্তুগিজ বসতির কারণ ছিল তাঁদের অন্য অবকাশ বেশি ছিল না। "কয়েকশ পর্তুগিজ চট্টগ্রামের যুদ্ধের সময়ে রাজসৈন্যদের হাতে গ্রেফতার হন। তাঁদের বলা হয়েছিল হয় ত্রিপুরায় বাস করতে হবে নয়ত নিজের দেশে ফিরে যেতে হবে। ওঁরা ত্রিপুরায় থাকতে চেয়েছিলেন। এঁরা সকলেই ভাড়াটে সেনা হলেও, এঁদের মধ্যে কেউ কেউ ত্রিপুরা রাজার সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। এঁদের বসতির জন্য জমি দেওয়া হয়।"ত্রিপুরার রাজপরিবারের উত্তরসূরী প্রদ্যোৎ কিশোর মাণিক্য দেববর্মা এর প্রায় পুরোটাই মেনে নিলেন, কেবল ওই পর্তুগিজদের ভাড়াটে সেনা নাম দেওয়ায় তাঁর আপত্তি। "ওঁরা রাজাকে যুদ্ধে সাহায্য করেছিলেন এবং এখানেই বসবাস শুরু করেন। রণকৌশলের ক্ষেত্রে ওঁদের কিছু স্কিল খুব কাজে লেগেছিল, কারণ ওঁরা আগ্নেয়াস্ত্র চালনায় দক্ষ ছিলেন।"

চার শতাব্দী পরে মরিয়মনগর এখন মিশ্র বাসস্থান। বেশ কিছু জমি পর্তুগিজরা বিক্রি করে দেন অন্যদের কাছে, কারণ তাঁরা লেখাপড়ার ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন না। অনেকেই জমি বিক্রি করে সংসার চালাতে বাধ্য হন।

Tripura Old Map পুরনো মানচিত্র

বিপ্লব লাগারডো বলছিলেন, "আমাদের পূর্বজরা প্রায় কেউই শিক্ষায় আগ্রহী ছিলেন না। রাজা ওঁদের যে জমি দিয়েছিলেন তার প্রায় সবই ওঁরা বিক্রি করে দেন। তাতেও সমস্যা ছিল না। কিন্তু জমির অভাবে এখন আমাদের মধ্যে অনেককেই পড়াশোনা করে চাকরিবাকরির খোঁজে মন দিতে হয়েছে। এখন আমাদের এখানে মিশ্র বসতি। এখানে হিন্দু রয়েছে, মুসলিম, খ্রিষ্টান সবাই রয়েছে। সব ধর্মের লোকজন এখানে শান্তিতে বসবাস করে। কোনও সমস্যা নেই।"

ঢাকার পর্তুগিজ ঐতিহ্য বরং ভাল অবস্থায় রয়েছে। অষ্টাদশ শতকের শুরু থেকে ইংরেজ ও ওলন্দাজদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা শুরু হয় তাদের।
লাগারডো বললেন তিনি বহু চেষ্টা করেছেন তাঁর পূর্বপুরুষের ইতিহাস জোড়া লাগাবার। "এ খুবই ক্লান্তিকর কাজ। আমি ১৮৬০ পর্যন্ত যেতে পেরেছি, জানালেন এই কলেজ শিক্ষক। তিনি বললেন বহু নথি ১৮৬০-এর হাঙ্গামার সময়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমি শূন্যস্থানগুলো পূরণ করবার চেষ্টা করছি। অনেকে আমাকে বলেছে বাংলাদেশের ঢাকার পর্তুগিজ সম্প্রদায়ের কাছে এ সম্পর্কিত নথি রয়েছে।"
ত্রিপুরার মরিয়মনগর গির্জা ছিল ত্রিপুরার প্রথম খ্রিষ্টিয় উপাসনাস্থল। ১৯৩০ সালে পর্তুগিজ খ্রিষ্টানদের জন্য এই গির্জা তৈরি হয়। এক শতক পার হয়ে গেল তার প্রায়। তবে এখানে ক্যাথলিক জনসংখ্যা মাত্র ৪০ হাজার।
মরিয়মনগর ক্যাথলিক চার্চের প্রধান ফাদার আব্রাহাম বলেন, প্রথম যে তিনটি পর্তুগিজ পরিবার এখানে এসেছিল, তারা পুরনো ঐতিহ্য বজায় রেখেছিল, তবে তা এখন আর আলাদা করা যায় না। তাঁর কথায়, "এখন প্রায় সবই বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছে। আজকাল আর তফাৎ করা যায় না।"
পার্থ ঘোষ ও অশোক দেবের মত লেখকরা দাবি করছেন, পর্তুগিজরা সংখ্যায় কম হবার কারণও কয়েক শতক আগের পুরনো সংস্কৃতি হারিয়ে ফলেছে। পর্তুগিজ পরিবারের কেউই আজ সে ভাষা বলতে পারে নাষ কেউ কখনও পর্তুগালে যায়ও নি। প্রায় ২৫ বছর আগে প্রার্থনার ভাষায় লাতিন থেকে বঙ্গান্তরিত হয়ে গিয়েছে। পর্তুগিজ রান্নাও খুঁজে বের করতে হবে।
২০ বছরের কলেজ ছাত্রী প্রতীক্ষা মার্চের। বললেন, "আমি পর্তুগিজ জানি না, লাতিন পড়তে পারি না। তবে পুরনো প্রজন্মের কথা জানতে আমার খুব ভাল লাগবে। একদিন পর্তুগিজ শিখেও ফেলব।"
প্রতীক্ষা পুরনো ইতিহাস জানতে চান বটে, তবে ত্রিপুরার পর্তুগিজ সেটলারদের কথা যে এখন পুরনো সেই দিনের কথা হয়ে গিয়েছে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
tripura
Advertisment