কালী কলকাত্তাওয়ালী। কালী মানেই কলকাতা। এই মহানগর দিশে, বিদেশে কালীক্ষেত্র নামেই জনপ্রিয়। কালীঘাটের মা দক্ষিণাকালীর মাহাত্ম্যতো যুগযুগ ধরে মানুষের মনে রয়েছে। কিন্তু শুধু কালীঘাটই নয়, কলকাতায় রয়েছে আরও বেশ কয়েকটি কালী মন্দির। মাহাত্ম্যগুণে সেগুলোও প্রসিদ্ধ। থিমের টানে নয়, এসব কালী মন্দিরগুলোতে ভক্ত সমাগম হয় প্রাণের টানে। দূর দূর থেকে কালীপুজোর দিন এসব মন্দিরে ভিড় জমান পূণ্যার্থীরা। রইল কলকাতার এমনই বেশ কয়েকটি কালী মন্দিরের কথা…
কালীঘাট দক্ষিণাকালীর পুজো
কালীঘাট সতীর একান্ন শক্তিপীঠের অন্যতম হিন্দু তীর্থক্ষেত্র। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, সতীর দেহত্যাগের পর তাঁর ডান পায়ের একটি (মতান্তরে চারটি) আঙুল এই তীর্থে পতিত হয়েছিল। কালীঘাট মন্দিরের সংলগ্ন একটি পুকুর রয়েছে। কথিত আছে যে, এই পুকুর থেকেই নাকি সতীঅঙ্গ পাওয়া গিয়েছিল। পুকুরটির নাম 'কুণ্ড পুকুর' এবং এর জল গঙ্গাজলের তুল্য পবিত্র বলে মনে করা হয়।
কালীঘাটের বর্তমান মন্দিরটি ২০০ বছরেরও বেশি পুরোনো। হাটখোলার দত্ত পরিবারের কালীপ্রসাদ দত্ত এবং বড়িশার সাবর্ণ রায়চোধুরী পরিবারের সন্তোষ রায়চৌধুরী এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। মায়ের মূর্তির বর্তমান রূপটি ব্রহ্মানন্দ গিরি ও আত্মারাম গিরি নামের দুই সন্ন্যাসী দান করেন। কালীঘাট কালীমূর্তি কষ্টিপাথরের তৈরি। মূর্তিটির জিভ, দাঁত, মুকুট, হাত ও মুণ্ডমালা সোনার। মন্দিরের মধ্যে একটি সিন্দুকে সতীর প্রস্তরীভূত অঙ্গটি রক্ষিত আছে। সেটি কারুর সামনে বের করা হয় না। প্রতি বছর পয়লা বৈশাখ, দুর্গাপূজা ও দীপান্বিতা কালীপূজার দিন এই মন্দিরে প্রচুর ভক্তের সমাগম ঘটে। এছাড়াও, বছরের প্রায় সবসময়ই এখানে ভক্তদের ভীড় লক্ষ্য করা যায়।
কালীপুজোয় কালীঘাটে মহালক্ষ্মীর আরাধনা করা হয়। দেবী দক্ষিণাকালীকেই এদিন মহালক্ষ্মী রূপে পুজো করার রীতি প্রচলিত আছে কালীঘাটে। অমবস্যায় অলক্ষ্মী দূর করার নিয়ম সারা হলে সন্ধ্যার পরে শুরু হয় লক্ষ্মীপুজো। সন্ধে নামতেই মন্দিরের চারদিকে সাত পাক ঘোরার পরে খড়ের পুতুলে আগুন ধরিয়ে দূর করা হয় অলক্ষ্মীকে। তারপর শুরু হয় মহালক্ষ্মীর পুজো। সেটিই হল মূল পুজো।
আরও পড়ুন- পৌষ থেকে মাঘ সংক্রান্তি, ঢাকের তালে নৃত্য করেন দেবী, মন্দিরেই থাকতে হয় ঢাকিকে
কালীপুজোর দিনও সকালে নিত্যপুজোয় ফল প্রসাদ, নৈবেদ্য হিসেবে আতপ চাল দেওয়া হয়। দুপুরেও রোজের মত মায়ের ভোগে থাকে শুক্তো, পাঁচ রকম ভাজা, সাদা ভাত, মাছের কালিয়া, পাঁঠার মাংস, পোলাও, পায়েস। এই দিনটায় কালীঘাটের মন্দিরের সব সেবাইতের ঘর থেকেই ভোগ পাঠানো হয়। সন্ধ্যায় খড়ের অলক্ষ্মীর পুতুল পোড়ানোর পরেই কালীঘাটের মা দক্ষিণা কালীকে পুজো করা হয়। পুজোর পরে দক্ষিণাকালীকেই লক্ষ্মী রূপে ভোগও দেওয়া হয়। তার পরে হয় আরতি।
কুমোরটুলির সিদ্ধেশ্বরী কালী
কলকাতার কুমোরটুলি অঞ্চলেরয়েছে সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নিজে এই মন্দিরে নিয়মিত আসতেন। কেশবচন্দ্র সেন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে, শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর সুস্থতার জন্য এই মন্দিরে দেবীর কাছে ডাব-চিনি মানত করেছিলেন। উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বসুমতী সাহিত্য মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীরামকৃষ্ণের নির্দেশে এই মন্দিরে ছুটে আসতেন। গিরিশচন্দ্র ঘোষ তাঁর নাটক রচনার পর এই মন্দিরে দেবীর পায়ে ছুঁইয়ে তারপর নাটকের মহড়া শুরু করতেন। তিনি দেবী সিদ্ধেশ্বরীকে ভক্তিভরে 'উত্তর কলকাতার গিন্নি' বলেও ডাকতেন।
এই মন্দির অত্যন্ত প্রাচীন। এতটাই প্রাচীন যে একসময় এই মন্দিরের পাশ দিয়ে হুগলি নদী বয়ে যেত। সেই নদী বর্তমানে পশ্চিমদিকে অনেকটাই সরে গিয়েছে। এখানে সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন কালীবর নামে এক সন্ন্যাসী।
এখানকার দেবীমূর্তির বছরে একবার অঙ্গরাগ হয়। দেবীর বাম পায়ের দিকে রয়েছে শ্বেত দিগম্বর মহাদেবের মাথা। মন্দিরে দেবীর হাতের খাঁড়া ছাড়াও আরও দুটি খাঁড়া আছে। তার মধ্যে একটি খাঁড়া দিয়ে আগে বলি হত। সেই খাঁড়া তোলা আছে। আর একটি প্রাচীন খাঁড়া আছে। যা ধোয়া জল অনেক ভক্ত বাড়ি নিয়ে যান। সেই জল বাড়িতে থাকলে কোনও অশুভ শক্তি ওই পরিবারকে স্পর্শ করতে পারে না-বলেই বিশ্বাস ভক্তদের। তবে, বারবার করে জলে ধুয়ে ফেলার জন্য খাঁড়াটি ক্ষয়ে গিয়ে খুব ছোট হয়ে গিয়েছে।
ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি
বউবাজারে রয়েছে শহর কলকাতার অন্যতম প্রাচীন কালীমন্দির। এমনিতে সিদ্ধেশ্বরী দেবীর মন্দির হলেও, এই মন্দিরের বেশি পরিচিতি ফিরিঙ্গি কালী মন্দির নামে। চাঁদনি স্থাপত্যের এই মন্দিরের কালীমূর্তিটি মাটির তৈরি। উচ্চতায় সাড়ে পাঁচ ফুট। দেবী বসন পরিহিতা এবং ত্রিনয়না। নিত্য পুজো তো হয়ই। এছাড়া এই মন্দিরে প্রতি অমাবস্যায় কালীপুজোর চল আছে।
মন্দিরের দেওয়ালের সামনের ফলকে লেখা আছে, ‘ওঁ শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী কালীমাতা ঠাকুরাণী। স্থাপিত ৯০৫ সাল, ফিরিঙ্গী কালী মন্দির।’ এই ৯০৫ সাল বলতে ৯০৫ বঙ্গাব্দের কথা বোঝানো হয়েছে। কথিত আছে, এই মন্দিরটি প্রথমে ছিল শিব মন্দির। ১৮২০ থেকে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, টানা ৬০ বছর এই মন্দিরের এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ছিলেন শ্রীমন্ত পণ্ডিত। সেই সময় মন্দিরের বিশেষ নামডাক ছিল। নিঃসন্তান শ্রীমন্ত পণ্ডিত ১৮৮০ সালে পোলবার বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারকে দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে মন্দিরটি বিক্রি করেন। সেই সময় ৬০ টাকায় এই দেবোত্তর সম্পত্তিটি কিনেছিলেন শশিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
ফিরিঙ্গি কালী মন্দিরে পুজো হয় সম্পূর্ণ বৈদিক মতে। একদা পশুবলি হলেও থাকলেও এখন আর তা হয় না।
আরও পড়ুন- বাংলার অন্যতম সতীপীঠ, যেখানে চৈতন্যপূর্ব যুগ থেকেই ভিড় করেন অসংখ্য ভক্ত
ইতিহাসে ঢু মারলে জানা যায়, উনিশ শতকে পর্তুগিজ বংশোদ্ভূত কবিয়াল অ্যান্টনি হেন্সম্যান এই দেবস্থানে এসেই বুঝেছিলেন, আসলে খ্রিস্ট আর কৃষ্ণ অভিন্ন। ভালবেসে বাংলাভাষার আঙিনায় ঢুকে ভিনদেশি কবি দেবী কালিকার উপাসক হয়ে গিয়েছিলেন। অ্যান্টনি কবিয়াল ফিরিঙ্গি থাকেননি। বরং সিদ্ধেশ্বরী কালীমাতা হয়ে গিয়েছেন ফিরিঙ্গি কালী। যদিও ঐতিহাসিক রাধারমণ মিত্র এর সঙ্গে একমত নন। তিনি তাঁর 'কলকাতা দর্পণ' বইয়ে লিখেছেন, অ্যান্টনি কবিয়ালের সঙ্গে ফিরিঙ্গি কালীবাড়ির কোনও সম্পর্ক নেই। এটি অপপ্রচার।
ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি
জঙ্গলের মধ্য থেকে শোনা যেত কালী মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি। ঠনঠন-ঠনঠন। সেই থেকেই এলাকার নাম ঠনঠনিয়া। সেই ঠনঠনিয়াতেই সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ি। যে মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী গান শুনেছেন কিশোর গদাধর চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠে। কামারপুকুর থেকে এসে মন্দিরের অদূরে ঝামাপুকুরে তখন থাকতেন গদাধর। দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে গদাধর থেকে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস হওয়ার পরেও বারবার দর্শন করতে এসেছেন ঠনঠনিয়া কালীকে। এই দেবী গান শুনেছেন সাধক কবি রামপ্রসাদ সেনের গলাতেও।
আরও পড়ুন- এই মন্দির থেকে খালি হাতে ফেরেন না ভক্তরা, জাগ্রত দেবী সর্বমঙ্গলা
জঙ্গল অধ্যুষিত সুতানুটি গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে ভাগীরথী। নদীর পাশে অরণ্যবেষ্টিত এক শ্মশানে তান্ত্রিক উদয়নারায়ণ ব্রহ্মচারী তৈরি করেন মাটির সিদ্ধেশ্বরী কালীর মূর্তি। সেটা আনুমানিক ১৭০৩ সাল। ১৮০৩ সালে শঙ্কর ঘোষ নামে এক ব্যবসায়ী মায়ের মন্দির গড়ে দেন। অধিষ্ঠাতা ভৈরব পুষ্পেশ্বর শিবের জন্য গড়ে দেন আটচালা। রাধারমণ মিত্র অবশ্য ম্যাককাচন সাহেবকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন, ঠনঠনিয়ার সাবেক কালীমন্দির ১৮০৩ সালে তৈরি হয়। কিন্তু বর্তমান মন্দিরের গায়ে এক পাথরে ১১১০ সাল লেখা আছে। অর্থাৎ, এই পাথরের প্রমাণে কালীমন্দির তৈরি হয়েছিল ১৭০৩ খ্রিস্টাব্দে। ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে নয়’।
শঙ্কর ঘোষের বংশধররাই এখনও এই মন্দিরের সেবায়েত। কার্তিক অমাবস্যায় মহা সমারোহে পূজিত হন সিদ্ধেশ্বরী।
টালিগঞ্জ করুণাময়ী কালী মন্দির
বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরি পরিবারের নন্দদুলাল রায়চৌধুরির কন্যা করুণাময়ীর অকাল বিয়োগ ঘটে। শোকে পাগল নন্দদুলালকে একদিন রাতে মেয়ে করুণাময়ী স্বপ্নে একটি কষ্টিপাথর দেখিয়ে দেন, বলেন এই কষ্টিপাথরেই 'আমি তোমার কাছে থাকব।' নন্দদুলাল ওই কষ্টিপাথর কেটে তৈরি করালেন কালীমূর্তি। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ ১১৬৭ বঙ্গাব্দে বারোটি শিবমন্দির সমেত টালিগঞ্জের পশ্চিম পুটিয়ারিতে আদিগঙ্গার পশ্চিমপাড়ে মন্দির তৈরি করে কষ্টিপাথরের কালীমূর্তিকে প্রতিষ্ঠা করলেন। কন্যার নামে মায়ের নাম রাখেন 'মা করুণাময়ী'।
কালের নিয়মে মন্দির ধ্বংসের কবলে পড়ে। তৈরি হয় নতুন মন্দির। দেবী করুণাময়ী যেখানে ছিলেন, সেখানে আজও বিরাজ করছেন। অপূর্ব সিংহাসনে দেবী করুণাময়ী প্রতিষ্ঠিতা। একই কষ্টিপাথরে তৈরি বলে মা করুণাময়ী ও মায়ের তলায় শায়িত মহাদেব উভয়েই কালো। বেনারসি শাড়ি ও গয়নায় সজ্জিতা দেবী যেন এক ছোট্ট বালিকা। দীপান্বিতা কালীপুজোয় এখানে কুমারী পুজো হয়।
আরও পড়ুন- জাগ্রত দেবী মঙ্গলময়ী, কোন টানে যেন দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন অসংখ্য ভক্ত
কালীপুজোর দিন মায়ের ভোগে থাকে লুচি, ছোলার ডাল, নানারকম সবজির তরকারি, পোলাও, খিচুড়ি, পায়েস, চাটনি। এছাড়া করুণাময়ী বাজারে ওইদিন যতরকম মাছ আসে, প্রায় ১০ রকম মাছের পদ মাকে নিবেদন করা হয়। ভক্তরা কালীপুজোর দিন সারা রাত মন্দিরে বসে পুজো দেখেন। আগে বলি হলেও এখন বলি হয় না।
ঢাকা কালী
কলকাতার ঐতিহ্যবাহী কালীবাড়িগুলির অন্যতম হল ঢাকা কালীবাড়ি। দক্ষিণ কলকাতার প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের এই কালীবাড়ির মা কালী জাগ্রত বলে প্রচলিত । কালীপুজোর দিন ষোড়শ উপাচারে মায়ের আরাধনা করা হয়। ওইদিন প্রথা মেনে মাকে অন্নভোগের পাশাপাশি মাছের পদ নিবেদন করা হয়।
আরও পড়ুন- দুর্গাপুজোর তিথিগুলোর সঙ্গে জুড়ে থাকে ‘মহা’ শব্দ, কেন?
দেশভাগের সময় অধুনা বাংলাদেশের বাসিন্দা ননী গোপাল চক্রবর্তী কলকাতায় এসে এই কালীবাড়ি তৈরি করেন । নাম দেন ঢাকা কালীবাড়ি । সেই থেকেই প্রথা মেনে এখানে বংশ পরম্পরায় মায়ের পুজো চলে আসছে ।