রবিবারের দুপুরে বইমেলার মাঠে ব্রিগেড যেতে না-পারার জন্য আক্ষেপ করছিলেন এক সিপিএম কর্মী। বলছিলেন, এই প্রথমবার ব্রিগেড যাওয়া হল না তাঁর। মধ্য চল্লিশের সেই মানুষটির ওপর দায়িত্ব বইমেলার স্টল সামলানোর। সিপিএম আর তার গণসংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতায় বেশ কয়েকটি স্টল হয় বইমেলায়। গণশক্তি, যুবশক্তি, ছাত্র সংগ্রাম, এনবিএ - তার মধ্যে অন্যতম।
আরও পড়ুন, বইমেলা, বিভ্রম
দুুপর দুটো নাগাদ, ব্রিগেডে যখন তুঙ্গমুহূর্তের অপেক্ষায়, সে সময়ে বইমেলায় এসব স্টলগুলি নেহাৎই ফাঁকা। ব্রিগেডের জন্য ভিড় কম হবে এদিন, তেমনটা ভেবেই রেখেছিল গণশক্তির স্টল। ন্যাশনাল বুক এজেন্সিতে উপস্থিত শেখর করবর্মণ, অরূপ চক্রবর্তীরা জানালেন, দুপুরবেলা বইমেলায় ভিড় হয় না সাধারণভাবে, সে রবিবার হলেও। বিকেলের পর থেকে ভিড় বাড়বে। শেখরবাবুর হিসেব, "ব্রিগেডে আমাদের দুটো স্টল হয়েছে। সে দুটে স্টল থেকে আজ বইমেলার চেয়ে বেশি বিক্রি হবে।" ওঁরাই বললেন, স্টল বন্ধ রেখেছে ছাত্রসংগ্রাম।
ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের স্টল খুলল বেলা চারটের পর। সুশোভিত ছোটখাটো সে স্টলে ছিলেন সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক প্রতীক-উর রহমান এবং ছাত্র সংগ্রামের সম্পাদক অরুণাঞ্জন।
মেলার স্টলের চেয়ে ব্রিগেডকে বেশি জরুরি মনে করলেন কিনা, সে প্রশ্নের জবাবে প্রতীক বললেন, তেমনটা আদৌ নয়। "বইমেলা বনাম ব্রিগেড নয়। আমরা এ দুইকে একে অপরের পরিপূরকই ভাবি। আমরা বামপন্থীরা বিশ্বাস করি, না জানা গেলে লড়াই করা যায় না। আর জানার জন্য একমাত্র হাতিয়ার বই।" কিন্তু তা সত্ত্বেও তো বইমেলার স্টল বন্ধ রেখে ব্রিগেডেই গিয়েছিলেন। তেমনটা কেন ঘটল? অরুণাঞ্জনের উত্তর, "আসলে আমাদের একটা বই বেরোবে ভগৎ সিংয়ের ওপর। গ্রাফিকাল বই। শোভনলাল দত্তগুপ্ত বইটার আনুষ্ঠানিক প্রকাশ করবেন বিকেল তিনটের সময়ে। সে বইটার কাজ করার জন্য দুজন প্রেসে গিয়েছিল। বাকি দুজন ব্রিগেডে।"
কেন ব্রিগেডে যাওয়াকে সে ব্যাপারে অগ্রাধিকার দেওয়া হল, তাও স্পষ্ট করে জানিয়েছেন অরুণাঞ্জন। "আমরা যারা ছাত্র সংগঠন করি, তারা নিজেদের বিপ্লবের অগ্রণী বাহিনী হিসেবে ভাবি। যে সব মানুষ এক রাত-দু রাত জেগে এই ব্রিগেডে এসে পৌঁছেছেন, লাখ লাখ সে সব মানুষকে সম্মান জানাতে সেই ব্রিগেডে যাওয়া কি আমাদের কর্তব্য নয়? এখানে কোনও বনাম নেই। আমাদের ব্রিগেড যাওয়াটা ওই মানুষগুলির প্রতি দায়বদ্ধতা।" প্রতীকের বক্তব্য, "আসলে বইমেলা আর ব্রিগেডে কোনও ফারাক নেই। এটা আছে বলেই ওটা আছে।"
রবিবারের বিকেলে মেলার মাঠে দেখা হল ব্রিগেড ফেরতা ইন্দ্রনীলের সঙ্গে। টালিগঞ্জের বাসিন্দা ইন্দ্রনীল বললেন, "আসলে নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। ব্রিগেড যাওয়াটা সেই নিঃশ্বাসের খোঁজে। আমি ২০০৫ সালের পর এই প্রথম ব্রিগেড গেলাম। তখন দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যোগ ছিল। কিন্তু এখন আর নেই। তবুও সারা ভারতের এবং সারা পশ্চিমবঙ্গের এখন যা অবস্থা, তাতে নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা ফুরিয়ে এসেছে। আমার যাওয়া অনেকটা কাঠবিড়ালির সেতুবন্ধনে পাথর এনে দেওয়ার মতই, তা ছাড়া কিছু নয়। ব্রিগেডে গিয়েছিলাম মনকে বাঁচাতে। আর এখানে এসেছি মনকে একটু খাদ্য জোগাতে।"
ব্রিগেডের জনসমাবেশ দেখে উদ্বেলিত মেলায় হাজির রাজ্য সরকারি কর্মচারী সমতা (নাম পরিবর্তিত)। তিনি বললেন, "ব্রিগেড যাওয়া আমার কাছে কোনও দলীয় কর্মসূচি ছিল না। আমি জেদি মানুষ দেখতে গিয়েছিলাম। যাঁরা মার খাওয়ার আশঙ্কা সত্ত্বেও ব্রিগেডে এসেছেন, তাঁদের দেখলে মনের জোর পাওয়া যায় বৈকি।"
আরও পড়ুন, কলকাতা বইমেলা: মমতা ৮৭ নট আউট
রাজ্য সরকারের কর্মচারী অর্জুন (নাম পরিবর্তিত) বললেন, "৪৬ বছর বয়সে প্রথমবার ব্রিগেড গেলাম আজ। না গিয়ে থাকা গেল না।" কাঠবিড়ালির পাথর আনার উদাহরণ দিলেন তিনিও।
বিকেলের পর এনবিএ স্টলে গিয়ে জানা গেল, রবিবার অনুযায়ী বইমেলায় ভিড় হয়নি। এবারের বইমেলায় ভিড় কম হচ্ছে বলেই অনুযোগ তাঁদের।
শুধু নিউ টাউনের এক সিপিএম কর্মী কিছুটা বেসুর। বলছিলেন, "আমাদের এলাকায় যে ভাবে আমাদের সরকারের আমলেই উন্নয়নটা হল, তার খেসারৎ দিতে হচ্ছে। তখনও বারবার বলেছিলাম। নেতার শুনলেন না। অত সহজ নয়, তাড়াহুড়ো করতে নেই অত। জ্যোতিবাবু বলতেন, মানুষকে সঙ্গে নিতে।"