Advertisment

বইমেলা অবিরত, পুরনো অভ্যাস

প্রায় সকলেই এখন ‘টাইপো’ নামের একটা শব্দ দিব্য শিখে গেছেন, ব্যবহারও করেন যত্রতত্র। 'বেরিয়ে' আর 'বেড়িয়ে'-র মধ্যে ভ্রান্তি চোখে আঙুল দিয়ে দেখালে, টাইপো-র ঢাল খাড়া হয়ে যায়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

চার-পাঁচ দশক আগে, যখন ছাপাখানা বলতে কেবল লেটার প্রেস বোঝা হত, তখন সম্পাদকদের মধ্যে একটা লব্জ চালু ছিল, ‘ছাপাখানার ভূত’। যতই চেষ্টা করা হোক না কেন, দু-একটা মুদ্রণপ্রমাদ কিছুতেই এড়ানো যেত না বলে তাঁরা মশকরা করে বলতেন, ভূতে এসে গণ্ডগোল পাকিয়ে গেছে।

Advertisment

প্রযুক্তি তারপর প্রভূত উন্নতি করেছে, প্রায় রূপকথার মত। ছাপাখানার কাজকর্মের পদ্ধতি আমূল বদলে গেছে। সহজতর হয়েছে অনেক। গ্যালিতে লেটার বাঁধা এখন জাদুঘরের ছবি প্রায়। আগের আধো আঁধার ছাপাখানা এখন আর নেই। ফলে ভূতেদের বাসা বাঁধার মতন আবডালও নেই। এখন সবই স্পষ্ট প্রতীয়মান। সেই স্পষ্টতায় দেখা যায়, মুদ্রণপ্রমাদ কোনও ভূতের কীর্তন নয়, এ কেবল অজ্ঞতা আর অযত্নপ্রসূত।

প্রায় সকলেই এখন ‘টাইপো’ নামের একটা শব্দ দিব্য শিখে গেছেন, ব্যবহারও করেন যত্রতত্র। 'বেরিয়ে' আর 'বেড়িয়ে'-র মধ্যে ভ্রান্তি চোখে আঙুল দিয়ে দেখালে, টাইপো-র ঢাল খাড়া হয়ে যায়। নিতান্ত সকরুণ ও কুণ্ঠিত হয়ে পাঠক তাকিয়ে দেখেন, শঙ্খ ঘোষের উদ্ধৃতিতে ভুল বানান ব্যবহৃত হচ্ছে নতুন বইয়ের ব্যাক কভারে। যা কিনা এক অর্থে বিজ্ঞাপনও বটে। বিশেষ রূপে জ্ঞাপন করতে গিয়ে এ মর্মান্তিক ভ্রান্তিকে মেনে নেওয়ার একটা দস্তুরও লেখক-পাঠক-প্রকাশকের মধ্যে ক্রমশ তৈরি হচ্ছে, সে বড় সুবিধের হচ্ছে কিনা সে কথা ভেবে দেখার সময়ও সম্ভবত সমাগত।

আরো পড়ুন: কলকাতা বইমেলার কয়েকটি জরুরি তথ্য

বাংলা ভাষায় অন্য শব্দের প্রবেশ নিয়ে যাঁরা সদাচিন্তিত, তাঁরা এ ব্যাপারে নজর দেবেন কিনা, তা-ও অবশ্য দেখার। বইমেলা উপলক্ষে যেসব প্রকাশকরা বহুল পরিমাণে বই প্রকাশ এবং বিক্রি করছেন, তাঁদের বোধোদয় সম্ভবত বহু শতাব্দীর না হলেও বহু দশকের কাজ। কারণ এ ধরনের প্রকাশ আর যাই হোক, মনীষীর কাজ নয়। তবে তাঁদের বিজ্ঞাপনের বয়ানে মনীষীপ্রতিম বিভিন্ন বাণী থাকে, যা এমনটা চলতে থাকলে ক্রমশ অবিশ্বাস্য তো বটেই, হাস্যকরও মনে হতে থাকবে।



বইমেলার ভিড় অবশ্য এসবে তত কান দেয় না। যেসব প্রকাশক, পরিচিতদের দেখলে আকর্ণবিস্তৃত হাসির সমারোহ ঘটাচ্ছিলেন, তাঁরা এদিন বিল বানাতে ব্যস্ত। মেলায় বইপাড়ার তুলনায় কম ছাড় মিললেও, এমন প্রদর্শনী চোখের সামনে মেলে না। কিন্তু বহুক্ষেত্রেই পাঠকের অভিজ্ঞ চোখ ও বিক্রেতার অপেশাদারি মনোভঙ্গি প্রকাশক-পাঠক যৌথতার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা সংগ্রহের প্রথম খণ্ড, "ছাপা নেই" বলে ভিড় হঠাতে চান কাউন্টারকর্মী। ক্রেতার অনমনীয় মনোভাবের সামনে শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, বইটি হাতে নিয়েই তিনি ছাপা শেষ বলছিলেন। অভিজ্ঞ পাঠক কলেজ স্ট্রিট পাড়ার দুর্দশা জানেন, তিনি দীর্ঘশ্বাস ও বিরক্তি দুইই একাধারে চেপে ফেলেন, হতাশায়। পরদিনও হয়ত তিনি আবার ওই স্টলের সামনে লাইনে দাঁড়াবেন নিরুপায় চিত্তে। প্রকাশক সে নিরুপায়তার কথা জানেন বলেই, নির্দ্বিধায় একই ভঙ্গিমায় ব্যবসা চালিয়ে যাবেন, যা কার্যত সারস্বতসাধনা থেকে বহু দূরবর্তী।

সারস্বতসাধনা নিয়ে অহংকারের কমতি নেই লিটল ম্যাগাজিনের প্রকাশকদের মধ্যে। তাঁদের প্রকাশ, ঘোষিত ভাবেই লাভের উদ্দেশ্যে নয়। ফলত তাঁরা একটু কলার-তোলা প্রকৃতির। বিক্রির পদ্ধতি নিয়ে তাঁদের অনেকেরই মারমুখী ভাব থাকে। যাকে বলে পুশ সেলিং। পাঠককে ক্রমাগত দিকনির্ণয় করিয়ে যাওয়া তাঁদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে বলেই তাঁরা মনে করেন। অনেক ক্ষেত্রেই যে এসব স্টাইল বিরক্তিকর হয়ে ওঠে, তা তাঁরা ঠাহর করে উঠতে পারেন না। এবং, অধিকারবোধ বশতই, তাঁরা মেলায় যোগদানের সাধারণ, ন্যূনতম বিধিগুলিও লঙ্ঘন করেন।

অনেক লিটল ম্যাগাজিনই তাঁদের প্রকাশিত ও বিক্রীত বইয়ে কোনও ছাড় দেন না, ব্যবসা করছেন না, এই অজুহাতে। মেলায় ক্রেতারা সাধারণত এ আবদার মেনে নেন হাসিমুখে, বা বিরক্তি সহকারে। লিটল ম্যাগাজিন যদি তাঁদের ব্যবসায়ের জন্য মেলা কমিটির থেকে কোনও ভিন্ন বিধি তৈরি করে নেন, তাহলে এ নিয়ে অনেক দ্বিধা ও সংশয়ের অবসান হবে। তদবধি, তাঁদের এজাতীয় ক্রিয়া বিধিভঙ্গ বলেই গ্রাহ্য।

মাসের প্রথম রবিবারে নতুন ঠিকানার বইমেলা যেমনটি হওয়া উচিত, তেমনটিই হবে। অনেকটা অপেশাদার, অনেকটা থই-না-পাওয়া নানা মুখের সমারোহ। তবে মেলাই তো, সবই যথাযথ হলে সম্ভবত অনভ্যাসের ফোঁটার মতন লাগবে, যা চড়চড় করবে কেবল পাঠক-লেখক-প্রকাশকের কপালে।

Kolkata Book Fair
Advertisment