Advertisment

ধুলামাটির বাউল: একটি গল্পের খসড়া       

জীবনটা একটু ইদিক-উদিক হয়ে গেছে, তা না হলে কনকচাঁপা পুণ্যবতী। ওই সময়ের থেকে আরও প্রায় দেড় হাজার বছর পিছিয়ে যাই যদি, তাহলে দেখব, কনক ছিল গ্যালিলিতে ল্যাজারাসের বিয়েতে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Sanmatrananda

ছবি- মধুমন্তী, গ্রাফিক্স- অভিজিত

বাগনান এসে গেলে ট্রেনটা একটু হালকা হয়ে যায়—এ আমি সেই ছাত্রবেলা থেকেই দেখে আসছি। ডেইলি প্যাসেঞ্জাররা এই স্টেশনেই বিপুল সংখ্যায় নেমে যান। তাছাড়া এ হচ্ছে রাতের ট্রেন। সাড়ে আটটা বাজে। মেদিনীপুরে ঢুকবে সাড়ে দশটা নাগাদ। আজ কোথায় যেন একটা রেল-অবরোধ ছিল। ফলে এমনিতেই যাত্রীর সংখ্যা কম। ঘর থেকে বেরোনোর ঝুঁকি অনেকেই নেননি। পাঁশকুড়ার কাছাকাছি যখন আসা গেছে, কামরা জনবিরল হয়ে এল। ঝিমোনো একটা বালবের আলোয় রেলপথের দুপাশের বাতাস মেখে মোহময় অন্ধকার কামরার ভিতর কানামাছি খেলতে নেমেছে। এখানে ওখানে অস্পষ্ট দুয়েকটা মানুষ চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছে  অনতিগ্রাহ্য স্মৃতির মতন, অনেক সিট একেবারে খালি। মাঝে মাঝে ফেরিওয়ালাদের স্তিমিত ডাকাডাকি—সমস্ত পরিবেশটিকে ঐন্দ্রজালিক বাস্তবতায় মুড়ে দিয়েছে যেন।

Advertisment

আমিও ঝিমোচ্ছিলাম একপাশে। মাঝে মাঝে জেগে উঠে নজর রাখছিলাম বাঙ্কের উপর রাখা ব্যাগটার উপর। কেউ তুলে নিয়ে নেমে যেতে পারে কোনো অচেনা অন্ধকার স্টেশনে। মনকে ধমক দিলাম একবার, সাধু হয়েও বোঁচকায় মনটি ষোল আনা! সেকথা ঠিক, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, ব্যাগের ভিতর আমার জপের মালা আছে। ওটি গেলে আমি অতল নদীর জলে পড়ে যাব। খেয়াল তো রাখতেই হয়। নিরালম্ব হতে কাজে-কাজেই আমার বহুত দূর বাকি।

ছাপা বই বনাম পিডিএফ, বাংলার হাল ও হকিকৎ

আমি বসে আছি প্যাসেজের ঠিক পাশে। মাথার উপর স্টিলের হাতলগুলো ট্রেনের দোলায় দুলে উঠে সহস্র খঞ্জনীর মতো বেজে উঠছে থেকে থেকেই। এখান থেকে দেখা যায়, দরজার কাছে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে মেঝের উপর বসে আছে সবুজ মাফলার পরা একটা লোক। গায়ে একটা ছাই-ছাই রঙের চাদর। গুনগুন করে কী একটা গান গাইছে আর হাতে তাল দিচ্ছে। সুরটা সত্যিই অদ্ভুত। এখনকার কোনো সুর নয় যেন। অন্যরকম। হবে হয়তো কোনো পুরোনো হিন্দি সিনেমার গান।

এত জায়গা থাকতে মেঝেতে গিয়ে বসেছে কেন? মনে হয়, ওখানে বসতেই সে স্বচ্ছন্দ বোধ করে। ট্যাঁক থেকে একটা বিড়ি বের করে দেশলাই জ্বালিয়ে ধরালো। ট্রেনের মধ্যে ধূমপানের নিয়ম নেই। কিন্তু সে এইসব গ্রাহ্য করছে না। রাতের ফাঁকা কামরা, তায় আবার লোকাল ট্রেন, কে আর দেখছে? বিড়ির আগুন দপদপিয়ে উঠছে আধো অন্ধকারে। নীলচে ধোঁয়া আবছায়ার মধ্যে ভেসে যাচ্ছে।

সুরটা শুনতে শুনতে আবার আমার ঘুম এল। তন্দ্রার ঘোর। সেই ঘোরের মধ্যে কতগুলো ছবি গড়ে উঠছে, ভেঙে পড়ছে। সেগুলোকে বাস্তব বলা যায় না, আবার নিতান্ত অবাস্তবও নয় হয়তো। অথবা সেগুলো হয়তো শুধু আমার সাপেক্ষেই সত্যি। আর কিছু নয়।

...লোকটার নাম এখন যাই হোক; তখন ওর নাম ছিল অচ্যুত। সে এখন থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগের কথা। তখন ও এরকম ছিল না। এরকম শীর্ণ কষাটে চেহারা ছিল না ওর; রীতিমত শক্ত সমর্থ যুবক। এমন অসুন্দর মাফলার পরত না তখন; মাথাভর্তি কাঁধছাপানো কুচকুচে বাবরি চুল ছিল। অচ্যুত ভালোবাসত কনকচাঁপাকে। কনকচাঁপা  বিষ্ণু দামোদর মন্দিরের বোস্টমী; শ্রীবাস-অঙ্গন থেকে চৈতন্যদেব যখন পরিকরসঙ্গে মন্দির পর্যন্ত সঙ্কীর্তন করতে করতে আসতেন, কনক তখন ফেনী বাতাসা ছড়িয়ে হরির লুঠ দিত।

সাহিত্য অকাদেমি ঠিক কোন ভাষার জন্য?

জীবনটা একটু ইদিক-উদিক হয়ে গেছে, তা না হলে কনকচাঁপা পুণ্যবতী। ওই সময়ের থেকে আরও প্রায় দেড় হাজার বছর পিছিয়ে যাই যদি, তাহলে দেখব, কনক ছিল গ্যালিলিতে ল্যাজারাসের বিয়েতে। মাটির তৈরি জালা থেকে জল আনতে গিয়ে সে-ই প্রথম দেখে, পানীয় জল মদ হয়ে গেছে। ঝাঁঝালো সুরার গন্ধে সে মুগ্ধ হয়ে গেছে দেখে কিউরিয়া নামের মেয়েটি তাকে ঈষৎ রঙ্গভরে ঠেলা দিয়ে বলেছিল, ‘কী দেখছিস লা সুজান, তোর কি ঘোর লেগে গেল নাকি?’ কনকের নাম তখন সুজান, গ্যালিলির মেয়ে।

সে উত্তর দিয়েছিল, ‘কী আশ্চর্য! জলে এমন চনমনানি পাগল-করা গন্ধ হয় নাকি?’

বিয়ের আসরের মাঝখানে অগ্নিকুণ্ডের পাশে তখন অন্য যুবকদের সঙ্গে হাতে হাত রেখে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে নাচছিল মরিয়মের ছেলে যোশুয়া! কনকের অর্থাৎ সুজানের দিকে চোখ টিপে  হেসে সেদিন যোশুয়া একটু রগড় করেছিল। সে রগড় মারাত্মক, যোশুয়ার ওই কটাক্ষের জ্বালা কনককে বহু জন্ম ধরে বইতে হয়েছে। বুকের ঘা, সহজে সারে না।

তার প্রায় দেড় হাজার বছর পরে কনক যখন কনক হয়, অথবা যখনও সে প্রকৃষ্টকনক হয়ে ওঠেনি, তখন লখনৌতে আরমানি বাইয়ের কাছে সে টপ্পা-ঠুমরি শিখত। ওখানেই কনকের সঙ্গে সবুজ মাফলার-পরা লোকটার দেখা হয়। ও হো! ‘মাফলার-পরা লোক’ বলছি কেন? সে তো তখন মাফলার পরত না। তার তখন কুঞ্চিত কেশদাম। বলিষ্ঠ শালপ্রাংশু মহাভুজ যুবক। নাম তার অচ্যুত। যাই হোক, যেকথা বলছিলাম, কনকচাঁপার সঙ্গে অচ্যুতর দেখা হল লখনৌয়ের এক মেহফিলে।

...ঔর কব তক রুলায়েঁগে হামে বোলো মেরে শ্যাম...তুহার ছলাই সহা নেহিঁ জায় মোহে দিবা যাম... আর কতোদিন আমাকে এমন করে কাঁদাবে, ওগো শ্যাম? অহোরাত্র তোমার এ ছলনা আর যে আমি সহ্য করতে পারছি না।

চাঁদের রাতে চুনার মসজিদের আঁধার-ছায়ায় অচ্যুতর সঙ্গে কনকের কয়েক রাত দেখা, হাতে হাত রাখা, শ্বাসের গভীরে এ ওর ঠোঁটে চুম্বন আঁকা, বুকের মধ্যে ত্রস্ত পারাবতের মতো মুখ রাখা—এসব হয়ে যাবার পরে অচ্যুত পাগল হয়ে গিয়ে বলেছিলঃ

“কনক, ও কনক, চলো আমরা পালিয়ে যাই”

—কোথায় যাবে?

—আমার দেশ নবদ্বীপে। যাবে?

—কিন্তু খাবো কী? তোমার পয়সায় আমি তো বসে বসে খাবো না।

—কেন, কনক? আমরা ঘর বাঁধব। বিয়ে করব।

উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠে আমগাছের গা থেকে খসে পড়া বিলোল মাধবীলতার মতো মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কনকচাঁপা বলেছিল, ‘ধুর, ঘর বাঁধব কী গো? জানো, আমি কে? আমি যে সুজান! আমার দিকে তাকিয়ে যে  মরিয়মের ছেলে যোশুয়া চোখ টিপে হেসেছিল। ইহুদি রাজা হেরোড তাকে ক্রুশকাঠে গেঁথে মেরে ফেলল, সেই থেকেই যে ঘর আমার আর হল না। আমার চোখের জলে জর্ডন নদী যে ভেসে গেছে!’

দেবী সরস্বতী বাক্যের দেবী, তিনিই দণ্ডনীতি সৃষ্টিকারিণী

—তোমার কথা বুঝি না আমি, কনকবাই! আমরা সাধারণ মানুষ, সাধারণ চাওয়া-পাওয়া নিয়ে বেঁচে থাকি। তাই নিয়েই মরি। আমাকে বিয়ে করে আমার সঙ্গে ঘর বাঁধবে কেন তুমি? সেই ভাগ্য নিয়ে তো জন্মাইনি! বেশ, ঘর বাঁধতে না চাও, নবদ্বীপে বিষ্ণুদামোদরের মন্দিরে বৈষ্ণবী হয়ে থাকো। তোমার এমন গানের গলা...পাষাণ গলে যায়! সেখানে থাকলে আমি অন্তত তোমাকে দিন-দুবেলা দেখতে তো আসতে পারবো।

তাহার পর কাল গত হইল। নবদ্বীপের বিষ্ণুমন্দিরে বৈষ্ণবী কনকলতা চোখ বুজিয়া তানপুরায় মাথা ঠেকাইয়া ভক্তিভরে গাহিতে লাগিলঃ

“সখি রে, কী পুছসি, অনুভব মোয়?

সোই পিরীতি অনুরাগ বাখানিতে তিলে তিলে নূতন হোয়।।

জনম অবধি হম রূপ নেহারনু, নয়ন না তিরপিত ভেল।

সোই মধুর বোল শ্রবণ হি শুননু, শ্রুতিপথে পরশ না গেল।।

কত মধু-যামিনী রভসে গোয়ায়নু, না বুঝনু কৈছন কেল।

লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখনু তবু হিয়ে জুড়ন না গেল।।”

ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে লোকটা সেই গান শুনছিল। গান শুনছিল, গান শুনছিল, সারা শরীর দিয়ে সে সেই গান শুনছিল।

“বইমেলার আগুনের কারণ একটি দায়িত্বজ্ঞান সিদ্ধান্ত”

এই যেমন এখন, তারও পাঁচ-ছশো বছর পর ট্রেনের কামরার মেঝেতে বসে নিজেরই গুনগুন করে গাওয়া গান সে শুনছে হাতে তাল রেখে। মাথায় সবুজ মাফলার পরা শীর্ণ কৃশকায় মানুষ, ঠোঁটের ফাঁকে দপদপ করে জ্বলে উঠছে বিড়ির আগুন। মেদিনীপুর লোকালের কামরার ভিতর ঠান্ডা ঠান্ডা পাগল বাতাস ভেসে আসছে হুহু করে। লোকটা গান গাইতে গাইতে চাদরের খুঁটে চোখ মুছল নাকি একবার? ওর তামাটে হয়ে যাওয়া পাতলা চুলের ভিতর ওলটপালট করছে কালের হাওয়া। নাহ্‌, লোকটা দিব্বি ভুলে গেছে সব; এখন তাহারে নাই মনে...নাই বা মনে থাকল আর!

মনের ভিতর কিন্তু খুঁজছিলাম, কনকচাঁপার কী হল? ধোঁয়া ধোঁয়া ছায়া, অনিয়ত জড়ীভূত আকার, বিচিত্র সংবেদনা, দৃশ্য-দৃশ্যান্তর... মরিয়মের ছেলে যোশুয়া, শচীনন্দন নিমাই, অচ্যুত, আরমানি বাই, কনকচাঁপা...নাহ্‌, কনকচাঁপাকে খুঁজে পাচ্ছি না তো কোথাও! সে কোথায় জানি চলে গেছে...কোন উদিসে...তার আর কোনো খবর নেই...খুঁজছি, কিন্তু পাচ্ছি না...

একটা ঝাঁকুনি খেয়ে তন্দ্রা ভেঙে গেল। আলো ঝলমলে খড়গপুর জংশন। সামনে তাকালাম। লোকটা কখন যেন নেমে গেছে।

এই কলামের সব লেখা একসঙ্গে পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে

dhula matir baul
Advertisment