ফরাসি দার্শনিক গি দেবর তাঁর সুবিখ্যাত 'স্পেকট্যাকলের সমাজ' নিবন্ধে বলেছিলেন সমাজ যখন পণ্যের দ্বারা আবদ্ধ হয় তখনই স্পেকট্যাকল রচনার মুহূর্ত। একটা না-বলা কথার ঘন যামিনীর থমকে থাকা সমুদ্রে, মৃত্তিকায়, ভালবাসা ছিল খিন্ন খঞ্জনার মত। এমন প্রেমিকার অধরোষ্ঠের বদলে টেলিভিশন পর্দায় জেগে থাকে বিজ্ঞাপিত রঙিন ঠোঁট। দিকবধূদের নিবিড় কেশদামে নরকের নবজাত মেঘে এখন কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়।
একদিকে দেখা যাচ্ছে এমন একটি নবীন মধ্যবিত্ত সমাজের উদ্ভব হয়েছে আমাদের দেশে যারা শহরায়নে অভ্যস্ত। কিন্তু মনে রাখতে হবে স্বাধীনতার পরে যদি সত্যজিৎ রায়ের সৌজন্যে যুবক অপূর্ব কুমার রায় বা জনপ্রিয় বাংলা ছবির নায়ক উত্তম কুমারের শহরে প্রবেশে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু এই ঘটনাসমূহ মোটেই সামাজিক ইতিহাসে অহল্যার শাপমোচন পর্ব নয়। বরং তার সত্তর বছর পরেও, উদারীকরণের পরেও দেখা যাচ্ছে প্রতীচ্যের সামাজিক রূপান্তর আমাদের এখানে সম্ভব হয়নি। আমাদের শহরের আকাশচুম্বন ও ফ্লাইওভার অনেক গ্রামকে গোপন রেখেছে। যাকে শহরের অন্ত্র বলা যায়, সেখানে গড়ে উঠেছে অনেক সম্প্রসারিত পল্লী বা অনভিপ্রেত শহর। এরা শহরের ভূতলবাসী, যা অনুন্নত দক্ষিণের জীবনকে পরিচালনা করে সেই সস্তা শ্রমশক্তি ও আধুনিকীকরণের পক্ষে প্রয়োজনীয় উচ্চাশা এই নামহীন নাগরিকেরা সরবরাহ করে। শহরের আলোকিত ও বিত্তশালী জীবনকে এদের জীবনচর্যা ও রুচি প্রায়ই নাগরিকদের অস্বস্তিতে ফেলে তবু এই অবৈধ ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না।
গল্প বলার অদলবদল
অম্লানকুসুম চক্রবর্তী ও শমীক গোষ তেমন দুজন মধ্য তিরিশের তরুণ লেখক যারা ছোটগল্পে পর্দা সরিয়ে একুশ শতককে দেখার চেষ্টা করেছেন। প্রথমে অম্লানের গল্প। এই তরুণ দৃশ্যের উপস্থাপনা চেয়েছেন। যেমন ডেলিভারি বয়ের গল্প, যেমন সেলফি প্রবণ বড় কর্তার উপাখ্যান। যেমন ভাগ্যের সঙ্গে ছলনা করা যায় যেমন রসিক বুদ্ধের হাসি। অম্লানের বিবরণ ঠিক শ্রমজীবীদের নিয়ে নয়। বরং ডিজিটাল যুগের উর্দি পরিহিত প্রাণীদের নিয়ে। তার ভাষাতেও তেমন ঝকঝকে একটা পরিচ্ছন্নতা আছে। কিন্তু ক্লান্তি নেই। যে প্রবণতা এই লেখকের তা মূলত সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু প্রায় খবরের কাগজের পাতায় চোখ রেখে গল্প বলার একটা মূল সমস্যা হল তাতে কান্নাটা যে গ্লিসারিনের তা বোঝা যায়। আলবিয়ার কামু যখন মার মৃত্যুমুহূর্ত বিস্মৃত হন তখন শতাব্দী জুড়ে জলোচ্ছ্বাস শুরু হয়। এমনকি সন্দীপনের মাতৃবন্দনাও আমাদের অন্যমনস্ক করে দেয় কিন্তু এই যুবক পিতৃশোক এক স্পষ্ট করে দেখতে পান মোবাইলের পর্দায় যে আমি বুঝতে পারি এখানে এক লহমার চমক। তার অনন্যা মুখোপাধ্যায়-শমীক ভট্টাচার্য-ঋষিকেশ তালুকদার টুইটার সুলভ নগরভ্রমণ যার ফরম্যাটিং আমাদের জানা। সন্দেহ নেই অম্লান যেসব নগরকুসুম সাজিয়েছে শব্দের ফুলদানিতে তা জরুরি ছিল। একটি নতুন অর্কিড প্রদর্শনী চট করে ঘুরে আসা যায় কিন্তু সাহিত্যপাঠ কি চটজলদি রাস্তায় যাওয়ার! তা বোধহয় না। লেখক তার দেখাকে দর্শনে রূপান্তরিত করেন। ফুলদানিটা অন্যদিকে রাখেন সে কারণেই আমরা অভিভূত হই পরিচিতের অপরিচয়ে। তবু অম্লান দ্রুততার সঙ্গে চিরকুটে ভরে দিয়েছেন বিপদ সংকেত আর সেহেতু ধন্যবাদ তাঁর প্রাপ্য।
অপরদিকে শমীক ঘোষ এই শাহরিকতার ফাঁকটুকু ধরতে চেয়েছেন কোনও ঘটমান বাস্তবতা আর সম্ভাব্য আখ্যান পাশাপাশি সাজিয়ে। শমীকের রচনার সারাংশ হল - গানটা লালনের। তবে এখন ব্যান্ডের হয়ে গিয়েছে। শমীকের প্রথম গল্প দূরবিন। সেখানে মানুষের স্থানাঙ্ক কীভাবে বদল হয় তা দেখাতে গিয়ে শমীক ফিরে এসেছেন ঐতিহ্যের শিকড়ে। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের আপাত তেপান্তরের মাঠ মুছে দিতে পারেনি রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর নাটকের মঞ্চায়ন। শমীক তুলনায় প্রথানিবিড়। দুটি প্রজন্মের গল্প বলার সময়ে যে নীল পিঁপড়ে হাতের তালুতে ঘুরে বেড়ায়, যে সমুদ্রবাতাস প্রৌঢ়ার চুল এলোমেলো করে দেয় তাতে এক লাবণ্য আছে। সেই সুন্দরটুকু শমীক হঠাৎ হারিয়েও ফেলতে চান না। তাঁর গদ্যও সেইরকম, খানিকটা অতিলৌকিক। যেমন, পেটোর খোল থেকে কালি তুলে সেজেছে আকাশ। কেউ যদি সমাজবহির্ভূতদের নিয়ে কথা বলার সময়ে কথনের আবহাওয়াটাই পালটে দিতে পারেন চিনে তুলি দিয়ে তবে তাঁর ক্ষমতা আছে, সে কথা মেনে নিতে আমাদের আপত্তি থাকে না। "তিন তিনটে বোমা শরীরে ফাটলেও, রক্ত ছিটে উঠে চাঁদের গায়ে লেগে যাবে।" এই খুনটির কিছুক্ষণ পরে যদি দেখি এমন বাক্য যে "ছিন্নভিন্ন কয়েকটা মেঘ, কবন্ধের মত উদ্দেশ্যহীন উড়ে যাচ্ছিল আকাশে"- আমাদের সহস্র সমর্থন তাতে থাকবেই। বলা যেতে পারে প্রতিবেদন রচয়িতা হিসেবে শমীক সফল। একজন পরিচালক যদি ভিউফাইন্ডারে অতীত দেখতে পান, তাঁর এই বদলে যাওয়া পড়তে ভালো লাগে কিন্তু প্রত্যাশিত। আসলে এলভিস ও অমলাসুন্দরী নামগল্পটি বা পুরো গল্পসংকলনটি বেশ নিপুণ সাক্ষী হয়ে থাকে কথনের। একটা শান্ত মফস্বলি দুনিয়া কীভাবে লন্ডনে খোঁয়াড়ি ভাঙছে সে আখ্যান শমীক লিখে গেছেন। এমব্রয়ডারির মত তাতে জুড়ে আছে কাব্য। দৃষ্টির পরম্পরা ভাগ করে দিয়েছে সিনেমার মত যোগচিহ্ন।
কলকাতার সাহিত্য উৎসব ও বকচ্ছপ বাংলা ভাষা
অম্লানকুসুম ও শমীক দুজনেই এমন একটা যুগের প্রতিনিধিত্ব করেন যা তুলসীতলা থেক ম্যানহাটনে পৌঁছে যাওয়ার আখ্যানে একটি হাইফেনচিহ্ন। এঁদের লেখায় সমতলীয় ভ্রমণবৃত্তান্ত আছে সুকথিত ও সুগ্রন্থিত। অথচ একটি অনিবার্য জেটল্যাগ এসে হস্তক্ষেপ করায় বাংলা গদ্যসাহিত্যের ঐশ্বর্য এঁদের চোখে পড়েনি। শুধু আখ্যানধর্ম পালন লেখকের কাজ নয়, রূপসীর কটাক্ষের অন্তরালে যে শিরা-উপশিরা তার দিকেও লেখককে তাকাতে হয়। নিছক সমকালীনতা একজন লেখককে আপডেটেড করতে পারে কিন্তু ঘটনাকে নতুন সত্যে উপস্থাপিত না করতে পারলে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় বা মতি নন্দী কোনওটাই হওয়া তত সহজ নয়। সন্দীপন ভাষা সৌকর্যে অদ্বিতীয়। কিন্তু তা তাঁর শেষপাড়ানির কড়ি হয়নি। কলকাতা শহরেও নির্জনে নিজেকে দেখা সম্ভব করেছিলেন বলেই তাঁর গল্প আজও জ্যান্ত হয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলতে পারে। আশা করি সময়দীপ্ত আমাদের এই দুই যুবাপুরুষ ক্রমেই প্রজন্মের তাৎক্ষণিক বালুরাশি ছাড়িয়ে জীবনের অনন্ত প্রবাহের দিকে তাকাবেন। দার্শনিকতা না থাকলে লেখা তো নেহাৎ বিবরণী!
আদম ইভ আর্কিমিডিস/ অম্লানকুসুম চক্রবর্তী/ দ্য কাফে টেবিল/ ১৭৫ টাকা
এলভিস ও অমলাসুন্দরী/ শমীক ঘোষ/ সোপান/ ১৭০ টাকা