গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমরা আলোচনা করছিলাম চিকিৎসা পরিষেবার দ্রুত মূল্যবৃদ্ধির নানা দিক নিয়ে। তার মধ্যে এসেছে বিমার কথা, সরকারের প্রত্যাশিত ও বাস্তব ভূমিকার পার্থক্যের কথা। এই আলোচনার একদম শুরুতে ছিল বিজ্ঞানের কথা, চিকিৎসার বৈজ্ঞানিক চরিত্রের কথা এবং (অ)মানবিকতার কথা। পরবর্তী পর্বগুলোতে অর্থনৈতিক প্রসঙ্গে আলোচনার স্বার্থে নৈতিক প্রশ্নটিকে মুলতুবি রাখতে হয়েছিল, যদিও দেখা যায় নীতি আর অর্থনীতি পরস্পর বিজড়িত প্রায়শই। আজ আবার সেদিকে ফিরে যাই একটু।
বিজ্ঞানের উপজীব্য সত্য। বাস্তবে সর্বদা তা নয়, কিন্তু অন্তত তাত্ত্বিক ও নীতিগতভাবে বিজ্ঞানের একমাত্র ঈশ্বর 'সত্য'। তাত্ত্বিকভাবে সেই সত্য হল ব্যক্তি নিরপেক্ষ এবং নিরাবেগ, নির্লিপ্ত। পদার্থবিদ্যায় যেকোনো ঘটনার বিচারে রেফারেন্স ফ্রেমের কথা বলা আছে বটে, কিন্তু সেই ফ্রেমে অবস্থান বা স্থানাঙ্ক গুরুত্বপূর্ণ, ব্যক্তির দেখার চোখ বা অনুভূতি নয়। সুতরাং এই রেফারেন্স ফ্রেম ব্যাপারটাও নৈব্যক্তিক। দ্রষ্টার অবস্থানের তারতম্য অনুসারে দৃশ্য বস্তু বা ঘটমানতার (বা তার অনুধাবনের) যে পরিবর্তনের কথা পদার্থবিদ্যা বলে, তা Standpoint epistemology বা situated knowledge জাতীয় ধারণার থেকে আলাদা, কারণ এই ধারণার মধ্যে ব্যক্তিগত অনুভূতির স্থান আছে, যা বিজ্ঞানের দরবারে নেই। বিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য হিসেবে যা চিহ্নিত বা বিজ্ঞানের যে ধারণাকে ধ্রুব ধরে নিয়ে আমরা বিজ্ঞান শিখেছি, তাতে এই বস্তুপরতান্ত্রিকতা (objectivity) তার নির্মাণ, অস্তিত্বরক্ষা ও অগ্রগতির জন্য জরুরি। যখন অন্য সব কথা ভুলে বিজ্ঞান পড়ার বা গবেষণার চেষ্টা করি, তখন আমরাও (আমিও) এই অবজেক্টিভিটিকেই প্রাণপণে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করি, অন্তত তার যথাসম্ভব কাছাকাছি পৌঁছতে চাই।
কেজরিওয়ালের রণকৌশলের দিকে কেন তাকিয়ে গোটা দেশ?
চিকিৎসা-বিদ্যা যখন চিকিৎসা বিজ্ঞানের রূপ নেয়, তখন বিজ্ঞানের এই নিরাবেগ অবজেক্টিভ চরিত্রটিকে বিনা পরিবর্তনে চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করার কাজে ব্রতী হয়। এখানেই সমস্যার সূত্রপাত৷ চিকিৎসা পরিষেবা যাদের জন্য, তাঁরা জীবিত ও চেতন পদার্থ। তাঁদের অনুভূতি আছে, নিজস্ব পূর্ব অভিজ্ঞতা, ধ্যান-ধারণা, সংশয়, আতঙ্ক, ঈপ্সা, সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা আছে। সেই কারণে প্রতিটি অসুস্থতা, যন্ত্রণা এবং চিকিৎসা সম্বন্ধে বিভিন্ন ব্যক্তির perception এবং apperception আলাদা। অতএব একটি নির্দিষ্ট অসুখ, জীবনে তার অভিঘাত, তার চিকিৎসার পদ্ধতি, চিকিৎসা প্রাপ্তির সময়ের অভিজ্ঞতা ইত্যাদি বিষয়ে একজন ব্যক্তির (রোগীর) যে অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান সৃষ্ট ও সঞ্চিত হয়, তা আবশ্যিকভাবে "সিচুয়েটেড নলেজ", নৈব্যক্তিক নির্লিপ্ত জ্ঞান নয়।
চিকিৎসা পরিষেবা প্রদানকারী যদি আপন অবজেক্টিভিটির অহংকারে বিভোর হয়ে সেই সিচুয়েটেড নলেজকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে উদ্যোগী হন, তাহলে সংঘাত অনিবার্য। দুর্ভাগ্যক্রমে চিকিৎসা ক্রমশ সেই পথেই এগোচ্ছে এবং সংঘাতও উত্তরোত্তর বাড়ছে। এভাবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্ভব কিন্তু চিকিৎসা পরিষেবার নয়। এই পদ্ধতিতে যে পরিষেবা দেওয়া সম্ভব, তা পরিষেবাদাতার পছন্দ বা দর্শনের অনুসারী, গ্রহিতার আশা-আকাঙ্ক্ষা সেখানে হারিয়ে যায় বা যাবে। অথচ পরিষেবা তো গ্রহিতার (এক্ষেত্রে রোগীর) জন্য। তাহলে এজাতীয় পরিষেবায় অবজেক্টিভ ফলাফল যেমনই হোক না কেন, গ্রহিতার তৃপ্তি হবে কি?
বিষয়টা কেন সমস্যাজনক, তা একটু অন্যভাবে বোঝা যাক। তার জন্য "অসুখ" শব্দটিকে বিশ্লেষণ করতে হবে। অ-সুখ মানে সুখের অভাব বা অনুপস্থিতি, অর্থাৎ ক্লেশ। ইংরেজি "disease" শব্দটির অর্থও "dis-ease" বা অস্বস্তি। রোগক্লিষ্ট মানুষ চিকিৎসকের কাছে আসেন অসুখ সারাতে বা উপশম পেতে, স্রেফ একটি নির্দিষ্ট ডায়াগনোসিস পাবার লোভে বা একটি নির্দিষ্ট রোগ-প্রক্রিয়ার (pathogenesis) প্রতিকারের জন্যও নয়। ডায়াগনোসিস এবং প্যাথজেনেসিস আবিষ্কার চিকিৎসকের দায়। তিনি সেই প্রক্রিয়াতেই রোগ সারানোর কাজটি করেন। রোগ সারানো (বা কমানো) অবশ্যই জরুরি, কিন্তু তা অসুখ সারানোর (বা তার উপসম করার) একটি অংশমাত্র।
রাজনীতিতে দলবদল: সোমনাথ চ্যাটার্জি থেকে বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়দের ভূমিকা
অসুখের শুশ্রূষা না হলে রোগীর কষ্ট কমে না। চিকিৎসার অভিমুখ নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাই রোগীর দ্বারা অনুভূত ক্লেশকে গুরুত্ব দেওয়া কর্তব্য। তাকে গুরুত্ব দিতে গেলে রোগীকে সমগ্র মানুষ হিসেবে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্তর্লীন "রিডাকশনিস্ট" চরিত্র সেই পথে মস্ত বাধা। এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা পরে আলোচনা করব। আজ এই পটভূমিতে বলা যাক যন্ত্র চিকিৎসকের কথা।
চিকিৎসায় আজকাল যন্ত্রের ব্যবহার প্রচুর পরিমাণে হলেও এখন পর্যন্ত চিকিৎসক একজন মানুষ এবং যন্ত্র কাজ করে মানব চিকিৎসকের আজ্ঞায়। চিকিৎসার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতাটুকু এখন পর্যন্ত মানুষের হাতেই আছে। সিদ্ধান্ত যার, নিয়ন্ত্রণ শেষ অব্দি তার। মানুষের হাতে চিকিৎসার নিয়ন্ত্রণ বা সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা থাকা তো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। এ কথা ফলাও করে বলার কী আছে? একটু ভাবলেই কিন্তু দেখা যাবে যে এই স্বাভাবিক ব্যাপারটা আধুনিক বিজ্ঞানের স্বভাবের সঙ্গে খাপ খায় না৷ ঠিক যে কারণে রোগীর সামগ্রিক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বা সিচুয়েটেড নলেজ নিয়ে স্বচ্ছন্দ নয় আমাদের বিজ্ঞান, সেই কারণেই চিকিৎসকের হাতে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েও সে খুশি নয়।
অসুখের subjectivity-র ওপরে রোগের objectivity-কে প্রতিষ্ঠা করাতেই চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাফল্য, চিকিৎসা পরিষেবার ওপর তার প্রভাব যেমনই হোক না কেন। এই অবজেক্টিভিটির সন্ধানে মানুষ চিকিৎসকের চেয়ে যন্ত্র অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য৷ সবচেয়ে বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষের পক্ষে শতকরা একশভাগ বস্তুনিষ্ঠ (objective) হওয়া সম্ভব নয়। বিজ্ঞানের দিক থেকে এ নিয়ে বিস্তর সমস্যা আছে। সম্পূর্ণ অবজেক্টিভ না হলে বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় নিখুঁত হওয়া যায় না। নিখুঁত না হয়ে যতটুকু সফল হওয়া যায়, তা নেহাতই তুলনামূলক সাফল্য, পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো। সাধারণ মানুষ সাধারণত এতে মোটামুটি খুশি থাকে, কিন্তু বিজ্ঞানের চাই ষোলো আনা৷ একবিংশ শতকের ছেলেমেয়েরা যেমন মাধ্যমিকে একশয় একশ না পেলেই নিজেদের ব্যর্থ বলে ভাবতে শিখছে, তেমনই বিজ্ঞানও নিখুঁত না হতে পারলে অস্বস্তিতে ছটফট করে। এটাই বিজ্ঞানের মহত্ব ও সৌন্দর্য, আবার এটাই বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা।
ছাপা বই বনাম পিডিএফ, বাংলার হাল ও হকিকৎ
বিজ্ঞানের যত অগ্রগতি হচ্ছে ততই চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নেবার বিষয়ে চিকিৎসকের স্বাধীন বিচরণক্ষেত্রটি সংকুচিত হয়ে আসছে। কোন পর্যায়ে ঠিক কোন কোন নিয়ম মেনে চিকিৎসককে কোন পথে কতটা এগোতে হবে, তার অনেকটাই এখন বলে দেওয়া থাকে। পাঁচ দশক আগের চিকিৎসকদের থেকে আজকের চিকিৎসকেরা তাই এক অর্থে ভাগ্যবান, কারণ আগের চিকিৎসকেরা এত তথ্যসম্ভারের সুবিধা পাননি। আবার এত বলে দেওয়া ছকা পথে এগোতে এগোতে যখন কাজের কাজ হয় না, তখন আজকের চিকিৎসক পড়েন ফাঁপড়ে, কারণ সেই পরিস্থিতিতে নিজের ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের (instinct বা gut feelings) নির্দেশে চলতে হয় চিকিৎসককে, এদিকে সব বিষয়ে অতিরিক্ত নিয়ম বেঁধে দিতে দিতে চিকিসকের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়টির উপর বস্তুত কার্ফু জারি করা হয়েছে। আজকের চিকিৎসকেরা তাই ততটা ভাগ্যবানও নন, যতটা দাবি করে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞাপন।
রোগীর অসুখ সম্বন্ধে কী কী তথ্য সংগ্রহ করতে হবে, কী কী পরীক্ষা করাতে হবে, কোন কোন বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে কীভাবে ডায়াগনোসিসে পৌঁছাতে হবে, সব বলে দেওয়া আছে। ডায়াগ্নোসিস ঠিক কী ভাষায় লিখতে হবে, তাও নির্দিষ্ট, এমনকি তার কোড নম্বরও আছে। এরপর কোন ডায়াগনোসিসের ভিত্তিতে কোন ওষুধ কত মাত্রায় কত দিনের জন্য দেওয়া বিজ্ঞানসম্মত, তাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট। হেরফের করতে বুকের পাটা লাগে, কারণ চিকিৎসক যা ভেবে হেরফের করলেন, আদালত তা বুঝতে পারেন না, শুধু দেখেন বইয়ের সঙ্গে মিলছে কিনা। কোন ওষুধের পক্ষে যথেষ্ট "এভিডেন্স" নেই, তাও জানা। ব্যক্তিবিশেষের জন্য তাকে ফলপ্রদ মনে হলেও তা ব্যবহার করা কঠিন। কোন অসুখ থেকে কী কী জটিলতা সৃষ্টি হওয়া সম্ভব, কতদিন বাঁচবেন রোগী, তাও গুনে দেখা হয়েছে। কোন ওষুধ (বা অস্ত্রোপচার) প্রয়োগ করলে কতটা শতাংশ সাফল্যের সম্ভাবনা এবং কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবার কত শতাংশ সম্ভাবনা, তাও হিসেব করা আছে দশমিকের ঘর অব্দি।
কী করে এই ভগ্নাংশ অব্দি নিশ্চিত হওয়া গেল এবং কী করে তা সব মানুষের ক্ষেত্রে একইভাবে প্রযোজ্য হবে, তা নিয়ে আমরা নিশ্চিত নই, কিন্তু আজকের চিকিৎসকের দায়িত্ব হল এই সংখ্যাগুলো মুখস্থ করা এবং ল্যাপটপ খুলে এসব সংখ্যাতত্ত্ব রোগী ও রোগীর পরিজনকে দেখানো, যাতে তাঁরাও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত অনুমতি দিতে পারেন। অজস্র সংখ্যার অভিঘাতে রোগী ও পরিজনদের বিভ্রান্ত হতে দেখি প্রায়শই, কিন্তু বিজ্ঞান এভাবেই কথা বলে। গণিতই প্রকৃতির ভাষা।
এক শতাব্দী আগে ভ্লাদিমির লেনিনের "হোয়াট ইজ টু বি ডান" লেখার মধ্যে যে স্থির নৈশ্চিত্যের ভাব ছিল, তা দেখা যায় আধুনিক চিকিৎসার এসব নিদানের মধ্যে। নিশ্চিত হতে চাওয়া "মডার্নিজম"-এর লক্ষণ। বাস্তবে আমরা দেখি যে সব রোগী ও রোগের ক্ষেত্রে নিশ্চিত হওয়া অভিপ্রেত নয়। এসব কথা বলা এবং লেখাও হয়েছে চিকিৎসকদের তরফে। তারপর আরও জটিল অংকের সাহায্যে নতুন পদ্ধতিতে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে। রোগলক্ষণ বা পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ, ডায়াগ্নোসিস বা রোগীর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সঠিকভাবে বলার জন্য বিভিন্ন কম্পিউটার ভিত্তিক অ্যালগরিদম তৈরি হচ্ছে। এজাতীয় গবেষণায় আমি নিজেও যুক্ত থেকেছি।
দেখা গেছে কিছু ক্ষেত্রে এই অ্যালগরিদমগুলো গড়ে চিকিৎসকদের চেয়ে বেশি নির্ভুল উত্তর দেয়, কারণ তারা নির্ভুলভাবে অবজেক্টিভ। আরও উন্নত অ্যালগরিদম তৈরি করলে আরও জটিল বিষয়ে সঠিক কথা বলতে পারবে তারা বস্তুনিষ্ঠভাবে। এই কাজ সফলভাবে করার জন্য সব বড় হাসপাতালে সব রোগীর ব্যবস্থাপত্র ও যাবতীয় চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য কম্পিউটারজাত করা বাধ্যতামূলক হচ্ছে। এই বিপুল পরিমাণ তথ্য হাতে পেলে গুগল বা সমমানের তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলো আরও নিখুঁত অ্যালগরিদম তৈরি করতে পারবে। চিকিৎসার উন্নতির স্বার্থে এই কাজ গুরুত্বপূর্ণ।
এই উন্নতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কথা উঠছে যে তাহলে চিকিৎসকের আর প্রয়োজন কী? ক্লিনিক্যাল মেডিসিনকে তো পিছনের সারিতে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, যন্ত্রভিত্তিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাকেই বেশি বৈজ্ঞানিক বলে প্রমাণ করা গেছে। এবার সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা এবার অজস্র অ্যালগরিদম সম্বৃদ্ধ যন্ত্রের হাতে ছেড়ে দিলেই ষোলকলা পূর্ণ হয়। ওষুধপত্র যন্ত্রই লিখে দিতে পারে নিজের ডেটাবেস থেকে নির্দিষ্ট ছক মেনে। অস্ত্রোপচারেও রোবো চিকিৎসক ক্রমশ উন্নতি করছে, যদিও এখনো তাকে নিয়ন্ত্রণ করে মানুষ। কিছু ক্ষেত্রে হয়ত আরও কিছুদিন মানুষ চিকিৎসককে প্রয়োজন হবে, কিন্তু ক্রমশ ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায় যন্ত্রের হাতে। কেন নয়? সায়েন্স হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়।
এই হস্তান্তরকে আমি বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল মনে করি না। আজ না হলেও পঞ্চাশ বছরের মধ্যে এটা বাস্তবে সম্ভব হবে। চিকিৎসা যদি বিশুদ্ধ বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞান বলে বিবেচিত হয়, তাহলে এটা হওয়াই হবে যুক্তিসঙ্গত। চিকিৎসার "healing art" চরিত্রটি হারিয়ে যাবে অবশ্য, কিন্তু বিজ্ঞানের চোখে তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। শিক্ষিত রোগীরাও অনেকেই যন্ত্রের উপর বেশি ভরসা করার জন্য তৈরি মনে মনে। নিজেদের যাবতীয় সাবজেক্টিভিটি বিসর্জন দিয়ে অবজেক্ট হয়ে ওঠার জন্যও তাঁদের তৈরি হতে হবে।
ধনতন্ত্রের দৃষ্টিতেও চিকিৎসক একটি আপদ। তাকে বিদায় করতে পারলে মন্দ হয় না। চিকিৎসককে যে মাইনে দিতে হয়, সেটার জন্য ততটা সমস্যা হয় না মুনাফা বৃদ্ধিতে, যতটা হয় চিকিৎসকের স্বাধীন চেতন সত্তার কারণে। বাজারের অবজেক্টিভ মূল্যবোধ এবং প্রতিমুহূর্তে বৃদ্ধির প্রবণতা চিকিৎসকের উপস্থিতি নিয়ে সমস্যায় পড়ে। স্বাস্থ্য পরিষেবায় বিনিয়োগকারী এবং মুনাফার মাঝখানে দাঁড়িয়ে যে "নেসেসারি ইভল", তার নাম চিকিৎসক। হাসপাতালের মালিকপক্ষ তাকে কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ করেছে মুনাফা বৃদ্ধি করার জন্য। মালিকের এজেন্ট হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব এবং মুনাফা এনে দিতে না পারার ফলাফল সম্বন্ধে আজকাল কর্পোরেট হাসপাতালের বেশিরভাগ চিকিৎসক সচেতন, তবু তাঁরা কোনোদিনই যন্ত্রোচিত মতো এই কাজটি করে উঠতে পারবেন না।
রোগী তাঁর সঙ্গে রোগ ছাড়াও নিয়ে আসেন সুখ-দুঃখ, অভাব-অনটন, পারিবারিক বা সামাজিক সমস্যা, স্বপ্ন, আতঙ্ক ইত্যাদির এক বিশাল বস্তা। সেই বস্তাটি তিনি চিকিৎসকের কাঁধে রেখে দু'দণ্ড জিরোতে চান। অধিকাংশ চিকিৎসক (এমনকি তথাকথিত "কমার্শিয়াল" ডাক্তারেরাও) রোগীর সাবজেক্টিভিটির দ্বারা প্রভাবিত হন এবং অনেকেই অজান্তে রোগীর আবেগের বস্তাটি নিজের কাঁধে নিয়ে ফেলেন। তাঁদের চিকিৎসা সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত এসব অবৈজ্ঞানিক আবেগের দ্বারা প্রভাবিত হয়। দুর্বল মুহূর্তে কিছু বাজার-বিরুদ্ধ প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেলেন তাঁরা। উপরন্তু হাসপাতালের অচিকিৎসক কর্মচারীদের মধ্যবিত্ত মূল্যবোধকে কাজে লাগিয়ে প্রায়শ রোগীকে এমন কিছু সুবিধা পাইয়ে দেন, যাতে হাসপাতালের মুনাফা কমে। একাজ করে ব্যক্তি মালিককে ফাঁকি দেওয়া যায়, কিন্তু বাজারের চোখ সদাজাগ্রত।
চিকিৎসকের বদলে বুদ্ধিমান যন্ত্র যদি কাজে নামে, তবে সে হবে সম্পূর্ণ মালিকের ইচ্ছাধীন। নির্ভুল বস্তুনিষ্ঠতায় সে সাজিয়ে দেবে সংখ্যাতত্ত্বের ডালা আর বলবে ঠিক সেইসব কথা, যা বিজ্ঞান ও বিনিয়োগকারী তাকে শিখিয়ে দেবে। না, সে মিথ্যে বলবে না। বিজ্ঞান স্পষ্ট মিথ্যাকে প্রশ্রয় দেয় না। যন্ত্র সত্যই বলবে, বিশুদ্ধ অবজেক্টিভ সত্য, যা মালিকের ইচ্ছা আর আইনগত বাধ্যবাধকতার দ্বারা প্রভাবিত হবে (অ্যালগরিদম নির্মাণের সময়ে), কিন্তু আপনার সাবজেক্টিভ অনুভূতির দ্বারা নয়। আর হ্যাঁ, যন্ত্রচিকিৎসক মানুষের চেয়েও ধারাবাহিকভাবে ভদ্র ও মিষ্টভাষী হবে, কিন্তু সেই মিষ্টতার মধ্যে সমমর্মিতা খুঁজবেন না।
এই কলামের গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলি পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে