ভারতের বর্তমান সরকার একটি রেকর্ড গঠন করেছে। এক মাসের কম সময়ে দেশের তিনটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের উপর নির্মম আক্রমণ নামিয়ে আনার নজির পৃথিবীর আর কোনো দেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় এবং ছাত্রছাত্রীদের আক্রমণ করার নিরিখে মোদী সরকার নিশ্চিতভাবেই শিক্ষা-তর্ক-আলোচনা বিরোধী জগতসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করেছে। আক্রমণের দৃশ্যপটগুলি সবার জানা, তাও এই নিবন্ধের প্রয়োজনে একবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক।
দৃশ্যপট ১: জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় - ১৫ ডিসেম্বর জামিয়া মিলিয়া সংলগ্ন অঞ্চলে একটি বিক্ষোভ হিংসাত্মক হয়ে ওঠার অভিযোগে দিল্লি পুলিশ জামিয়া কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়েই, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ঢুকে ছাত্রছাত্রীদের উপর যথেচ্ছ আক্রমণ চালায়। এমনকি পাঠাগারে ঢুকে লাঠিপেটা করা হয়, কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া হয়। প্রাচীন কালে আলেক্সান্দ্রিয়া শহরের মহান পাঠাগার জ্বালিয়ে দেওয়ার ইতিহাস আমরা শুনেছি। এবার স্বচক্ষে দেখলাম স্বাধীন ভারতে পাঠাগারের ভিতর পাঠরত পড়ুয়াদের উপর নৃশংস রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস।
দৃশ্যপট ২: আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় - ১৫ ডিসেম্বর রাতে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের উপর নৃশংস আক্রমণ চালায়। লাঠি, কাঁদানে গ্যাসের সঙ্গে আলিগড়ের ছাত্রদের উপর রাবার বুলেট, ছররা বন্দুক ইত্যাদি প্রয়োগ করা হয়। এমনকি ছাত্রদের হোস্টেলের ঘরে ঢুকে তার ভিতরে কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটানো হয়। ভিডিওতে আমরা অনেকেই দেখেছি কীভাবে পুলিশ ক্যাম্পাসের প্রধান দরজা ভেঙে ভিতরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। অসংখ্য ছাত্রছাত্রী আহত হন, বেশ কয়েকজনকে ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটে ভর্তি করতে হয়।
দৃ্শ্যপট ৩: জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় - ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যেবেলা কিছু মুখোশ পরা দুষ্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে ঢুকে ছাত্রীদের হোস্টেল, শিক্ষকদের বাড়িতে ভাঙচুর চালায়। মেরে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদের সভানেত্রীর এবং একজন শিক্ষিকার, ঘায়েল হন আরও অনেক ছাত্র-ছাত্রী। সমস্ত ঘটনা পুলিশ জানত। কিন্তু তারা গেটের বাইরে নির্বিকার চিত্তে দাঁড়িয়ে থাকে এবং যাতে হিন্দুত্ববাদী দুষ্কৃতিরা অবাধে বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাস চালিয়ে যেতে পারে তা নিশ্চিত করে।
আরও পড়ুন: অমিত শাহর সামনে সিএএ-বিরোধী ব্যানার, বাড়ি থেকে উচ্ছেদ দুই মহিলা
হিন্দুত্ববাদী দুষ্কৃতিদের কাজ শেষ হলে তারা বীরদর্পে লাঠি দোলাতে দোলাতে ভৃত্যসম দিল্লি পুলিশের সামনে দিয়ে চলে যায়। মালিক-অমিত শাহের বাধ্য কুকুরের মতই দিল্লি পুলিশ ল্যাজ নেড়ে, একপাশে সরে দাঁড়িয়ে মালিকের দামাল ছেলেদের ‘সেফ প্যাসেজ’ দিয়ে দেয়। এই দিল্লি পুলিশই আবার জামিয়াতে ছাত্রদের অপরাধীদের মত হাত উপরে তুলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে বাধ্য করে, কারণ মালিক তখন তাদের বলেছিলেন জামিয়ার ‘দেশদ্রোহী’-দের দেখলেই তাদের যত্ন করে পালিশ করা দাঁত ও নখগুলিকে শ্বাপদের মতন বের করে দেখাতে।
এই ঘটনা পরম্পরাগুলি অনেকগুলি প্রশ্নের জন্ম দেয়। প্রথম, কেন ছাত্রছাত্রী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে সরকার এক প্রকার যুদ্ধ ঘোষণা করেছে? এই যুদ্ধ বিগত এক মাসে শুরু হয়নি। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মোদী সরকার একের পর এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আক্রমণ চালিয়েছে। পুণে শহরে এফটিআইআই, হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর, প্রেসিডেন্সি হয়ে এই আক্রমণের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে জেএনইউ, যখন কানহাইয়া কুমারকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
এই যুদ্ধ ঘোষণার দুটি কারণ রয়েছে বলে আমার মনে হয়। একদিকে আরএসএস-বিজেপি’র মতন ফ্যাসিস্ট শক্তিরা স্বাভাবিকভাবেই পড়াশোনা অধ্যয়ন, মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে যুগ যুগ ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কারণ শিক্ষা মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখায়, ধর্মীয় সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে শাশ্বত মানবের সন্ধান করার দিকে ধাবিত করে শিক্ষার্থীদের।
আরও পড়ুন: জেএনইউ-এর আন্দোলনকারী পড়ুয়াদের পাশে বলিউড ডিভা দীপিকা
আরএসএস-এর বিশ্বদর্শনে এই সব বড়ো বড়ো কথার কোনও স্থান নেই। স্থূলভাবে তারা বোঝাতে চায়, দেশের শত্রু আসলে মুসলমানরা, তাই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাই দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ, ফৈজ, মির্জা গালিব, নজরুল, প্রেমচাঁদ, ইত্যাদির লেখা পড়লে, ভারতের সংবিধান ও সমাজকে অনুধাবন করলে বোঝা যায় যে আসলে আরএসএস-এর মুসলমান বিরোধী তর্কটি সাম্প্রদায়িকতার মূর্খামি ছাড়া আর কিছু নয়।
তাই পড়াশোনার প্রতি আরএসএস-এর তীব্র বিতৃষ্ণা। তাদের মনের মতো কথা না বললে তারা পাঠাগার ভাঙচুর করে, জগৎবিখ্যাত শিল্পীর ছবি নষ্ট করতে বা সিনেমা হলে ভাঙচুর করার আগে একটুও ভাবে না। পড়াশোনা করলে মানুষ এই বর্বরতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। তাই ভারতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির উপর এত রাগ। বিশেষ করে যে প্রতিষ্ঠানগুলিতে ছাত্র আন্দোলনের ঐতিহ্য রয়েছে বা একটি প্রতিবাদী পরম্পরা রয়েছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিই তাদের প্রধান টার্গেট।
কিন্তু আরএসএস-এর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি আজন্মলালিত ঘৃণার পরেও বর্তমান ভারতের পরিস্থিতির নিরিখে সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর বিচার করতে হবে। ২০১৯ সালের নির্বাচনী প্রচারের সময় মোদী এই মিথটি নিজের হাতেই ভেঙে ফেলেন যে তিনি উন্নয়নের কাণ্ডারী। সমস্ত প্রচার কেন্দ্রীভূত হয় জাতীয়তাবাদ, পাকিস্তান, অনুপ্রবেশকারী, তিন তালাক ইত্যাদি প্রশ্নে। তারপরে বিপুল জয় পায় বিজেপি। এই জয়ের পরে বিরোধীরা ছন্নছাড়া, রাহুল গান্ধী কংগ্রেসের নেতৃত্ব থেকে সরে গিয়ে প্রায়ই অজ্ঞাতবাসে চলে যাচ্ছেন, বামেরা আরও দুর্বল, বাকি সমস্ত বিরোধী দল হয় দুর্বল অথবা বিজেপি-র আশীর্বাদধন্য।
একদিকে উন্নয়ন নয়, বিভেদমূলক হিন্দুত্ব অ্যাজেণ্ডাতেই তাঁরা ভোট পেয়েছেন, অন্যদিকে বিরোধীরা কোণঠাসা বললেও সবটা বলা হয় না, বিরোধী রাজনীতি ভারতের মানচিত্র থেকে প্রায় গায়েব। বিজেপি ভাবল, তাদের হিন্দুত্বের প্রকল্পকে বাস্তবায়িত করার এমন সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। অতএব, ৩৭০ ধারা বাতিল, তিন তালাক আইন, বাবরি মসজিদের জমি হিন্দুদের দিয়ে দেওয়ার সুপ্রিম কোর্টের ভ্রান্ত রায়, সবই বিজেপির হিন্দুত্ব অ্যাজেণ্ডাকে মজবুত করল।
আরও পড়ুন: সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঠ করলেন আইনজীবীরা
এরপর সরকার ভাবল, এবারে মোক্ষম চালটি চালা যাক - নাগরিকত্ব আইন এবং এনআরসি, যার মাধ্যমে সরাসরি মুসলমান সমাজের মানুষদের বলা হলো, তোমরা ঠিক ততটা ভারতীয় নও, তোমরা আমাদের কাছে অবাঞ্ছিত। বিজেপি ভেবেছিল, বিরোধীরা নিশ্চিহ্ন, হিন্দুরা আবেগমথিত, অতএব হিন্দুত্বের অশ্বমেধের ঘোড়া থামাবে কে? বিজেপি ভেবেছিল, কাশ্মীর বা বাবরি মসজিদের রায়ের পরে যেমন কোনও প্রতিবাদ হয়নি, এবারেও তা হবে, কোনও প্রতিবাদ হবে না।
কিন্তু তা না হওয়ার প্রধান কারণ ভারতের ছাত্রসমাজ। শুধু জামিয়া-আলিগড়-জেএনইউ-যাদবপুর-হায়দ্রাবাদ-প্রেসিডেন্সি নয়। রাস্তায় নেমেছে আইআইটি-আইআইএম-আইআইএসসি’র মতন তথাকথিত 'এলিট' প্রতিষ্ঠান। হাজার হাজার ছাত্র-যুব ধর্মের উর্ধ্বে উঠে সমস্বরে প্রতিবাদ জানায় নাগরিকত্ব আইন এবং এনআরসি’র বিরুদ্ধে। দৃপ্ত স্বরে ঘোষণা করে যে ভারতের সংবিধানে রচিত ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্যের ধারণাকে তারা গুঁড়িয়ে যেতে দেবে না, মনপ্রাণ দিয়ে রক্ষা করবে।
মোদী ভারতের যুবসমাজের সঙ্গে বহু কথাবার্তা চালিয়েছেন, মিডিয়া প্রচার করেছে যে মোদী নাকি কমবয়সীদের কাছে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য নেতা। কিন্তু ছাত্ররা রাস্তায় নেমে সেই ভুল ভেঙে দিয়েছে। তারা বলছে, সরকারের স্বৈরাচার ও মেরুকরণের রাজনীতির বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়ে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলে তারা ভারতের সংবিধানকে বাঁচাবে। মোদী-শাহের হিন্দুত্বের অ্যাজেন্ডা ভারতের মাটিতে বাস্তবায়িত হওয়ার অন্যতম প্রধান অন্তরায় বর্তমান ছাত্রসমাজ। তাই তাদের মেরে, ভয় দেখিয়ে, ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্যই একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ে নেমে আসছে রাষ্ট্রীয় আক্রমণ - কখনও সরাসরি পুলিশের মাধ্যমে, কখনও শাসকদলের গুণ্ডাবাহিনির মাধ্যমে।
আরও পড়ুন: জেএনইউ হামলার জের, কমিটি ছাড়লেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
ছাত্ররা এরকম স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নামল কেন? এর অনেকগুলি কারণ রয়েছে। প্রথমত, শত দুর্বলতা সত্ত্বেও ভারতের সরকারী শিক্ষাব্যবস্থা এখনও মানুষের কাছে যে বিশ্বদর্শন তুলে ধরে, তার ভিত্তি ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্য। ছাত্ররা তাদের পাঠক্রম থেকেই শিখেছে যে ধর্মের ভিত্তিতে রাজনীতি দেশকে রসাতলে নিয়ে যাবে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিক্ষার উপর লাগাতার আক্রমণ। স্কলারশিপ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফি-বৃদ্ধি হয়েছে, গবেষণায় সরকারী অনুদান বন্ধের মুখে, শিক্ষায় সরকারী খরচ জিডিপি-র অনুপাতে লাগাতার কমছে।
তদুপরি, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নিম্নগামী, চাকরি নেই, বেকারত্ব গত ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ, আর্থিক বৃদ্ধির হার তলানিতে এসে ঠেকেছে, অথচ মূল্যবৃদ্ধি হয়েই চলেছে। এই অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে শিক্ষাগ্রহণের পরে কর্মসংস্থান হওয়ার কোনো নিশ্চয়তা ছাত্ররা পাচ্ছে না। উল্টে তারা দেখছে যে শিক্ষা-কর্মসংস্থান-মূল্যবৃদ্ধি-মন্দা নিয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই। মোদী-শাহ বেশি ব্যস্ত দেশের মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে, হিন্দু-মুসলিম বিভেদ তৈরি করতে। এই সর্বব্যাপী আক্রমণের মধ্যে ছাত্ররা আর স্থির হয়ে বসে থাকতে রাজি নয়, তাই আজ তারা রাস্তায়।
অন্যদিকে, বিরোধী দলগুলির উপরেও তাদের খুব ভরসা নেই। তাই ভারত জুড়ে দলীয় পতাকাবিহীন মিছিলের ভিড়, যেখানে উড়ছে শুধু জাতীয় পতাকা। অভিনব প্রতিবাদে জাতীয়তাবাদের মৌরসীপাট্টা সংঘ পরিবারের হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য গাওয়া হচ্ছে জাতীয় সঙ্গীত, পঠিত হচ্ছে সংবিধানের প্রস্তাবনা, গাওয়া হচ্ছে দেশাত্মবোধক গান এবং ফৈজের বিখ্যাত গজল, আজাদী-র স্লোগান এখন প্রতিবাদীদের মুখে মুখে। বর্তমান প্রজন্মের পড়ুয়ারা ভারতের মাটিতে একুশ শতকের প্রতিবাদের নতুন ভাষা ও পদ্ধতি নির্মাণ করে চলেছে। সেই প্রতিবাদে সামিল সর্বস্তরের মানুষ, দেশ যেন আবার তার প্রতিবাদী আত্মার সন্ধান পেয়েছে।
আরও পড়ুন: জেএনইউকাণ্ড: হোয়াটসঅ্যাপই কি মুখোশ খুলল এবিভিপির?
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলন এই সম্মিলিত প্রতিবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রস্থল। একদিকে নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসি-র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, অন্যদিকে শিক্ষার বেসরকারীকরণ ও ফি-বৃদ্ধির বিরুদ্ধে তারা নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সরকার ও জেএনইউ প্রশাসন ছাত্রদের কথা শুনতে নারাজ। তাই তাদের উচিত শিক্ষা দিতে হবে। অতএব পাঠাও হিন্দুত্ববাদী গুণ্ডা, পাঠাও পুলিশ, ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করে দাও প্রতিবাদী স্বরগুলিকে।
সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যেও জেএনইউ-র ছাত্রসমাজ অদম্য উদ্যম ও সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলা করে চলেছে সরকার ও তাদের গুণ্ডাবাহিনীর। মাথায় রডের আঘাতে ১৬টি সেলাই লাগার পরের দিন তাই জেএনইউ ছাত্র সংসদের সভানেত্রী ঐশী ঘোষ ফিরে আসেন ক্যাম্পাসে, ঘোষণা করেন, এক ইঞ্চি জমিও তাঁরা ছাড়বেন না, সমস্ত রডের আঘাতের বিরুদ্ধে তাঁদের গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ চলবে। ঐশীদের এই লড়াই আরও অগুনতি ছাত্র ও সাধারণ মানুষকে এই সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে উদ্বুদ্ধ করবে।
আবার এই আন্দোলনগুলির আরেকটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হচ্ছে না, তা হলো প্রতিবাদ সমাবেশগুলিতে নারীদের ভূমিকা। ঐশী ঘোষ একা নন, হাজারো লাখো মহিলা রাস্তায় নেমেছেন, দিল্লির জামিয়ার সেই সাহসী ছাত্রীরা, যাঁরা পুলিশের লাঠির সামনে মাথা উচু করে দাঁড়াতে ভয় পান না, শাহিনবাগের মায়েরা, যাঁরা শিশুদের কোলে নিয়ে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত অবস্থান করে চলেছেন, বেঙ্গালুরুর সেই নারী, যিনি একা পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে দৃপ্ত ভাষণে সরকারের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন, এঁরা সবাই এই দেশব্যাপী আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।
পিতৃতান্ত্রিক হিন্দুত্ব বাহিনী মহিলাদের এই দৃপ্ত প্রতিবাদ মেনে নিতে পারছে না। আরএসএস প্রধান বহুবার বলেছেন যে মহিলাদের জায়গা বাড়ির অন্দরমহলে। এই মধ্যযুগীয় নিদানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যাঁরা প্রতিবাদে প্রতিরোধে সামিল হচ্ছেন, তাঁদের উচিত শিক্ষা কীভাবে দেওয়া যায়? উত্তর এল সেই জেএনইউ থেকেই। সুচরিতা সেন, ঐশী ঘোষের উপর আক্রমণ, মহিলাদের হোস্টেলের ভিতর ঢুকে তাণ্ডব, একটি বার্তা দেওয়ার জন্য সংঘটিত হয়েছে - মহিলারা যেন সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস না পান। বেশি প্রতিবাদ করলে ঐশী ঘোষ-সুচরিতা সেনের মতো, অথবা তার থেকেও খারাপ অবস্থা করে দেওয়া হবে শারীরিক আক্রমণের মাধ্যমে।
আরও পড়ুন: জেএনইউ-এ সন্ত্রাস হল কেন?
যে দেশে শক্তিরূপে দেবী পূজিত হন, যে দেশে রানী লক্ষ্মীবাঈ, মাতঙ্গিনী হাজরা, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, সাবিত্রী ফুলে সহ বহু বীরাঙ্গনা জন্মেছেন, সেই দেশের মহিলারা এই ঠুনকো হিন্দুত্ববাদী গুণ্ডাদের হুমকিতে, বা মার খেয়ে ঘরে ঢুকে যাবেন না। বরং তাঁরা আরও বেশি করে রাস্তায় নামবেন, এবং আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ঘোষণা করবেন, মহিলারাই হিন্দুরাষ্ট্র ধ্বংস করবেন, যে ব্যানার এখন বহু প্রতিবাদ স্থলে দেখা যাচ্ছে।
এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন মোদী-শাহের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু এখনও অনেক পথ চলা বাকি। আরএসএস-বিজেপির ধূর্ততা, শঠতা ও হিংসার মোকাবিলা করতে হলে আরও সংগঠিত হওয়া প্রয়োজন। আমার বিশ্বাস তা হবে। বাঙালি কবি বহু বছর আগে লিখেছিলেন, 'এদেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে’। অবশেষে সেই আঠারোর দিন সমাগত। আঠারো বছরের স্পর্ধা সমস্ত অত্যাচার ও অন্যায়কে ধ্বংস করবে, এই বিশ্বাস আমার আছে।
গান্ধী-রবীন্দ্রনাথ-নেহরু-আম্বেদকর-মৌলানা আজাদ-এর ভারত বর্তমান নবপ্রজন্মের দ্বারা পুনরুজ্জীবিত হবে। আজ গান্ধী বেঁচে থাকলে ছাত্রসমাজকে দুহাত তুলে আশীর্বাদ করতেন, কারণ ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধান, হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের যে পতাকা গান্ধী তুলেছিলেন, তা বর্তমান ছাত্রসমাজ বহন করছে। তাদের মধ্যেই মহাত্মা গান্ধী জীবিত আছেন।
(লেখক অর্থনীতিবিদ তথা বাংলা পত্রিকা 'আরেক রকম' এর সম্পাদক, মতামত ব্যক্তিগত)