Advertisment

মাতৃত্ব, অবসাদ ও অপরাধবোধে

‘‘মেয়েদের মধ্যেও সন্তানধারণকালীন বয়ঃসীমায় মানসিক সমস্যার অনুপাত সবচেয়ে বেশি। তাই আমাদের দেশের মেয়েরাও এই সমস্যায় নিয়মিতই ভোগেন, কিন্তু মাতৃত্বের ‘মহানতা’ তাঁদের সমস্যাটাকে স্বাভাবিক বলে চিনতে শেখায় না।’’ লিখছেন শাশ্বতী ঘোষ

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
mothers day shaswatiMothers4_DAY-004

মাতৃদিবসে স্লোগান হোক -- ‘মায়েরাও মানুষ’।

শাশ্বতী ঘোষ

Advertisment

মা মানে যেন ঠিক রক্তমাংসের মানুষ নন, এমন একজন প্রাণী যাঁর বাঁচাটাই হচ্ছে সন্তানের জন্যে। নিজেকে, নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছেকে সন্তানের জন্য কে কতোটা বিসর্জন দিতে পারলেন, কে পেশাদারি কাজ ছাড়লেন, কে নিজের বই পড়ার অভ্যাস অভ্যেস ছাড়লেন শুধু নয়, কে কতোটা অত্যাচার-অবিচার সহ্য করে শুধু সন্তানের মুখ চেয়ে সারাজীবন একটা অত্যাচারী স্বামীর ঘর করলেন, তার বিবরণে মনে হয় এটাই যেন আদর্শ মা হয়ে ওঠার একটা প্রতিযোগিতা। এই কথা যে শুধু এদেশেই শোনা যায় তা নয়, এই কথা সেই আদ্যিকাল থেকে দেশে-বিদেশে সর্বত্র ইতিহাসে, রূপকথায়, লোককথায়, ধর্মে বারবার আঙুল বুলিয়ে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর মায়েরাও সেই কথা মেনে নিয়ে ‘আমি কি ঠিকমতো, মায়ের মতো মা হয়ে উঠতে পেরেছি’ বলে কখনো সংশয়ে কখনো অবসাদে ভুগেছেন। কিন্তু কোনো নতুন মা এই সংশয়, মন খারাপ নিয়ে সাধারণত কারুর সঙ্গে কথা বলার সাহস পাননি, কারণ তাঁর ভয়, লোকে তো তাহলে তাঁকে পাগল বলবে, বলবে অ-স্বাভাবিক। তাই মাতৃদিবসে মায়েদের শুধু ‘মা’ বলে না দেখে আমরা যদি একটু মানুষ বলেও দেখি, যাঁর মনে হতেই পারে সন্তান হয়ে তাঁর জীবনের অনেককিছু চলে গেছে, এই সন্তান যেন তাঁর গলার কাঁটা বা গলায ঝোলানো পাথর, তাহলে সেই মাকে পাগল বলে দেগে দেবার আগে এটা একটা স্বাভাবিক, মানবিক আচরণ বলে চিনতে শিখি, তাহলে যে মায়েরা  এরকম অনুভূতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের আর কাঠগড়ায় দাঁড় করাবো না।

সন্তানজন্মের অব্যবহিত পরে, কারুর কারুর ক্ষেত্রে সপ্তাহ দুয়েক পরে এরকম অবসাদ খুব স্বাভাবিক। নতুন মায়েদের নানারকম ভাবনার, দোলাচলের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। নতুন এক অতিথির আগমনের প্রথম চমকটা কেটে গেলে অনেকেই ভাবেন ‘আমি এতোসব পারবো না, কোনোদিন পারবো না’; ‘যতোটা ভালোভাবে আমার পারা উচিত ছিলো, আমি মোটেই ততোটা ভালো করে পারছি না বলে আমার নিজেকে খুব অপরাধী লাগে’; ‘বাচ্চাটার ওপর কই আমার তেমন টান তো মনে হচ্ছে না, আমি নিশ্চয়ই খুব খারাপ মা’; ‘আমি নিশ্চযই পাগল হয়ে যাচ্ছি, নযতো কেন এসব ভাবনা আমার মাথায আসবে!’ ‘সব্বাই নেচেকুঁদে বেড়াচ্ছে, এমনকি ওর বাবাও, বাড়ির সবাই, আমিই শুধু এটার জন্যে আটকে পড়ে গেছি’; ‘সবসময়ে বিরক্ত লাগে, রাগ হয, এতো সহজে মেজাজ হারিযেফেলছি, আমি তো এরকম ছিলাম না’; ‘আমার সবসময়ে মাথাটা ফাঁকা লাগে, কিচ্ছু মনে রাখতে পারিনা, ভাবতে পারিনা, যে কাজগুলো মাথা না দিয়ে যন্ত্রের মতো করা যায়, সেগুলোই শুধু করতে পারি’; ‘এই অবস্থাটা আর কোনোদিন বদলাবে না, কোনোদিন আমি আমার পুরোনো জীবনে ফিরতে পারবো না’; ‘কোনোকিছু খেতে ভালো লাগেনা’; ‘সবসময শুধু খেয়ে যাই, ওই একটা কাজ যেটা করলে আমার স্বস্তি হয়’; ‘আমার একদম ঘুম হয় না, এমনকি বাচ্চাটা ঘুমোলেও আমি ঘুমোতে পারিনা, সারাক্ষণ মাথা ঝিমঝিম করে’; ‘সব মিলিয়ে মনে হয় আমার সঙ্গে বাকি পৃথিবীটার মধ্যে যেন একটা কাঁচের দেওয়াল উঠে গেছে’।

বিশেষত আমাদের দেশে, যেখানে শাস্ত্রেই বলেছে ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা’, সেখানে পরের পর মেয়ে হয়ে চললে অবসাদ স্বাভাবিক। আর যদি গর্ভাবস্থায় বা সন্তানজন্মের সময়ে জটিলতা দেখা দেয়, তাই নিয়ে আত্মীয়স্বজনদের বক্রোক্তি, স্বামী (এদেশে সঙ্গী ততোটা নিয়মিত নয়) বা নিকট আত্মীয়, সে বাপের বাড়ির হোক বা শ্বশুরবাড়ির লোকদের প্রয়োজনীয় সমর্থন, সেটা যে আর্থিক হতে হবে তা নয়, নৈতিক বা সময় দিয়ে হতে পারে -- এসবের অভাব থাকলেও অবসাদ আসতে পারে। এমনকি এই সন্তান যদি পরিকল্পিত না হয়, আমাদের দেশে গর্ভে সন্তান এসে গেলে মায়ের সেই সন্তানকে ভ্রূণে নষ্ট করে দেওযার উদ্যোগকে এতোই অ-নারীসুুলভ বলে মনে করা হয় যে সন্তান না চাইলেও ‘এসে গেছে’ এই যুক্তিতেই তাকে রেখে দেওয়া হয়, তাহলেও সন্তানের প্রতি যথেষ্ট মমত্ববোধ তৈরি নাও হতে পারে।

এই ভাবনা মোটেই খুব বিলিতি বা উঁচুঘরের মেয়ের বিষয় নয়। ২০১৫-১৬ সালে বেঙ্গালুরুর নিমহন্স প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য মন্ত্রকের সহায়তায় সারা দেশে ১২টি জেলায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা চালায়। তারা দেখে প্রতি ২০ জনে একজন ভারতীয় মানসিক সমস্যায় ভুগছেন, তার মধ্যে আবার মেয়ের অনুপাত বেশি, এবং মেয়েদের মধ্যেও সন্তানধারণকালীন বয়ঃসীমায় মানসিক সমস্যার অনুপাত সবচেয়ে বেশি। তাই আমাদের দেশের মেয়েরাও এই সমস্যায় নিয়মিতই ভোগেন, কিন্তু মাতৃত্বের ‘মহানতা’ তাঁদের সমস্যাটাকে স্বাভাবিক বলে চিনতে শেখায় না।

এই অবসাদ খুব স্বাভাবিক বলে মেনে নিলে একজন মাকে শুধু একজন অতিমানবী নয়, একজন গড়পড়তা সাধারণ মানুষ বলে ভাবতে হয়। আমরা কি সেজন্য তৈরি? তাহলে তো ধরে নিতে হয় একটি সন্তান মানে শুধু মায়ের একার দায়িত্ব নয়, সে একজন সামাজিক মানুষ হয়ে উঠবে, হবে একজন কৃষক-শ্রমিক-শিক্ষক-প্রযুক্তিবিদ, তাই সমস্ত সমাজেরই এই নতুন মানুষটিকে প্রযোজন। তাই মাতৃদিবসে স্লোগান হোক -- ‘মায়েরাও মানুষ’।

feminism gender gender equality motherhood
Advertisment