Advertisment

আমি আসলে খুব ভালো

বাঁকা লিঙ্গ সোজা করার যেমন কবরেজ বাড়ি আছে, ঝাড়ফুঁক করে ঘাড় থেকে ভালোমানুষি নামানোর তন্ত্রসাধকও নিশ্চয় আছে। ঠিকানা খুঁজে পেলে আমাকে জানাবেন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

আমি রোজ একটু একটু করে ভালোমানুষ হয়ে যাচ্ছি। এটা কি ঠিক? ভালোমানুষ হওয়া কি মানুষের পক্ষে ভালো? ভালো কি মন্দ জানি না। আমি হচ্ছি। রোজ আমি আমার ভালোমানুষি লোককে জানিয়ে দিচ্ছি। লোকে আমাকে ভালো বলছে। আমার খাবার হজম হচ্ছে। ঘুমও। ভালোমানুষি আমাকে সব দিয়েছে। ধীরে ধীরে ভালোমানুষির নেশা আমাকে গিলে খাচ্ছে। সকালে উঠে এক পুরিয়া ভালোমানুষি সেবন না-করলে আমার অস্থির লাগে। মাথার চুল ছিঁড়ি। হাত-পা বেঁকে যায়। আমি বটিকা খুঁজি। ভালোমানুষি বটিকা। এত ভালোমানুষি আমাকে দিন দিন পেড়ে ফেলছে।

Advertisment

publive-image

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন...

আমি তাই ভালোমানুষি ছাড়াতে চাই। কিন্তু পারি না। গোপনে ভালোমানুষি ছাড়ানোর ঠিকানা খুঁজছি। কোথায় আছে সেই যোগগুরুর বাড়ি? কোন স্টেশনে নেমে রিকশায় তিন কিলোমিটার দূরে? বাঁকা লিঙ্গ সোজা করার যেমন কবরেজ বাড়ি আছে, ঝাড়ফুঁক করে ঘাড় থেকে ভালোমানুষি নামানোর তন্ত্রসাধকও নিশ্চয় আছে। ঠিকানা খুঁজে পেলে আমাকে জানাবেন।

আগে কে ভালোমানুষ সেটা জানতে বহু সময় লাগত। হয়তো লোকটা বুড়ো হওয়ার পর জানা গেল যে লোকটা ভালো। রোজ একটু একটু করে তাঁকে ভালমানুষি কুড়োতে হতো। লোকটা কাউকে জানতেও দিত না, সে আসলে লোক ভালো। ভালোমানুষি জানানোর তেমন উপায়ও ছিল না। কেউ চিঠি লিখে জানাত না, আমার পাশের বাড়ির সুনীলবাবু আসলে লোকটা খুব ভালো।

অনিমেষ বৈশ্যের আরও কলাম- সাইকেলের রডে বনলতা সেন

কিন্তু এখন? রোজ সকালে উঠে আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা অছিলায় জানিয়ে দিই যে, আমি লোক ভালো। আমার বিবেক জাগ্রত। মন্দিরে রজস্বলাকে কেন ঢুকতে দেওয়া হবে না, রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন কতটা জরুরি, পথের ঘেয়ো কুকুরের উপর নিপীড়ন---সব বিষয়ে আমার মতামত আছে। এবং সব মতামতেরই সার কথা হল, আমি লোকটা খুব ভালো। এই ভালোর বটিকা গিলে আমি দিন শুরু করি। দু'একটা প্রতিক্রিয়া জানার পর আমি হাতে-পায়ে বল পাই। আমার শিরদাঁড়ায় একটা সুখানুভূতি কুলকুল করে বয়। আমার হাতে-পায়ে বল আসে। আমি দিনের বাকি কাজ বা অকাজ শুরু করি। আমি জানি, চরাচর জুড়ে যেমন খুশি ভালোমানুষ সাজার প্রতিযোগিতা চলছে। যে যেভাবে নিজেকে সাজাতে পারে, সাজাচ্ছে।

অনিমেষ বৈশ্যের আরও কলাম- এখন দেশটা আমার

ভালোনুষির আবার রকমফের আছে। ভালোমানুষি জানান দেওয়ার বাহনও ভিন্ন। মানে নেতার একরকম, সেলেবদের একরকম, আমজনতার একরকম। আমজনতার ফেসবুক, সেলেবের টুইটার, নেতার খবরের কাগজ বা নিউজ চ্যানেল। নেতাদের ফেসবুক না-হলেও চলে। কারণ, তাঁরা যখন যেখানে যা বলেন, রাত্তিরে ঘুম নাই, ওঠে ঘনঘন হাঁই, সব দেখানো হয় চ্যানেলে, সব ছাপা হয় খবরের কাগজে। কাগজে উপরি পাওনা হল ব্যাখ্যা। প্রায়ই দেখবেন লেখা হয়, 'আসলে এই কথা বলে তিনি ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিলেন, যে তিনি শীঘ্রই মন্ত্রিসভায় নতুন দায়িত্ব পেতে চলেছেন।' ঠারেঠোরে। সংবাদজীবীদের খুব প্রিয় শব্দ। কেউই কিছু ঠারেঠোরে বলেননি। ওই সংবাদজীবী যে ঘটনার গভীরে ঢুকতে পেরেছেন, 'ঠারেঠোরে' হল তার বহিঃপ্রকাশ। অতএব বাঙাল লবজে 'খাড়াইল কী?' খাড়াইল এই যে, পুরো সংবাদ দুনিয়াই নেতাদের ফেসবুক। দিনভর অবিরাম ভালোমানুষির উদ্গিরণ। ভালমানুষির স্রোতে ভেসে গেল, চুরি, দুর্নীতি, রাহাজানি। জগতে যা কিছু ঘটছে সব ভালো। সংবাদ মাধ্যমে শুধু ভালোর দাপাদাপি। কে কোথায় চাষার ব্যাটার সঙ্গে নদীবাঁধে মাটি ফেলছেন, কে কবে রাস্তায় নেমে ঝড়ে ভেঙে পড়া গাছ কাটছেন--সব দেখানো হচ্ছে সংবাদমাধ্যমে। আমি ভালো। খুব ভালো।

এ বার আসুন সেলেবদের কথায়। তাঁদের অব্যর্থ বাহন হল টুইটার। বেশি লিখতে হয় না। বাইবেলের বাণীর মতো দু'একটা মহাজাগতিক মন্তব্য। ব্যস তাতেই কেল্লা ফতে। মুহূর্তে দেশের অণু-পরমাণু জেনে গেল, অমুকে এই বলেছেন। এই বলেছেন মানে কী বলেছেন? বলেছেন বা বলতে চেয়েছেন, উনি লোকটা খুব ভালো। বাণী তব ধায় অনন্ত। ভালো, ভালো, উনি খুব ভালো।

এ বার আসুন আমজনতায়। এখানে আছে নানা কিসিমের লোক। কেউ বুদ্ধিজীবী, কেউ কবি, কেউ শিক্ষক, কেউ সরকারি কেরানি, কেউ ব্যবসায়ী। আমরা সবাই খুব ভালো। এক সরকারি কর্মী দেখলাম লিখছেন, 'বিনা কাজে মাসের পর মাস মাইনে নিতে আমার খুব লজ্জা লাগছে।' বহু লোকের চাকরি গেছে, বহু লোক অর্ধেক মাইনে পাচ্ছেন, বহু লোক বুঝতেই পারছেন না, তাঁর চাকরিটা আছে কি না। এই প্রেক্ষাপটে তাঁর মাইনে নিতে লজ্জা লাগছে। হয়তো তাঁর সত্যি বিবেক দংশন হচ্ছে। হয়তো তাঁর ভাতের গ্রাস মুখে উঠছে না। কারণ এখনও আমি বিশ্বাস করি, জগতে ভালো লোক আছে প্রচুর। কিন্তু তিনি তাঁর 'লজ্জা' সবাইকে জানাতে ভুললেন না। লজ্জা পেয়ে তিনি কি শেষ পর্যন্ত বেতন নিলেন না? জানা হল না। এটা জানা গেল,তিনি লজ্জিত। এবং তিনি তাঁর লজ্জা পাওয়ার কথা সাতসকালেই জানিয়ে দিয়েছেন। আমি লজ্জিত মানে আমি ভালোমানুষ। শুনো শুনো নগরবাসী, আমি ভালোমানুষ।

আবার কারও লেখা পড়ে আপনি বুঝতেই পারবেন না, তিনি আগের দিনই সহকর্মীর চাকরি খেয়েছেন। নীল আকাশ, রাতের আকাশ, সবুজ বনানী, পথশিশুর কান্না, কত গানের কলি তাঁর লেখায় গিজগিজ করছে। তাঁর রক্তমাখা হাতে কত ভালোমানুষির হিজবিজবিজ। সকালেই উঠেই তাঁকে ভালোমানুষির অর্গাজম পেয়ে বসেছে। তিনি সেই ভালোমানুষির রতিবটিকা পান করে লিখে ফেলেছেন ভালোমানুষির উপাখ্যান। আগের দিন সহকর্মীর চাকরি খেয়েছেন। মেজাজটা বেশ ফুরফুরে। অতএব 'এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে।'

হাল্লা রাজার মতো তিনি হাত-পা ছুড়ছেন। এবং থেকে থেকে বলে উঠছেন, 'আমি খুব ভালো। আমি খুব ভালোমানুষ।'

অমিমেষ বৈশ্যের সব কলামগুলি পড়ুন এখানে

Tin Chokka Putt
Advertisment