/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/10/lead-67.jpg)
আমার মনে হয় মিটু ইজ আ ফ্যান্টাস্টিক মুভমেন্ট
MeToo in Bengali Theatre: আমি যেদিন থেকে শুনেছি, আমার ভীষণ খারাপ লেগেছে। আমি এই মেয়েদের সবাইকে তো চিনি না। একজনকে চিনি কারণ একটা সময় ও নান্দীকারে ছিল। কিন্তু আমার খুব কষ্ট হয়েছে। এই ধরনের ঘটনার কথা যখন মেয়েরা বলে, তখন তারা অনেকটা মানসিক কষ্টের মধ্যে দিয়ে যায়। কারণ এই বলাটা তো খুব সহজ নয়। কিন্তু আমার মনে হয়, যারা থিয়েটার করতে আসছে, সেই মেয়েদের কয়েকটা বিষয় মাথায় রাখা উচিত।
প্রথমত, আমরা মেয়ে হিসেবে কিছু কিছু পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাই, ট্রামে-বাসে সর্বত্র নানা ধরনের অভিজ্ঞতা হয়। গুড টাচ, ব্যাড টাচ কাকে বলে সেটা কিন্তু আমাদের সবার জানা। তাই থিয়েটার করতে এসে যদি এমন কোনও অভিজ্ঞতা হয়, তবে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করা উচিত। বিষয়টাকে একেবারেই ফেলে রাখা ঠিক নয়। আমার নিজের থিয়েটারে এমন কোনও অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা নেই, কিন্তু একজন মিউজিক টিচার ছিলেন, আমাকে পিয়ানো শেখাতে আসতেন, তাঁর আচরণটা অন্য রকম যে মুহূর্তে বুঝেছিলাম, প্রচণ্ড পিটিয়েছিলাম তাঁকে। কাজেই প্রিডেটরদের বিরুদ্ধে প্রথমেই রুখে দাঁড়াতে হবে।
আরও পড়ুন: পরপর যৌন লাঞ্ছনার অভিযোগ, ভাবমূর্তি ভেঙে পড়ছে ব্যান্ড প্রতিষ্ঠাতার
অনেকেই বলছেন যে ওরা কেন চেপে রাখল এতদিন, তবে ওদেরও নিশ্চয়ই অংশগ্রহণ ছিল... এগুলো খারাপ কথা। অনেক সময়ে মেয়েরা বলে উঠতে পারে না কারণ তারা হয়তো তাদের পরিবারের কাছে তাদের শিক্ষক সম্পর্কে অনেক কিছু বলেছে। এর পর যখন অপ্রীতিকর কিছু ঘটে, তখন সে বলতে ভয় পায় হয়তো এই কারণে যে শেষ পর্যন্ত তার থিয়েটার করতে যাওয়ার দিকেই আঙুল উঠবে। হয়তো তাকে বলা হবে যে আমরা তো জানতাম থিয়েটারে এমনটা হয়, তাই তোমাকে বারণ করা হয়েছিল।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/10/8-3.jpg)
কিন্তু এই মেয়েরা, আরও বহু মেয়েকে পথ দেখাতে পারে। আমার মনে হয় মিটু ইজ আ ফ্যান্টাস্টিক মুভমেন্ট। সঠিকভাবে, সিনিয়রদের সহযোগিতায় এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত। এই বিষয়ে মেয়েদের এগিয়ে আসা, প্রশ্ন করা, একটা ফোরাম গড়ে তোলার খুব প্রয়োজন। তাহলে প্রিডেটাররাও ভয় পাবে।
দ্বিতীয়ত, আমার মনে হয় যাঁদের বিরুদ্ধে আজ এই অভিযোগগুলো উঠছে, তাঁরা কেমন, সে সম্পর্কে অনেকেই অনেক দিন ধরে জানেন । এরকম নয় যে তাঁরা প্রথমবার এমনটা ঘটালেন। এঁদের বেশিরভাগই প্রিডেটেরস হিসেবে পরিচিত। তাই কোনও সংস্থা বা দলে যোগ দেওয়ার আগে, ভালোভাবে জেনে নেওয়া উচিত, সেখানে ঠিক কীভাবে শেখানো হয়। আমি যখন থেকে থিয়েটার করতে শুরু করি, আমাদের সিনিয়ররা আমাদের প্রচুর পরিশ্রম করাতেন। আমি তো মূলত গৌতমদার কাছেই ওয়ার্কশপ করেছি। আমাদের সারাক্ষণ কঠিন ফিজিকাল এক্সারসাইজের মধ্যে দিয়ে, পড়াশোনার মধ্যে দিয়ে যেতে হতো। আর কোনওদিন কোনও ওয়ার্কশপ অন্ধকার ঘরে হয়নি।
এখনও নান্দীকারে কয়েকটা নিয়ম খুব কড়াভাবে মেনে চলা হয়। আমরা ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে পার্থক্য করি না। আমার দলের নিয়ম হল মেয়েরাও একই সঙ্গে সেট তুলবে ও গোছাবে। কিছু কিছু জিনিস প্রথম থেকেই দলে অ্যালাউড ছিল না, এখনও নেই। যেমন রিহার্সাল রুমে একজন আর একজনের গায়ে হেলান দিয়ে বসবে না। আমাদের নাইট রিহার্সালের সময় একজন মনিটর থাকেন। রিহার্সাল রুমে কোনও রকম মদ-সিগারেট খাওয়ার অনুমতি নেই। আর দলের ছেলেমেয়েদের মধ্যে সম্পর্ক হতেই পারে। দলে থেকেই আমার আর সপ্তর্ষির মধ্যে প্রেম হয়, বিয়ে হয়। কিন্তু আমাদের সম্পর্ক কখনও দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেনি। তেমন কোনও সম্পর্কই যাতে দলের নিয়মশৃঙ্খলাকে লঙ্ঘন না করে সেদিকে সব সময় নজর রাখা হয়।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/10/2-19.jpg)
বাইরে শো করতে গেলে আমরা খেয়াল রাখি, বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড যদি কেউ থাকে, তারা যেন আলাদা কোনও ঘরে না থাকে। বাইরে শোয়ের সময় দুজন মনিটর থাকেন যাঁরা সব সময় ছেলেমেয়েদের উপর নজর রাখেন। বাইরের কোনও শহরে যদি ছেলেমেয়েদের কোনও আত্মীয়স্বজন থাকেন, সেখানেও তাদের ছাড়া হয় না। কাজ শেষ হলে রাতে সেই শহরে বা এলাকায় ঘুরতে যাওয়ার অনুমতি থাকে না। বাইরে গিয়ে আমরা যে অ্যাকোমোডেশনে থাকি, সেখানে রাতের পোশাক পরে ডাইনিং হলে আসা যায় না। রিহার্সালে কী ধরনের পোশাক পরে আসবে, সেটা নিয়েও আমাদের কিছু নির্দেশ থাকে। এই কথাগুলো শুনে মনে হতে পারে যে আমরা একটু পিউরিটান। কিন্তু আমরা কিছু নিয়ম মেনে চলি, শৃঙ্খলার কারণে। আর নান্দীকারে থিয়েটার করতে আসা প্রত্যেক ছেলেমেয়ের অভিভাবকদের সঙ্গেও আমরা নিয়মিত কথা বলি।
এই কারণে অনেকের কাছেই হয়তো নান্দীকারের পরিবেশটা একটু স্টিফ। কিন্তু আমার দলের ছেলেমেয়েরা আমাকে ভয় পায় যেমন, আমাকে ভালোওবাসে। কারণ ওরা জানে বাবুয়াদি কাজটা করে। আসলে ফ্রিডম মানে তো যা ইচ্ছে করা নয়। আমি আমার নিজের ক্ষেত্রেও কিছু জিনিস মেনে চলি। আমি ছোটবেলায় একবার শালা বলে ফেলেছিলাম বলে মা একটা চড় মেরেছিলেন। এখনও আমি রেগে গেলে গালাগাল করি না। আমার মনে হয়, গালিগালাজ বা খিস্তি-খেউড় হলো এক ধরনের যৌন বিকৃতির প্রকাশ। করলে এক ধরনের সেক্সুয়াল টেনশন রিলিজ হয়। কাজেই আমি নিজেও যেমন একটা ডিসিপ্লিন মেনটেন করি, ছেলেমেয়েদেরও সেটা শেখানোর চেষ্টা করি। আর এই দায়িত্বটা কিন্তু সিনিয়রদেরই।
তৃতীয়ত, থিয়েটারে মানুষের শরীর নিয়ে নানা ধরনের এক্সপেরিমেন্ট হতেই পারে কিন্তু ঠিক কী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সেটা ঘটছে, তার উপর নির্ভর করে যে অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হবে কি হবে না। যেমন, আমাদের নতুন নাটক 'মানুষ'-এ, অডিয়েন্সের দিকে পিছন ফিরে, একটি মেয়ে পুরোপুরি পোশাক পরিবর্তন করে। সেই সময় চারটি ছেলে তাকে প্রোটেক্ট করে। যখন প্রথম আমি রিহার্সালে বলি যে এই সিনটা হবে, দলের ছেলেরা বলেছিল এটা কীভাবে করব বাবুয়াদি। আমি তখন বললাম, তোমার মা বা দিদা যদি অসুস্থ হন, তোমাকে যদি তার পোশাক পরিবর্তন করাতে হয়, তুমি কি সেই শরীরটাকে নারী শরীর হিসেবে দেখবে? এক্ষেত্রেও সেটা দেখো না। ওই সিনটা তার পর এমন পবিত্র ভাবে হয়... রিহার্সালে প্রত্যেকেই বন্ধুত্বের বা ভালোবাসার পিওরিটি থেকে গোটা বিষয়টা দেখে। মঞ্চে যখন অভিনয় হয়, প্রত্যেকটি ছেলে যারা মঞ্চে থাকে বা ব্যাকস্টেজে থাকে, সবার মনোযোগ থাকে কীভাবে প্রচণ্ড ভালোবাসা দিয়ে মেয়েটিকে প্রোটেক্ট করবে।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/10/4-6.jpg)
কাজেই থিয়েটারে একজন সিনিয়র কীভাবে শেখাচ্ছেন, কীভাবে ইমপ্লিমেন্ট করছেন, তার উপর নির্ভর করে। থিয়েটার হল একটা স্পেস অফ আর্ট। প্রত্যেকটা মানুষ, তার অস্তিত্ব এক একটা ইউনিভার্স। কেউ যদি সেনসিটিভ না হন, যথোপযুক্ত শিক্ষিত না হন, তাহলে ভুল ভাল কাজ হবে। আর এক্সপেরিমেন্ট মানে শুধুই এই ধরনের শরীর নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট, এই সব চালাকি দিয়ে বেশিদিন চলা যায় না। কখনও না কখনও ঠিক সেটা বেরিয়ে পড়ে খারাপ ভাবে। এই যে সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় দুম করে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম করলেন। হাউ ডেয়ার হি? কী করে তিনি এমন একটা প্রসঙ্গে একজন লেজেন্ডের নাম নিতে পারেন? প্রথম যখন এই ঘটনাটা শুনি, আমার সত্যিই খানিকটা ভয়ও করেছে। কিন্তু মেয়েদের ভয় না পেয়ে আরও বেশি করে দাপিয়ে অভিনয় করা উচিত। এই যে কথাগুলো ওরা বলছে, সেটা বলতে তো খুব কষ্ট হচ্ছে। দুদিন বাদে যেন ওটাকে ওভারকাম করে দাপটের সঙ্গে কাজ করতে পারে ওই মেয়েরা। যাতে সবাই বলে লুক হোয়াট শি ইজ ডুয়িং নাউ। আর দুবছর-তিনবছর অপেক্ষা নয়, সঙ্গে সঙ্গে চটি খুলে থাপ্পড় মারা উচিত। কোনও রং টাচ হলেই, ডোন্ট টেক টাইম টু রেসপন্ড।
চতুর্থত, নতুন যারা থিয়েটার করতে আসছে, তাদের মনে রাখা উচিত যে একটা ওয়ার্কশপ করেই অভিনেতা-অভিনেত্রী হওয়া যায় না। থিয়েটারের প্র্যাকটিসটা বহু বছর ধরে চলে। প্রত্যেকদিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রম প্রয়োজন, প্রচুর পড়াশোনা প্রয়োজন। আমি ৪৫ বছর বয়স অবধি চেষ্টা করে যাচ্ছি। 'সোজন বাদিয়ার ঘাট' প্রযোজনার সময় আমাদের প্রত্যেকদিন সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত শুধুই ফিজিকাল করানো হতো। ৭টার পর সিন তোলা হতো। হয়তো একদিন একটাই সিন তোলা হল। এভাবে ৩ বছর চলেছিল। এই পদ্ধতিতেই আমরা এখনও কাজ করি। পাঞ্চজন্য-র সময় ২ বছর টানা কালারিপায়াট্টু ট্রেনিং চলেছে। কীভাবে শরীরকে আরও বেশি ফ্লেক্সিবল করে তোলা যায়, সেই ট্রেনিং চলেছে। একটা অসম্ভব গ্রিলের মধ্যে রাখা হয়েছিল সবাইকে। তার পর গিয়ে দেখা গিয়েছে যে দুটো ছেলেমেয়ে ঠিকঠাক করতে পারছে।
কাজেই আমি এলাম, ৬ মাসের একটা কোর্স করলাম, অভিনেত্রী হয়ে গেলাম ব্যাপারটা তেমন নয়। এটা আমার ব্যক্তিগত মত। ৬ মাসের কোর্স করে তুমি বিহেভ করতে শিখবে হয়তো কিন্তু অ্যাক্টর হবে না। যারা পরিশ্রম করে, লেগে থাকে, পড়াশোনা করে আসে, একমাত্র তারাই থিয়েটারে টেকে। সেইজন্য কোনও ভুল প্রতিশ্রুতিতে কান দেওয়া উচিত নয়।
সবশেষে আমার একটা ভাবনা রয়েছে এই গোটা বিষয়টা নিয়ে। এই যে ঘটনাগুলো সামনে আসছে, মেয়েরা জোট বাঁধছে। এটাকে যদি আরও বড় একটা আন্দোলনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় তবে শান্তভাবে সিনিয়রদের নিয়ে একটা বড় জোট বাঁধতে হবে। এমনভাবে এগোতে হবে, এমন কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এমন কিছু করার সাহস না পায়। শুধু রাগ করলে হবে না। রাগের বহিঃপ্রকাশটা কম সময় থাকে। আমার মনে হয় থিয়েটার জগতে একটা কোড অফ কনডাক্ট যদি তৈরি করা যায়, যেটা সব দলগুলি অনুসরণ করবে, তবে নোবডি ক্যান মেস উইথ দ্য নিউকামারস। এটা কীভাবে হবে সেটা পুরোপুরি এখনই বলে ওঠা সম্ভব নয়। এটা আমার একটা প্রস্তাবনা। বাংলা থিয়েটারে এই কমন কোড অফ কনডাক্ট থাকলে মেয়েরা অনেক নিশ্চিন্তে কাজ করতে আসবে। আর এই কোড অফ কনডাক্ট তৈরি করতে হবে বাংলা থিয়েটারের সিনিয়রদের। যারা দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে কাজ করছে, যেসব দলগুলিতে খুবই কড়াভাবে ডিসিপ্লিন মেনে চলা হয়, সেই সব দলের মাথাদের একত্রে বসে এই কাজটা করতে হবে আইনজ্ঞ এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিয়ে।
সাক্ষাৎকার ও অনুলিখন: শাঁওলি দেবনাথ