একটা ছোট শহরে এসেছি। বহুকাল ধরে খুব প্রিয় এই জায়গাটাকে দিনের পর দিন ধরে দেখি ক্রমশ অপরিষ্কার হয়ে যেতে। পথেঘাটে জঞ্জালের স্তূপ, ভ্যাট নেই, যে দু’চারটে আছে, উপছে পড়ছে কুশ্রীতায়। মন বড় মলিন হয়ে যায় দেখে।
কেন এমন অবস্থা- খোঁজ নিতে গিয়ে শুনলাম আবর্জনা ফেলবার উপযুক্ত জায়গা নেই বলে পুরসভা আবর্জনা তোলে না। কয়েকদিন আগে কয়েকজন নদীবন্ধু-র পোস্টেও এসেছে এই আলোচনার প্রসঙ্গ। উত্তর বারাকপুর পুরসভার যাবতীয় আবর্জনা অশোধিত অবস্থাতে ফেলা হয় গঙ্গায়। ক্ষুব্ধ নাগরিকদের প্রশ্নের উত্তরে কর্তৃপক্ষ নাকি জানিয়েছেন, অ-তরল বর্জ্য ফেলবার জন্য কোনো নির্দিষ্ট স্থানের ব্যবস্থা করা যায় নি বলে ওই আবর্জনা নদীতেই ফেলা হচ্ছে। এক বন্ধু সঙ্গত ক্ষোভে বলেছেন পুর কর্তৃপক্ষ যদি আবর্জনা ফেলবার স্থান নির্ণয় করতে না পারেন, সেটা তাঁদের সমস্যা। তিনি উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন বাঁকুড়াতে পুর আবর্জনা ফেলা হত গন্ধেশ্বরী নদীতে। নাগরিক প্রতিবাদের পর পুর কর্তৃপক্ষ অন্য জায়গার ময়লা ফেলার ব্যবস্থা করেছেন। নাগরিকদের সচেতন উদ্যোগ একটি নদীকে রক্ষার জন্য কতোটা ভূমিকা নিতে পারে, বাঁকুড়ার ঘটনা তার একটি সুন্দর প্রমাণ।
COVID-19: ভাইরাস ও মানুষ
কিন্তু উলটো ভাবনার মাছি যাকে কামড়ায় তার মাথায় খানিক পরে পরেই উলটো ভাবনা গজিয়ে ওঠে। এই যে প্রতিটা শহরের প্রয়োজনীয় আবর্জনা ফেলার জায়গা, এর তাহলে শেষ কোথায়? আমার নিজের শহরে বেশ কয়েকবছর আগে থেকেই দেখেছি শহরের প্রায় অর্ধেক পরিমাপ জুড়ে আবর্জনা ফেলার এলাকা তৈরি হয়েছে নগরসীমার ঠিক বাইরে। হয়ত এটাই ছিল ‘স্মার্ট সিটি’ হয়ে ওঠার শুরু। ঐ জায়গাগুলো ছিল আমাদের এই মালভূমিঘেঁষা অঞ্চলের জল গড়িয়ে যাওয়ার পথ। সে সব ভরাট হয়ে উঠছে শহরের আবর্জনায়, যার ষাট ভাগের বেশিই হয়ত প্লাস্টিক আর পলিথিন প্যাকেট। এখন পথযাত্রীদের রুচিরক্ষার্থে তাকে আড়াল করে উঠেছে লম্বা পাঁচিল। ট্রেনে যাবার সময়ে ইদানীং যে কোনো বড় শহর আসন্ন হলেই দূর থেকে দেখা যায় তার নিক্ষিপ্ত আবর্জনার কুচ্ছিত ছড়িয়ে থাকা। মানুষের বাসভূমি, সে কতো সুন্দর, কতো স্বপ্ন আর কল্পনা দিয়ে গাঁথা! এই কি তার অভিজ্ঞান?
এই অবস্থাটা বেড়ে চললে কী হবে আমাদের এই স্বাস্থ্যসচেতন নগরসভ্যতার ভবিষ্যৎ? নগরায়ন বেড়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে তো বাড়তেই থাকবে আবর্জনা ফেলার জায়গার প্রয়োজন। অর্থাৎ মানুষের সভ্যতা এতদিনের পথপরিক্রমার পর এসে দাঁড়াবে নোংরা করার জায়গার সন্ধানে, ঠিক যেমন নদীতে বাঁধ দিয়ে, জঙ্গল কেটে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় সভ্যতার সবচেয়ে আবশ্যিক অঙ্গ হিসাবে, তার কুড়ি থেকে ত্রিশ শতাংশ নষ্ট হয় তার দিয়ে তা পরিবহনের সময়ে। একসময়ে যতই অবিশ্বাস্য মনে হোক, আজ তো এটাই সত্যি যে পৃথিবীর সমস্ত মাটির, সব নদীপাহাড়উপত্যকা গুহাকন্দরের মাপ করা হয়ে গেছে, নিমরহস্যও কিছু বাকি নেই কোথাও। তাহলে কতোদিন লাগবে বড়ো আরো বড় আরও বড় শহর গড়ে উঠতে যার নোংরাফেলার জায়গার যোগান দিতে দিতে জমি অকুলান হবে? যখন কৃষিজমি পরিবর্তিত করতে হবে দূষণ জমানোর জমিতে? তারও পরে...কতদূর? এই হতাশ শূন্যতার মাঝখানে পথসংকেতহীন দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল তাহলে কি অন্য কোনোদিক থেকে শুরু করতে হবে আমাদের ? ওই আশাহীন নিরুদ্দেশ ভবিষ্যতের কোন নিরুপণ আমার হাতে নয়, আমি কি তবে আরম্ভ করব আমার মত সাধারণ মানুষদের হাতের মধ্যে থাকা কোনো জায়গা থেকেই? ভাবব আবর্জনা তৈরি কম করার কথা?
সে কী করে হবে!
অশ্লীলতার দায় বড় দায়, বিশেষত এ রাজ্যে
বাড়িতে প্রতিদিন এত এত আবর্জনা! একি আর কেউ ইচ্ছে করে তৈরি করে নাকি? এই এত আবর্জনা তো প্রতিদিন নিজে থেকেই এসে বাড়িতে ঢুকছে কিংবা কাজকর্মে তৈরি হচ্ছে। ভাবনা তবু চলতেই থাকে কারণ আবর্জনা ফেলবার মাটি-র চিন্তা ভয় পাইয়ে দিয়েছে। যদি ওই পথের অনিবার্যতা বুঝতে পারি আর সেটা না-চাই তাহলে এই ‘আবর্জনা তৈরি কম করা’ ছাড়া আর কোনো উপায় তো মাথায় আসে না! কোথা দিয়ে, কীভাবে তাহলে একে সফল করা, অন্তত চেষ্টা করা যায়!
দৈনন্দিন আবর্জনা কোনগুলো? যা আমার ব্যবহার্য নয়, ভবিষ্যতেও নয়, অথচ আসছে, রয়েছে, জমে উঠছে - তাকেই তো আবর্জনা বলি। তার মধ্যে একটা বড়ো অংশই দৈনিক এসে ঢুকছে। তার কোন কোনটার ঢোকাই বন্ধ করা যাবে? প্রথম যে নাম ভেসে উঠবে, সেটা সকলে ইতিমধ্যেই জানি- অনর্থক প্লাস্টিক প্যাকেট। এটা নিয়ে এত কথা এত চেষ্টা ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে যে আপাতত অন্যগুলো দেখা যেতে পারে।
রান্নাঘর থেকে বেরুনো তরিতরকারির খোসা, খাবার টেবিলের এঁটো ভাত-তরকারি। কুড়ি বছর আগেও একেবারে কলকাতা শহরের বাইরে বাকি জায়গাগুলোতে গরু কুকুর ছাগল পাখপাখালি এত দুর্লভ হয়নি যে তাদের খেতে দেওয়া যায় না। জেলাশহরের অনেকগুলোতে এখনও এই পরস্পর মিলেমিশে থাকার সুবিধে রয়ে গেছে। রোজকার খাদ্য অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া এ দেশের জীবনযাপনের এক স্বাভাবিকতা ছিল। পাতের অবশিষ্ট খাবার পাখি কুকুর বেড়াল কাঠবেড়ালিদের দেওয়ার যে আনন্দ তার এক মূল্য আছে। দরজার বাইরে, ছাদের কি বারান্দার কিনারে, জানলার কোনায় বেঁধে রাখা ছোট পাত্রে দিয়ে রাখা খাবার খেয়ে গেছে দেখা যে কতো আনন্দের! বিশেষত ছোটদের জীবনের সঙ্গে এই ছোট ছোট সাথিত্বের বোধগুলিকে যুক্ত করে দিলে ব্যাপারটা কেবল আবর্জনামুক্তির থেকে অনেক বড়ো একটা ভূমিকা নিতে পারে। ছোটদের একা থাকা যখন সমাজে একটা সার্বিক সমস্যা হয়ে উঠছে। বিখ্যাত প্রকৃতিবিদ রাচেল কারসন, যাঁর লেখা সাইলেন্ট স্প্রিং নামের বইটি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে পোকামারার কীটনাশক নিষিদ্ধ করে লক্ষ লক্ষ পাখির প্রাণ বাঁচিয়েছিল, বারে বারে দেখিয়েছেন এই রকম জানলায় পাখির খাবার রেখে দেওয়া মহিলারা কিংবা শিশুরা তাঁকে জানাত কবে কোন পাখি প্রথম আসছে বা আসছে না, মরে গেছে।
তরকারির খোসা হোক বা পুজোর ফুল- যে গাছপালার যে কোনো অংশ মাটিতে, এমনকি জলেও ফেললে তা আপনিই মাটিতে মিশে যায় কিন্তু প্লাস্টিক প্যাকেটের বন্দিদশা থেকে সহজে মুক্ত হতে না পেরে সে পচে ওঠে। মাটি থেকে জন্ম নেওয়া বস্তু আবার মাটিতেই ফিরে যাবে, এই সহজ জৈব পরিবর্তনের চক্র থেকে চ্যুত হয়ে দূষণ ঘটাতে থাকে। তখন তা বোঝা। আবর্জনা। বাড়ির আশপাশে, এমনকি বাড়ির মধ্যেও একটুখানি খালি জায়গায় সবুজ জিনিস ফেলতে থাকলে তা আবার মাটিতেই ফিরে যায়। তার জন্য করা পরিশ্রমকে যদি গৃহস্থালীর অংশ করে নিই, তাহলে মাটির কাছে ওইটুকু আমাদের ঋণ শোধের চেষ্টা। অনেক বড় কিছুর সঙ্গে মেশার আনন্দকে জুড়ে দেওয়া যায় আমাদের প্রতিদিনের উৎকণ্ঠাময় বেঁচে থাকার মধ্যে।
অরণ্য যতো বড়োই হোক, তার কোনো বর্জ্য থাকে না। যা কিছু ঝরে পড়ে, ফুরিয়ে যায়, তা আপনা থেকেই মিশে যায় মাটির সঙ্গে মাটি হয়ে। আবার বীজ হওয়া, আবার গাছ, আবার গাছের ডালে পাখির ডিম...
এর সবগুলোই আমি ভাবছি আমার নিজের সমস্ত সীমাবদ্ধতা থেকে, অন্যেরা ভাবলে আরও বহু মজার, নতুন সম্ভাবনা বেরিয়ে আসবে। পরিবারের মধ্যে নতুন এক উদ্ভাবনী খেলা শুরু হতে পারবে।
কী হবে এসব করে? সত্যি কি কিছু হবে? একা ওরকম ভাবে কিছু করা যায় নাকি? আমি জানি প্রায় সকলেরই মনে উঠছে এইসব প্রশ্ন। এর কোনো উত্তর আমি জানি না। কিন্তু অন্য কোনো সুস্থ পথও জানি না আমাদের খুব খুব ভালোবাসার এই গ্রহটিকে ময়লা ফেলার টুকরি হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচানোর। সব বদলানোর ক্ষমতা আমার নেই। আমি কেবল ভালোবাসতে পারি। তাই এইটুকুই করব ঠিক করছি। শুধু এইটুকু যে ওর গায়ে নোংরা ফেলার কাজে আমি আর হাত লাগাবো না। হয়ত তার ফলে কিছুই হবে না। কিংবা কে জানে, হয়ত আরো কেউ ভাববে। তাদের থেকে আরো অন্য কেউ...
শেষ কথা কেই বা জানে!
(জয়া মিত্র পরিবেশবিদ, মতামত ব্যক্তিগত)
এই কলামের সব লেখা পড়ুন এই লিংকে ক্লিক করে