প্রথমেই “সংসদীয় বামপন্থী” শব্দটা বুঝিয়ে বলা ভালো। অর্থাৎ একটু হেলে থাকবেন বামেদের দিকে, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন, পুঁথিগত বিদ্যায় জাল ডিগ্রি ছাপাবেন না, সমাজ-সংসারে যতটুকু সৎ থাকা যায় সেটুকু থাকবেন। ভাবধারা হবে উদারনৈতিক এবং প্রগতিশীল। ধর্মের কলে বাতাসে নড়বেন না, সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেবেন না।
আমাদের দেশের নানা রাজনৈতিক দলের কথা ভাবলে তার মধ্যে তিন রাজ্যে বিভিন্ন সময় রাজত্ব করা সিপিএম এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যের কাছাকাছি। এ রাজ্যে তাদের চৌত্রিশ বছর রাজত্বের প্রথম দশ কেটে যাওয়ার পর অবশ্য কংগ্রেসের সঙ্গে গুণগত মানের তফাৎ কমতে শুরু করেছিল। ত্রিপুরাতেও দীর্ঘ শাসনে বিভিন্ন সময়ে সিপিএমের বিরুদ্ধে একনায়কতন্ত্রের অভিযোগ উঠেছে বারবার। এই দুই রাজ্যেই ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পর তাদের ভোট শতাংশ গোঁত্তা খেয়ে একেবারে নিম্নমুখী। কেরালায় অবশ্য সিপিএমের একনায়কতন্ত্র ততটা চেপে বসতে পারে নি। বামপন্থীরা প্রথম রাজ্যশাসন করার স্বাদ পায় এখানেই, তবে কংগ্রেসের সঙ্গে পাঁচ বছর অন্তর ক্ষমতার হাতবদল এই রাজ্যের চরিত্র। সব মিলিয়ে বামপন্থীরা যেখানে যেখানে রাজ্যশাসন করেছেন, সেই অভিজ্ঞতা থেকে তাঁদের অন্যান্য রাজনৈতিক দলের চেয়ে খুব খারাপ বলা যাবে না।
অন্যদিকে, নিজেদের সবচেয়ে ভালো সময়েও রাজনৈতিক সততার বুলি কপচাতে গিয়ে কেন্দ্রের পরিসরে বিপুল সুযোগ নষ্ট করেছেন বামপন্থীরা। এ বিষয়ে বহুচর্চিত জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী না হওয়া, সোমনাথ চ্যাটার্জী লোকসভার স্পিকার থাকাকালীন গণ্ডগোল এবং তাঁকে রাষ্ট্রপতি হতে না দেওয়া, প্রথম ইউপিএ সরকারে মন্ত্রিত্ব না নেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। সিপিএম সবই বোঝে, তবে দেরিতে। কংগ্রেসের সঙ্গে রাজনৈতিক যোগাযোগ রাখার তর্কে সৈফুদ্দিন চৌধুরী গত সহস্রাব্দে দল থেকে বহিষ্কৃত হন, আর সেই সিপিএম আজকের দিনে কংগ্রেসের সঙ্গে এক রাস্তায় হাঁটছে। আবার এই আঁতাতের ফলে কেরলে বামপন্থীদের যে ভীষণ মুশকিল, সে কথা বলাই বাহুল্য। কেন্দ্রে বন্ধুত্ব আর রাজ্যে শত্রুতা, এই দ্বন্দ্বে লাভের গুড় সেখানে বিজেপিই বেশি খাবে।
আরও পড়ুন: সংকটে অর্থনীতি, পরিত্রাতা আছেন কেউ?
এতদসত্ত্বেও এই পুজোর আগে সম্ভবত বামপন্থীদের জন্যে সেরা সময় আসছে। অন্যান্যবারের মতই এবারেও আরাবল্লী পাহাড়ের দক্ষিণ পাদদেশে জেএনইউ-তে বিপুলভাবে জিতেছেন বামপন্থীরা। সেখানকার বাঙালি নেত্রী ঐশী ঘোষ মহাশয়া (এসএফআই যখন, নিশ্চয় সিপিএম সমর্থক) দেশজুড়ে প্রচার পেয়েছেন যথেষ্ট। কানহাইয়া কুমার যেমন এখান থেকে সারা ভারতে বাম আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠেছেন, ঠিক তেমনই ঐশী ঘোষকে নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি ভাবনা শুরু করা উচিৎ বামেদের। এই বাংলায় তরুণ বামপন্থী নেতানেত্রীদের খুব অভাব। যাঁদের ওপর সিপিএম নির্ভর করেছিল অনেকটা, তাঁদের মধ্যে অনেকে সোজা পথ থেকে সরে গেছেন, বা সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। সারা দেশের প্রেক্ষিতে যুবনেতা হিসেবে টিকে আছেন সিপিআইয়ের কানহাইয়া। সেখানে নতুন একজন ঐশী অবশ্যই বামেদের কাছে বড় পাওনা।
আজকের রাজনীতিতে প্রচার এবং চমক প্রয়োজন। সেই জায়গায় সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে অনেকটা জায়গা করে নেওয়া জেএনইউ-এর তরুণীকে খুব তাড়াতাড়ি বড় দায়িত্ব দেওয়া উচিৎ সিপিএমের। তবে বহুযুগের বৃদ্ধতন্ত্র ভেদ করে সে প্রচেষ্টা কতটা সফল হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
এই প্রসঙ্গেই বলতে হয় সাম্প্রতিক বাম ছাত্র-যুব সংগঠনের ডাকে সিঙ্গুর থেকে হাওড়া পর্যন্ত মিছিলের কথা। সেই মিছিলের শেষে জলকামানের আগেই লাঠি চালালো তৃণমূল সরকারের পুলিশ। মনে রাখতে হবে, বিজেপির সমাবেশে কিন্তু পুলিশের লাঠি ততটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সেখানে বরং জলের তোড়ই সম্বল। বেশ কয়েকটি রাত জেলে কাটাতে হল জনা কুড়ি বাম বিক্ষোভকারীকে। সেকথা এবার যথেষ্ট প্রচার পেয়েছে বাংলার সংবাদমাধ্যমে। জামিন পেয়ে বাম সমর্থক কিশোর-কিশোরীদের আবিরমাখা মুখের ছবি বাংলার বাম রাজনীতির পক্ষে ইতিবাচক বার্তা।
আরও পড়ুন: ঘরে কী কী বই আছে?
এ তো আর দুর্নীতি সংক্রান্ত বেল বনাম জেলের গল্প নয়, যে আবর্তে এখন ঘুরপাক খাচ্ছে গোটা বাংলা। এখানে বরং কাজের দাবিতে যুবক যুবতীদের স্লোগানের শব্দ শোনা গেছে। নারদা-সারদা-৩৭০-এনআরসি-তিন তালাক-এক ভাষা-এক দল এই সমস্ত অতি উচ্চমানের রাজনৈতিক আলোচনা থেকে বেরিয়ে যে সাধারণ রাজনীতির বিজলি-সড়ক-পানির মত বিষয় নিয়ে আলোচনার জায়গা শুরু করা যায়, সে পথ দেখানোর চেষ্টা করছেন কিছু বাম সমর্থক যুবক-যুবতী। এঁদের মধ্যে একটা বড় অংশ অবশ্যই কলকাতা এবং শহরতলীর। তাঁদের প্রবীণ নেতারা একটু জায়গা ছাড়লে সামনের কলকাতা পুরসভা নির্বাচনে এই নবীন বামেরা হয়ত কিছুটা ভোট বাড়াতে পারবেন। লেখচিত্র তো ২০০৯ লোকসভা নির্বাচন থেকে ক্রমাগত নামছেই। এক দশক পার। এখন যে অবস্থায় তাতে আর নীচে নামার জায়গা কম। ফলে এটাই সংসদীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক গণতন্ত্রে বামেদের ফেরার সেরা সময়।
আর সবশেষে আসতেই হয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথায়। সংবাদমাধ্যম থেকে যেটুকু বোঝা যাচ্ছে, তাতে মূল দ্বন্দ্ব কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়র সঙ্গে অতিবাম মনোভাবাপন্ন পড়ুয়াদের। সেই জায়গায় মন্ত্রী মহাশয়ের মুখে উঠে এসেছে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কথা। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর সমর্থক ছাত্রছাত্রীরাই নাকি এই গোলমাল পাকাচ্ছে। সেই সূত্রেই হয়ত ছাত্র ইউনিয়নের অফিস ভেঙে চুরমার। দেওয়ালে সাদার বদলে নীল ইজেলে চে সাহেবের মুখের ওপর রামধনু রঙের পোঁচ। গুয়েভারার মুখ ঢাকা দিয়ে অতিবিবর্ণ ফ্যাকাসে সাদা চুনকামের ওপর লাল কালিতে ফুটে উঠলো এবিভিপির নাম। গোটা বিষয়টায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতির লক্ষণ খুব কম। ঠাণ্ডা মাথায় রাজনৈতিক আলোচনার পরিসর একেবারে অনুপস্থিত।
আরও পড়ুন: রাজনীতির গণেশপুজো, গণেশপুজোর রাজনীতি
তবে বিজেপি যে বাংলার সংসদীয় বৃত্তে জায়গা বাড়িয়ে ফেলেছে অনেকটা, সেকথা পরিষ্কার। যাদবপুরে এবারের গোলমালের পর মিছিল হয়েছে দুদিকেরই। অবশ্যই যাদবপুরের পড়ুয়াদের মিছিলের ছবি অনেক বেশি উজ্জ্বল। সেটাই তো স্বাভাবিক। অনেকটা পরিশ্রম করলে তবেই তো যাদবপুরে পড়াশোনা করার সুযোগ পাওয়া যায়। কিন্তু বুঝতে হবে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডীর বাইরে যে ডানপন্থী মানুষেরা স্লোগান দিচ্ছেন, তাঁদের সংখ্যাও খুব কম নয়। হয়তো মিছিলে তাঁদের সমর্থকের সংখ্যা এখনও কিছুটা কম। কিন্তু বাংলার একটা বড় অংশের মানুষের মনে বিজেপি যে ধারণা ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে, তা হলো যাদবপুরের পড়ুয়াদের কেউ কেউ দেশদ্রোহী।
সকলেই জানেন, অতিবামরা সংসদীয় গণতন্ত্রের তোয়াক্কা করেন না। তাঁদের আপাতত একটা কাউন্সিলর নির্বাচনেও জেতার উৎসাহ কিংবা ক্ষমতা নেই। সংসদীয় বামেদের তা আছে। কলকাতা পুরসভা নির্বাচনে যাদবপুর বা টালিগঞ্জ অঞ্চলে দু-একটি আসন এখনও সিপিএম নিশ্চিন্তে জিততে পারে। কিন্তু বামেদের গায়ে দেশবিরোধী তকমা লেগে গেলে সেই নির্বাচনেও সফল হওয়া ভীষণ মুশকিল। লক্ষ কোটি ভোটারের মধ্যে হয়তো মাত্র হাজার জন উচ্চমাধ্যমিকে নব্বুই শতাংশ নম্বর পান, আর তাঁদের মধ্যে একশোজন পড়েন যাদবপুরে। তাই পড়ুয়াদের মিছিলের ভিড়, বুদ্ধিদীপ্ত স্লোগান, কিংবা প্রেসিডেন্সির মত অল্প কয়েকটি জায়গায় তাঁদের সমর্থনে ছাত্রছাত্রীদের জমায়েত ভোটবাক্সে কোন প্রভাব ফেলবে না। জেএনইউ, জেইউ, কিংবা প্রেসিডেন্সির পড়ুয়াদের কাজ সাধারণ ভোটার হওয়া নয়, জনগণের নেতৃত্ব দেওয়া।
সেই নেতৃত্ব এক দিনে নির্ধারিত হয় না। আজকে যাদবপুর বা প্রেসিডেন্সিতে যে ঝকঝকে ছেলেমেয়েদের দেখছেন, তাদের মতই সত্তরের দশকে পরিচিত ছিলেন সদ্যপ্রয়াত সুষমা স্বরাজ মহাশয়া কিংবা অরুণ জেটলি মহাশয়। আজকের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ মহাশয়া জেএনইউ এর মেধাবী ছাত্রী ছিলেন কয়েক দশক আগে। বিজেপি বলুন কিংবা আরএসএস, তারা কিন্তু অনেক বছর ধরে নিজেদের প্রস্তুত করেছে। তুলে এনেছে নবীন নেতৃত্ব। সিপিএম কি আজকের জেএনইউ-জেইউ-প্রেসিডেন্সি থেকে সামনের দিনের নেতানেত্রী খুঁজে পাবে? ভোটার কিংবা সমর্থক হিসেবে তাঁরা কিন্তু একেবারেই নগণ্য। তবে সময়টা খুব খারাপ নয়। আরাবল্লী থেকে গঙ্গাপার পর্যন্ত শরতের আকাশে একটু আধটু বাম বাম গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। বিজ্ঞাপনী গণমাধ্যমের ভূমিকা মাথায় রেখে সীতারাম কিংবা সূর্যকান্ত মহোদয়রা কি একটু প্রাণভরে প্রশ্বাস নেবেন? কাশফুলের আড়ালে একটু খুঁজে দেখবেন কি? ঐশীর মত একটা কোন ছোট ছেলেমেয়ে যদি আপনাদের নেতৃত্ব দিতে পারে?
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)